সিগন্যাল কেলেঙ্কারি নিয়ে বিবিসিকে যা বললেন ওই সাংবাদিক

মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথফাইল ছবি: রয়টার্স

মার্কিন সাময়িকী আটলান্টিকের সম্পাদক জেফ্রি গোল্ডবার্গ একটি বিস্ফোরক প্রতিবেদন প্রকাশ করে এ বছরের সবচেয়ে বড় স্কুপ বা বাজিমাৎ খবর করার কৃতিত্ব পেয়েছিলেন। ওই প্রতিবেদনে জেফ্রি গোল্ডবার্গ জানিয়েছেন, কীভাবে মার্কিন সরকারের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ভুল করে তাঁকে স্পর্শকাতর তথ্যে প্রবেশাধিকার দিয়েছিলেন। এ খবর প্রকাশের পর ট্রাম্প প্রশাসনের প্রত্যেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার রোষানলে পড়েছেন জেফ্রি।

কয়েক দিন ধরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জেফ্রি গোল্ডবার্গকে ‘হতভাগা’ ও ‘বস্তাপচা নোংরা’ বলে গাল দিচ্ছেন। পাশাপাশি মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইকেল ওয়াল্টজও তাঁকে ‘মিথ্যাবাদী’ ও ‘নোংরা’ বলেছেন। চলতি মাসের শুরুর দিকে তিনিই জেফ্রিকে ভুল করে একটি গ্রুপ চ্যাটে যুক্ত করেছিলেন।  

এভাবে রাজনৈতিক রোষের লক্ষ্য হওয়ার আগে অবশ্য জেফ্রি গোল্ডবার্গ তাঁর মুঠোফোনে এক বিরল কথা চালাচালি দেখে নিয়েছিলেন। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও, প্রতিরক্ষামন্ত্রী পিট হেগসেথ, সিআইএ পরিচালক জন র‍্যাটক্লিফ এবং জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার পরিচালক তুলসী গ্যাবার্ডসহ মার্কিন মন্ত্রিসভার কর্মকর্তারা ইয়েমেনে আসন্ন সামরিক অভিযানের স্পর্শকাতর বিস্তারিত তথ্য, সময় এবং লক্ষ্যবস্তু নিয়ে আলোচনা করছিলেন। তাঁরা সেখানে জেফ্রির উপস্থিতি লক্ষ্য করেননি বলে মনে হয়েছিল।

ট্রাম্প এখনো পর্যন্ত তার জাতীয় নিরাপত্তা দলকে রক্ষা করে আসছেন এবং তিনি এসব বার্তা ফাঁস হওয়ার ঘটনায় কাউকে বরখাস্ত করতে আগ্রহী বলেও মনে হচ্ছে না। বরং তিনি আটলান্টিকে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনকে তাঁর প্রশাসনের বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের আক্রমণ হিসেবে দেখছেন।

গতকাল বুধবার বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জেফ্রি বলেন, এসব কিছুর শুরু হয়েছিল তিনি তাঁর মুঠোফোনে একটি বার্তা পাওয়া পর। বার্তাটি এসেছিল সিগন্যাল নামে বার্তা আদান-প্রদানের অ্যাপে। অ্যাপটি সাধারণ মানুষের জন্য। এর মাধ্যমে ব্যবহারকারীরা একে অন্যের কাছে সুরক্ষিত বার্তা পাঠাতে পারেন। সাংবাদিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের কাছে অ্যাপটি বেশ জনপ্রিয়। ওয়াল্টজের নামে একটি অ্যাকাউন্ট থেকে জেফ্রিকে একটি বার্তা পাঠানো হয়েছিল। বিষয়টিকে তাঁর কাছে প্রথমে ধোঁকা বলে মনে হয়েছিল।

গুপ্তচরবিষয়ক প্রয়াত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিকের কথা উল্লেখ করে আটলান্টিকের সম্পাদক জেফ্রি গোল্ডবার্গ বলেন, ‘ব্যাপারটায় একটা লু কারীয় মাত্রা থাকলে ভালো হতো। কিন্তু তিনি (ওয়াল্টজ) আমাকে কথা বলার আমন্ত্রণ পাঠালেন। আমি রাজি হলাম। এরপর আমি নিজেকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা নেতৃত্বের সঙ্গে একটি অদ্ভুত চ্যাট গ্রুপে আবিষ্কার করলাম।’

