হোয়াইট হাউসে দ্বিতীয়বার ট্রাম্প, আকাশ কি ভেঙে পড়বে

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পছবি: এএফপি

কেউ ভাবেনি ২০১৬ সালের মার্কিন নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষে জেতা সম্ভব। ট্রাম্প নিজেও সে কথা ভাবেননি। তাঁর হিসাবে ছিল, জিতুন বা না জিতুন, এ নির্বাচনের পর তিনি আমেরিকায় এবং বিশ্বে এতটাই বিখ্যাত হবেন যে তাঁর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন নিজের একটা টিভি নেটওয়ার্ক চালু করা সম্ভব হবে।

কিন্তু সত্যি সত্যি যখন সেই নির্বাচনে জিতে গেলেন, তখন ভয়ে তাঁর হাত–পা ঠান্ডা। জিতেছেন, সে কথা শোনার পর তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল, তিনি ভূত দেখেছেন। এখন কী হবে? মেলানিয়া ট্রাম্প, তাঁর স্ত্রী, সবার সামনেই কেঁদে ফেললেন, আনন্দে নয়, ভয়ে। বানানো গল্প নয়, নিউইয়র্ক টাইমস–এর নামজাদা সাংবাদিক মাইকেল উলফ তাঁর বই ফায়ার অ্যান্ড ফিউরি-তে সে ইতিহাস সবিস্তার লিপিবদ্ধ করেছেন। 

আট বছর পর ট্রাম্প দ্বিতীয়বার প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হওয়ার পর প্রতিক্রিয়া সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেবার তিনি ভীত হয়েছিলেন। এবার সারা পৃথিবীই ভীত, এই লোকটা অসীম ক্ষমতা হাতে পেয়ে কী কাণ্ড করে বসেন, তা ভেবে।

ট্রাম্পই জিতবেন—এ বিশ্বাস কেবল তাঁর নয়, খোদ ডেমোক্রেটিক নেতৃত্বের মধ্যে বদ্ধমূল ছিল। প্রেসিডেন্ট বাইডেন তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হলে তিনি কেবল হারবেন না, গোহারা হারবেন। সে ভয় থেকেই দলীয় নেতৃবৃন্দের চাপে অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাইডেন প্রতিযোগিতা থেকে সরে দাঁড়ান, তাঁর জায়গায় পা রাখেন কমলা হ্যারিস। তাতেও কাজ হলো না, প্রায় ২৫ লাখ ভোট বেশি পেয়ে তাঁকে প্রায় হেসেখেলে হারালেন ট্রাম্প। 

কেন, কীভাবে, সে ব্যবচ্ছেদ দলের ভেতরে-বাইরে বিস্তর হয়েছে। একটা বিষয়ে সবাই একমত, মুদ্রাস্ফীতি ও অভিবাসন—এ দুই ইস্যুতে মার খেয়ে গেছেন কমলা। তিনি বাইডেনের ভাইস প্রেসিডেন্ট, নিজে কিছুতেই বাইডেনের ব্যর্থ নীতির দায়ভার এড়াতে পারেলেন না। যেসব ভোটারের ওপর কমলা আস্থা রেখেছিলেন—কর্মজীবী, আফ্রিকান-আমেরিকান ও লাতিনো অভিবাসী—তাঁদের একটা বড় অংশ ডেমোক্রেটিক পার্টি ছেড়ে চলে যায় মূলত ওই দুই কারণে। অন্য আরেক কারণ গাজা। 

আফ্রিকান-আমেরিকানদের উদ্দেশে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘আমাকে ভোট দিয়েই দেখো না, তোমাদের এতে হারানোর কী আছে?’ তাঁর সে কথায় শুধু কৃষ্ণকায়রা নয়, লাতিনো অভিবাসীরাও বিশ্বাস রেখেছে। তারা সবাই ট্রাম্পের ভেতর পরিবর্তনের সম্ভাবনা দেখেছে।

‘ডেমোক্র্যাটরা ধরে নেয় আমরা তাদের পক্ষে ভোট দেব, অথচ প্রতিবার ক্ষমতায় যাওয়ার পর আমাদের কথা তারা ভুলে যায়। এবার কমলাকে ভোট দেব না ডেমোক্র্যাটদের শাস্তি দিতে।’ এ কথা মিশিগানের মুসলিম ও আরব ভোটারদের, যারা গাজায় অব্যাহত ইসরায়েলি ধ্বংসযজ্ঞ থামাতে প্রেসিডেন্ট বাইডেনের অক্ষমতায় ও অনাগ্রহে প্রবল ক্ষিপ্ত হয়েছিল। 

ট্রাম্প গণতন্ত্রের জন্য বড় হুমকি—এ কথা ডেমোক্র্যাটরা চার বছর ধরেই বলেছে। ২০২০ সালের সাধারণ ও ২০২২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচনে এ মন্ত্র কাজে দিয়েছিল, কিন্তু ২০২৪ সালে ডেমোক্র্যাটদের কণ্ঠে সে মন্ত্র অনেকবার শোনা ভাঙা রেকর্ডের মতো মনে হয়েছে। 

আমার এক মেয়ে প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। সে বাইডেন বা ট্রাম্প—কাউকেই ভোট দেয়নি। কেন, জিজ্ঞাসা করায় তার জবাব ছিল, এই দুজনের মধ্যে তফাত কোথায়! দুজনেই তো ভিন্ন ভিন্ন বোতলে একই পানীয়।

ট্রাম্প শুধু পুনর্নির্বাচিত হয়েছেন তা–ই নয়, ৭ কোটি ৭৩ লাখ বা দেশের ৪৯ দশমিক ৯ শতাংশ মানুষের ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন। এ বিজয়কে ট্রাম্প নিজের এজেন্ডার সপক্ষে ‘ম্যান্ডেট’ বলে দাবি করছেন। সবাই তাঁর সে কথায় একমত নয়, তিনি প্রায় ৫০ শতাংশ ভোট পেলেও ৫০ শতাংশের সামান্য অধিক মানুষ তাঁকে ভোট দেয়নি। অর্থাৎ দেশটা আগে যেমন বিভক্ত ছিল, এখনো তেমনই বিভক্ত। এই বিভক্ত দেশ চালাবেন কীভাবে ট্রাম্প? 

নির্বাচনের আগে ট্রাম্প নিজেই স্পষ্ট করে বলেছেন, ক্ষমতায় এসে তিনি ঠিক কী করবেন। বামপন্থী অর্থনীতিবিদ রিচার্ড উলফ তাঁর কর্মসূচিকে দুই দেয়ালের সঙ্গে তুলনা করেছেন। একটি দেয়ালের কাজ হবে দক্ষিণ থেকে আসা অনাহূত অভিবাসী ঠেকাতে। অন্য দেয়ালের লক্ষ্য চীনা আগ্রাসন ঠেকাতে আমদানি শুল্ক আরোপ।  

ট্রাম্প বলেছেন, তিনি দেশের সোয়া কোটি অবৈধ অভিবাসীকে জোরপূর্বক বহিষ্কার করতে বদ্ধপরিকর। এর ফল ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি করবে, দক্ষিণের প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে বিরোধ চূড়ান্ত হবে। কিন্তু এতে কি আকাশ ভেঙে পড়বে? 

১৯৩০ সালে প্রেসিডেন্ট হুভার ও ১৯৫৪ সালে প্রেসিডেন্ট আইজেনহাওয়ার লাখ লাখ মেক্সিকান অভিবাসীকে বহিষ্কার করেছিলেন। সে ঘটনায় বিশ্ববাসী নিন্দা করেছে, যুক্তরাষ্ট্রের উদারপন্থীরা হতাশ হয়েছে, কিন্তু অধিকাংশের কাছে সে স্মৃতি এখন ধূসর, প্রায় বিস্মৃত। অভিবাসীদের বহিষ্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন ট্রাম্প, সে প্রতিশ্রুতি না রাখলেই বরং তিনি নিজ সমর্থকদের সমালোচনার মুখে পড়বেন।

তবে চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক বসালে ট্রাম্প ভালোর চেয়ে মন্দই করবেন। তিনি যতই উল্টো যুক্তি দেখান—এই শুল্কের জোগান চীনারা করবে না, মার্কিন ভোক্তাদেরই করতে হবে। ফলে যে মুদ্রাফীতির কারণে তিনি দ্বিতীয় দফা ক্ষমতায়, সেই মুদ্রাস্ফীতিই আবার ডেকে আনবেন।

অনেকের ভয়, ট্রাম্প দেশের আইন ও বিচারব্যবস্থাকে নিজের খেয়ালখুশিমতো ব্যবহার করবেন। যাঁদের তিনি শত্রু বিবেচনা করেন—যে তালিকায় প্রেসিডেন্ট বাইডেন থেকে সাবেক স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি রয়েছেন—তাঁদের বিব্রত করতে একের পর এক তদন্তের নির্দেশ দেবেন। তাঁর সমালোচক হিসেবে পরিচিত মিডিয়াও এ তদন্তের বাইরে থাকবে না। তাঁর প্রতি যথেষ্ট অনুগত নয়, এমন হাজারো ফেডারেল কর্মচারীকে তিনি চাকরিচ্যুত করবেন—এমন কথাও জানিয়েছেন।

কিন্তু ট্রাম্প রাজা নন, তিনি একজন প্রেসিডেন্টমাত্র। হতে পারে নিজ দলে তাঁর বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি করার কেউ নেই, কিন্তু প্রশাসনে ক্ষমতা বিভক্তির কারণে তাঁকে কংগ্রেস ও বিচার বিভাগকে আমলে আনতেই হবে। তিনি যে সর্বশক্তিমান নন, ক্ষমতা গ্রহণের আগেই টের পেয়েছেন। যে ‘অযোগ্য ও দুর্নীতিগ্রস্ত’ ব্যক্তিদের তিনি নিজ রাজসভায়, অর্থাৎ ক্যাবিনেটে প্রস্তাব করেছেন, তাঁদের কেউ কেউ সমালোচনার মুখে নিজেরাই সরে দাঁড়িয়েছেন। দু-একজনকে আবার ট্রাম্প নিজে প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। বলা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের শাসনতন্ত্রে যে ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের’ ব্যবস্থা রয়েছে, তা একেবারে অকেজো হয়ে যায়নি।

তবে স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাত থেকে যেসব নীতি অনুসরণের কথা শোনা যাচ্ছে, তা বাস্তবায়িত হলে সত্যি বিপদ হতে পারে। ট্রাম্প–মনোনীত স্বাস্থ্যমন্ত্রী রবার্ট এফ কেনেডি জুনিয়র জানিয়েছেন, তিনি বাধ্যতামূলক টিকা বাতিল করতে পারেন, পানিতে ফ্লোরাইড প্রয়োগের যে নিয়ম চালু আছে, তা–ও বাতিল করবেন। এর অর্থ, আমেরিকায় আবার পোলিও ফিরে আসতে পারে, দাঁতেও ফিরবে ক্যাভিটি। পরিবেশ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে এ দেশে যে কড়াকড়ি রয়েছে, ট্রাম্প সেসব শিথিল করতে চান। বিপদ তাতে বাড়বে বৈকি। 

তবে সত্যি আকাশ ভেঙে পড়ার মতো যা হতে পারে, তা হলো জলবায়ু সংকট প্রশ্নে ট্রাম্পের উদাসীনতা। অধিকাংশ বিজ্ঞানীর মতে, জলবায়ু সংকট মানবসভ্যতার অস্তিত্বের সংকট। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট মনে করেন, পুরো ব্যাপারই গাঁজাখুরি। 

বৈদেশিক সম্পর্ক প্রশ্নে ট্রাম্প এখন পর্যন্ত যা করবেন বলে আগাম ঘোষণা দিয়েছেন, তার অধিকাংশই খোলা কলসের ঢোল। তাঁর প্রথম চার বছরে সে রকম বাড়ি তিনি অনেক দিয়েছেন। এবার যেমন বলছেন, তিনি পানামা খাল দখলে নেবেন, গ্রিনল্যান্ড কিনে নেবেন, চাইকি কানাডাকে যুক্তরাষ্ট্রের ৫১তম প্রদেশ বানাবেন। এসব আস্ফালনে এসব দেশের কারও নিদ্রা হরণ হচ্ছে বলে মনে হয় না। 

তবে ট্রাম্পের চার বছরে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলোর সম্পর্ক শিথিল হতে পারে। তিনি পারলে ন্যাটোকে ভেঙে দিতেন। সেটা খুব খারাপ হবে না। আমেরিকা ন্যাটোকে ‘জুনিয়র পার্টনার’ বানিয়ে কম বিপর্যয়ের কারণ হয়নি। ট্রাম্প বিদেশের মাটিতে মার্কিন সৈনিক চান না, সেটাও ভালো খবর। 

এই ‘শান্তিবাদী’ ট্রাম্প রাশিয়ার একনায়ক পুতিনের জন্য খুবই সুসংবাদ। তিনি এক সপ্তাহে ইউক্রেন দখলের পরিকল্পনা নিয়ে সে দেশ আক্রমণ করেছিলেন। প্রায় তিন বছর হতে চলল, বাইডেন ও তাঁর ন্যাটো মিত্রদের কারণে ইউক্রেন এখনো যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। ট্রাম্প আশ্বাস দিয়েছেন, তিনি এক দিনেই ইউক্রেন যুদ্ধের সমাধান করবেন। এ সমাধান যে পুতিনের শর্তে, তাতে সন্দেহ নেই। যে শর্তেই হোক, যুদ্ধ যদি থামে, তা সাময়িক হলেও স্বস্তি ফেরাবে।  

পুতিন ছাড়াও অন্য যে লোক মহাখুশি, তিনি হলেন ইসরায়েলের বিবি নেতানিয়াহু। গাজাকে তিনি ইতিমধ্যে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছেন। এখন সে দেশের দক্ষিণপন্থীদের লক্ষ্য পশ্চিম তীরকে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েলের একীভূত করা। প্রথম দফায় ট্রাম্প পশ্চিম তীরের ইহুদি বসতি সম্প্রসারণ অনুমোদন করেছিলেন। এবার হয়তো ‘এনেকসেশনের’ দাবিও মেনে নেবেন। আসাদ-উত্তর সিরিয়ার একাংশে এরই মধ্যে ইসরায়েলি সৈন্য অবস্থান নিয়েছে। সেটিও ট্রাম্পের অনুমোদন পাবে, তাতে সন্দেহ নেই।

ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনে আরও খুশি হবে বিশ্বের চলতি ও ভবিষ্যৎ একনায়কেরা। তাঁর ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ এখন বিশ্বের নানা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। ২০১৭ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে ট্রাম্প বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে সবক দিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমি সবার আগে নিজের দেশের স্বার্থরক্ষায় আগ্রহী। আপনাদেরও বলি, আপনাদেরও উচিত হবে যাঁর যাঁর নিজের দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেওয়া। ভারতের মোদি, ফ্রান্সের মারি লে পেন বা হাঙ্গেরির ভিক্তর অরবান একই ভাষায় কথা বলছেন। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর আমেরিকার নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক আইনের ভিত্তিতে যে বহুপক্ষীয় আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, এখন তা হুমকির মুখে।

ট্রাম্পের পরামর্শ মেনে সবাই যদি যাঁর যাঁর নিজের দেয়াল তোলা শুরু করেন, সেটাই হবে প্রকৃত আকাশ ভেঙে পড়ার মতো ঘটনা।

হাসান ফেরদৌস: প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক