পুতিনের ওপর কেন ‘রেগে’আছেন ট্রাম্প, পরিণাম কী হতে পারে
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প রোববার বলেছেন, তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ওপর ‘বিরক্ত’। আর পুতিন যদি ইউক্রেনে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে রাজি না হন, তাহলে তিনি রাশিয়ার বিক্রি করা জ্বালানি তেলের ওপর অতিরিক্ত আর্থিক দণ্ড আরোপ করবেন।
গত জানুয়ারিতে দ্বিতীয় মেয়াদে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় বসেন ট্রাম্প। তারপর থেকে ইউক্রেনে তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধ থামানোর চেষ্টা করছেন তিনি। এ নিয়ে মস্কোর সঙ্গে আলোচনাও করেছেন। তবে রোববারের বক্তব্যের মধ্য দিয়ে রাশিয়াকে নিয়ে নিজের সুরে বড় বদল আনলেন ট্রাম্প।
পুতিনকে নিয়ে ট্রাম্প কী বলেছেন
রোববার মার্কিন সংবাদমাধ্যম এনবিসিকে একটি সাক্ষাৎকার দেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সেখানে বলেন, সম্প্রতি ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির বৈধতা নিয়ে পুতিন যে মন্তব্য করেছেন, তাতে রুশ প্রেসিডেন্টের ওপর ‘খুবই রাগান্বিত ও বিরক্ত’ হয়েছেন তিনি।
ওই সাক্ষাৎকারে জেলেনস্কির পক্ষে নিজের যুক্তি তুলে ধরেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তিনি বলেন, ইউক্রেনের নেতা হিসেবে জেলেনস্কিকে সরানোর যেকোনো পদক্ষেপ যুদ্ধবিরতির সম্ভাবনাকে নিশ্চিতভাবে বিলম্বিত করবে।
তবে ট্রাম্প এ-ও বলেন, পুতিন জানেন যে মার্কিন প্রেসিডেন্ট তাঁর ওপর রেগে আছেন। এ ছাড়া রুশ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তাঁর ‘খুব ভালো একটি সম্পর্ক’ রয়েছে। তিনি যদি সঠিক কাজটি করেন, তাহলে রাগ দ্রুত প্রশমিত হবে।
২০১৪ সালে ইউক্রেনে মস্কোপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের পতনের পর থেকে পুতিন প্রায়ই দাবি করে আসছেন, ইউক্রেনে ২০১৪ পরবর্তী সব সরকার অবৈধ।
জেলেনস্কিকে নিয়ে পুতিন কী বলেছিলেন
ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে যে শান্তিচুক্তি নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, তাতে স্বাক্ষর করার জন্য জেলেনস্কি সরকারের বৈধতার ঘাটতি রয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন পুতিন। ২০১৪ সালে ইউক্রেনে মস্কোপন্থী প্রেসিডেন্ট ভিক্তর ইয়ানুকোভিচের পতনের পর থেকে পুতিন প্রায়ই দাবি করে আসছেন, ইউক্রেনে ২০১৪–পরবর্তী সব সরকার অবৈধ।
গত বৃহস্পতিবার পুতিন বলেন, ইউক্রেনে জেলেনস্কি সরকারকে সরিয়ে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি সাময়িক প্রশাসন বসাতে হবে। তবে এই প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস।
২০১৯ সালে পাঁচ বছরের মেয়াদে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন ভলোদিমির জেলেনস্কি। এরপর ২০২২ সালে দেশটিতে বিশেষ সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া। ২০২৪ সালে ইউক্রেনে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও যুদ্ধের কারণে সামরিক আইন জারি করা হয়। ফলে দেশটির সংবিধান অনুযায়ী এই পরিস্থিতিতে নির্বাচনের আয়োজন করা সম্ভব নয়।
ইউক্রেনের সাময়িক প্রশাসন ও জেলেনস্কির বৈধতা নিয়ে পুতিন যে মন্তব্য করেছেন, তা নিয়ে ট্রাম্প এখন সমালোচনা করলেও সম্প্রতি তিনিও কিন্তু একই কাজ করেছিলেন। গত ফেব্রুয়ারিতে জেলেনস্কিকে তিনি বলেছিলেন, ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ‘নির্বাচন ছাড়া ক্ষমতায় থাকা একজন স্বৈরশাসক’।
ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা কোন পর্যায়ে আছে
যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারে ট্রাম্প বলেছিলেন, তিনি দ্রুত ইউক্রেন যুদ্ধ থামাবেন। ক্ষমতায় বসার পর একটি শান্তিচুক্তির জন্য তাঁর প্রশাসনের পক্ষ থেকে সৌদি আরবে রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। ট্রাম্প নিজেও আলাদাভাবে পুতিন ও জেলেনস্কির সঙ্গে কথা বলেছেন।
গত ২৫ মার্চ তিন পক্ষই কৃষ্ণসাগরে সামরিকভাবে বলপ্রয়োগ বন্ধে একমত হয়েছে। এ ছাড়া ৩০ দিনের জন্য জ্বালানি অবকাঠামোগুলোয় হামলা বন্ধ করতে রাজি হয়েছে মস্কো ও কিয়েভ। তবে এই হামলা বন্ধ হয়নি বলে অভিযোগ রয়েছে দুই দেশেরই।
এ ছাড়া ভূমি ও সাগরে ৩০ দিনের জন্য যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে ইউক্রেন ও যুক্তরাষ্ট্র। তবে পুতিন এ বিষয়ে এখনো রাজি হননি। তাঁর মতে, নিজেদের সামরিকভাবে আবার সাজিয়ে নিতে এই সময়টাকে কাজে লাগাবে ইউক্রেন।
ট্রাম্পের হুমকি কি কাজে লাগবে
যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে মস্কো রাজি না হলে রাশিয়ার বিক্রি করা জ্বালানি তেলের ওপর ‘দ্বিতীয় ধাপে শুল্ক’ আরোপের হুমকি দিয়েছেন ট্রাম্প। এনবিসিকে তিনি বলেছেন, ‘ইউক্রেনে রক্তপাত বন্ধ করার জন্য আমি ও রাশিয়া যদি একটি চুক্তিতে পৌঁছাতে না পারি, আর যদি মনে করি যে এটা রাশিয়ার ভুলের কারণে হয়েছে, তাহলে রাশিয়া থেকে আসা সব তেলের ওপর দ্বিতীয় ধাপে শুল্ক আরোপ করব।’
ট্রাম্প আরও বলেন, ‘আপনি যদি রাশিয়ার কাছ থেকে জ্বালানি তেল কেনেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসা করতে পারবেন না। সব জ্বালানি তেলের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে, সব তেলের ওপর ২৫ থেকে ৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করা হবে।’
ট্রাম্পের এই হুমকির কারণে রাশিয়ার ওপর কতটা প্রভাব পড়বে, তা পরিষ্কার নয় বলে মন্তব্য করেছেন লন্ডনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউসের জ্যেষ্ঠ পরামর্শক কিয়ার গিলস। তিনি বলেন, ‘আমরা রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগ করতে ট্রাম্পের বেশ কিছু হুমকি দেখেছি। কিন্তু সেগুলো কখনো দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, ‘এই হুমকিগুলো ট্রাম্পের ফাঁকা বুলি কি না, তা আমরা জানি না।’
দ্বিতীয় ধাপের শুল্ক কী
দ্বিতীয় ধাপের শুল্ক আরোপ বলতে ট্রাম্প যেটা বোঝাতে চেয়েছেন বলে মনে হচ্ছে, তা হলো, রাশিয়া থেকে বিভিন্ন দেশের আমদানি করা জ্বালানি তেলের ওপর শুল্ক আরোপ।
অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় ধাপে নিষেধাজ্ঞা দিয়ে আসছে। সাধারণত মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থাকা দেশের সঙ্গে কোনো দেশ বাণিজ্য করলে তাদের ওপর এই দ্বিতীয় ধাপের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। উদাহরণ হিসেবে বলতে গেলে, ইরানের জ্বালানি তেল বা রাশিয়ার ভারী সামরিক সরঞ্জাম কেনার সঙ্গে যুক্ত কোনো দেশ, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে দ্বিতীয় ধাপের নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তরাষ্ট্রের এই দ্বিতীয় ধাপের নিষেধাজ্ঞার হুমকির কারণে বিশ্বের বেশির ভাগ ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইরান বা রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যে যুক্ত হয় না। এই প্রতিষ্ঠানগুলো চায় না যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য হুমকির মুখে পড়ুক।
ট্রাম্প বলেন, ‘আপনি যদি রাশিয়ার কাছ থেকে জ্বালানি তেল কেনেন, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ব্যবসা করতে পারবেন না।’
ট্রাম্পের দ্বিতীয় ধাপের শুল্কে ধাক্কা খাবে কোন দেশ
ট্রাম্প যদি রাশিয়ার জ্বালানি তেলের ওপর দ্বিতীয় ধাপে শুল্ক আরোপ করেন, তাহলে বিশেষভাবে চীন ও ভারত বড় ধাক্কা খাবে। ২০২৪ সালে ভারতের আমদানি করা মোট অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের ৩৫ শতাংশই এসেছিল রাশিয়া থেকে। চীনের ক্ষেত্রে এই পরিমাণটা ছিল সর্বোচ্চ ১৯ শতাংশ।
রাশিয়া থেকে তুরস্কও জ্বালানি তেল আমদানি করে। ২০২৩ সালে তুরস্কের আমদানি করা মোট পরিশোধিত পেট্রোলিয়াম পণ্যের প্রায় ৫৮ শতাংশ এসেছিল রাশিয়া থেকে।
ট্রাম্প যদি শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় ধাপে শুল্ক আরোপ করেন, তাহলে বর্তমানে কার্যকর থাকা শুল্কের সঙ্গে নতুন করে কতটা শুল্ক যুক্ত হবে, তা পরিষ্কার নয়। ২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে এককভাবে সবচেয়ে বেশি পণ্য রপ্তানি করেছে চীন। তবে ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পর চীন থেকে যুক্তরাষ্ট্রে আমদানি করা সব পণ্যের ওপর ২০ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ করেছেন।
ট্রাম্প যদি রাশিয়ার জ্বালানি তেলের ওপর দ্বিতীয় ধাপে শুল্ক আরোপ করেন, তাহলে বিশেষভাবে চীন ও ভারত বড় ধাক্কা খাবে।
ভারতেরও সবচেয়ে বড় রপ্তানি বাজার যুক্তরাষ্ট্র। ২০২৪ সালে ভারত থেকে ৯১ বিলিয়ন ডলারের পণ্য দেশটিতে রপ্তানি করা হয়েছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে ভারত যে উচ্চ শুল্ক আরোপ করে রেখেছে, তা নিয়ে বারবার অসন্তোষ প্রকাশ করে এসেছেন ট্রাম্প। আর যুক্তরাষ্ট্র হলো তুরস্কের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি বাজার।
রাশিয়ার তেল কেনার জন্য ট্রাম্প যদি বিভিন্ন দেশের ওপর খড়গহস্ত হন, তাহলে ভারত ওয়াশিংটনের বড় লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে পারে। ভারতের ২২টি জ্বালানি তেল শোধনাগার রয়েছে। এর মধ্যে গুজরাট রাজ্যের জামনগরে অবস্থিত শোধনাগারটি বিশ্বের সবচেয়ে বড়। ভারতের বিরুদ্ধে রাশিয়ার ভর্তুকি মূল্যে বিক্রি করা তেল কিনে পরিশোধন করে পশ্চিমাদের কাছে বিক্রির অভিযোগ রয়েছে। ভারতের এই কর্মকাণ্ডের ফলে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার আওতায় থেকেও বড় আর্থিক সুবিধা পাচ্ছে মস্কো।
বৈশ্বিক বাণিজ্য নিয়ে তথ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান অবজারভেটরি অব ইকোনমিক কমপ্লেক্সিটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২৩ সাল যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও বেলজিয়ামসহ বিভিন্ন দেশে ৫৫ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার মূল্যের পেট্রল ও ডিজেলের মতো পরিশোধিত জ্বালানি তেল রপ্তানি করেছে ভারত।