এই ঘটনা ওয়াশিংটনে আলোড়ন সৃষ্টি করার পর ওয়াল্টজ জেফ্রিকে ভুল করে ওই গ্রুপ চ্যাটে যুক্ত করার দায় নেন। তিনি বলেন, আসলে অন্য একজনকে ওই গ্রুপে যুক্ত করতে চেয়েছিলেন।  

ওই গ্রুপ চ্যাটে ইয়েমেনে প্রথম ধাপে হামলার আগে পাঠানো বার্তা রয়েছে। সেখানে এফ-১৮ যুদ্ধবিমান কখন উড়বে, কখন হুতিদের লক্ষ্যবস্তুতে প্রথম বোমা ফেলা হবে এবং কখন টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হবে, তার বিশদ বর্ণনা ছিল।

ওই সম্পাদকের সঙ্গে কখনোই দেখা হয়নি বলে জোর দিয়ে ওয়াল্টজ বলেন, ‘ভিড়ের মধ্যে তাঁর সঙ্গে ধাক্কা খেলে বা পুলিশের দাঁড় করানো সন্দেহজনকদের সারিতে দেখলে আমি তাঁকে চিনতে পারব না।’

তবে জেফ্রি গোল্ডবার্গের বয়ান অনুযায়ী, তাঁরা দুজন আসলে বেশ কয়েকবার দেখা করেছেন। যদিও তাঁদের মধ্যকার সম্পর্কের বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য দিতে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন জেফ্রি। তিনি বলেন, ‘তিনি (ওয়াল্টজ) যা মন চায়, তা বলতেই পারেন। কিন্তু আমি কারও সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কের ব্যাপারে মন্তব্য করব না। একজন প্রতিবেদক হিসেবে খবরে থাকা মানুষদের সঙ্গে আমার কী সম্পর্ক আছে বা নেই, তা নিয়ে আমি কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না।’

তবু একটি বিষয় স্পষ্ট: সিগন্যাল নামের ওই অ্যাপের মাধ্যমে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য আপনার কাছে তাঁর ফোন নম্বর থাকতে হবে। আর এর অর্থ হল ওয়াল্টজের কাছে জেফ্রি গোল্ডবার্গের ফোন নম্বর ছিল। এই শীর্ষ নিরাপত্তা উপদেষ্টা বলেছেন, তিনি প্রযুক্তি খাতের ধনকুবের এবং হোয়াইট হাউসের সরকারি দক্ষতাবিষয়ক বিভাগের প্রধান ইলন মাস্ককে ভুলটি কীভাবে ঘটেছে, তা তদন্ত করতে বলেছেন। জেফ্রি গোল্ডবার্গ এই পদক্ষেপকে হাস্যকর বলেছেন।  

আটলান্টিকের সম্পাদক বলেন, ‘আসলেই, আপনি ইলন মাস্ককে এমন প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাচ্ছেন যে একজনের ফোন নম্বর কীভাবে অন্যজনের ফোনে চলে যায়? মানে, ৮ বছরের একটি শিশুও এটা জানে।’

জেফ্রি বলেন, সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো ‘জাতীয় নিরাপত্তা কর্মকর্তা হিসেবে মুঠোফোনে সিগন্যাল অ্যাপ ব্যবহার করে কি এই কাজ (রাষ্ট্রীয় স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে আলোচনা) করা উচিত?’

গত সোমবার আটলান্টিকে প্রকাশিত খবরে ওই গ্রুপ চ্যাটে ভুলবশত প্রবেশাধিকার পাওয়ার বিষয়টি প্রথম সামনে আনেন জেফ্রি। ওই চ্যাটে ১৪ মার্চ ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের লক্ষ্যবস্তুতে চালানো বোমা হামলার সুনির্দিষ্ট বিবরণ ছিল। আটলান্টিকে প্রকাশিত ওই খবরে সেসব খুঁটিনাটি গোপন রেখেছেন জেফ্রি।  

তবে ট্রাম্প প্রশাসনের কর্মকর্তারা প্রতিবেদনটিকে খাটো করে দেখেন। তাঁরা জেফ্রিকে মিথ্যাবাদী বলে অভিহিত করেন এবং ওই অ্যাপে রাষ্ট্রীয় সংবেদনশীল তথ্য আদান-প্রদানের দাবিকে চ্যালেঞ্জ করেন।

আর তাই দুই দিন পর সাময়িকীটি ওই গ্রুপে হওয়া সম্পূর্ণ কথোপকথন ছেপে দেয়। সেখানে অভিযানের বিস্তারিত তথ্যাদিসহ হেগসেথের বেশ কয়েকটি বার্তাও ছিল। বিবিসি জেফ্রির কাছে জানতে চেয়েছে, এটি কি কঠিন সিদ্ধান্ত ছিল? তিনি বলেন, ‘একবার ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন যে, এখানে মূলত দেখার মতো কিছুই নেই। একবার তুলসী গ্যাবার্ড এবং জন র‍্যাটক্লিফ বলেছিলেন যে কোনো স্পর্শকাতর তথ্য নেই, কোনো গোপন তথ্য নেই ইত্যাদি। আমাদের মনে হয়েছিল, এর সঙ্গে আমরা একমত নই। তাঁরা এসব কথা বলছেন। কিন্তু আমাদের কাছে তো লিখিত বার্তাগুলো আছে। তাই আমাদের মনে হয়েছে, হয়তো মানুষের এগুলো দেখা উচিত।’

ওই গ্রুপ চ্যাটে ইয়েমেনে প্রথম ধাপে হামলার আগে পাঠানো বার্তা রয়েছে। সেখানে এফ-১৮ যুদ্ধবিমান কখন উড়বে, কখন হুতিদের লক্ষ্যবস্তুতে প্রথম বোমা ফেলা হবে এবং কখন টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করা হবে, তার বিশদ বর্ণনা ছিল। তবে এ ব্যাপারে হেগসেথ পাল্টা যুক্তি দিয়ে বলেছেন, স্পষ্টতই এগুলো ‘যুদ্ধ পরিকল্পনা’ ছিল না। এর কোনটিই গোপন তথ্য ছিল না।

এদিকে গত বুধবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হেগসেথের প্রতি তার সমর্থন প্রকাশ করে বলেন, তিনি ‘দুর্দান্ত কাজ করছেন’। এ সময় ট্রাম্প গোল্ডবার্গকে ‘বস্তাপচা নোংরা’ বলে বর্ণনা করেন। হোয়াইট হাউসও যুক্তি দেওয়ার চেষ্টা করেছে যে ওই অ্যাপে আদান-প্রদান করা তথ্য আসলে যুদ্ধ পরিকল্পনা ছিল না।

আরও পড়ুন

জেফ্রি গোল্ডবার্গকে এসব অপমান এবং দাবিতে বিচলিত বলে মনে হলো না। তিনি বলেন, ‘যদি প্রতিরক্ষা সচিব পিট হেগসেথ আমাকে বার্তা পাঠিয়ে বলেন যে ইয়েমেনে আক্রমণ শুরু হতে চলেছে—আমাকে বলেন যে কোন ধরনের বিমান ব্যবহার করা হবে, কোন ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করা হবে এবং বার্তা পাঠানোর দুই ঘণ্টা পর কখন বোমা পাঠানো হবে—আমার কাছে এসব স্পর্শকাতর তথ্য এবং যুদ্ধ পরিকল্পনার তথ্য বলে মনে হয়।

ট্রাম্প এখনো পর্যন্ত তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা দলকে রক্ষা করে আসছেন এবং তিনি এসব বার্তা ফাঁস হওয়ার ঘটনায় কাউকে বরখাস্ত করতে আগ্রহী বলেও মনে হচ্ছে না। বরং তিনি আটলান্টিকে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনকে তাঁর প্রশাসনের বিরুদ্ধে সাংবাদিকদের আক্রমণ হিসেবে দেখছেন।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন