করোনা মহামারি ২০২০ সালে যখন ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছে, তখন ভাইরাসটির মোকাবিলায় চীনের প্রচেষ্টাকে তুচ্ছ–তাচ্ছিল্য করতে একটি গোপন প্রচারণা শুরু করেছিল যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী। প্রাথমিকভাবে ফিলিপাইনে চীনের বাড়ন্ত প্রভাব ঠেকানোই ছিল এর উদ্দেশ্য। সে সময় যেসব দেশে ব্যাপকভাবে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হয়, ফিলিপাইন ছিল সেসবের একটি।
বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হওয়া এ অপপ্রচার ২০২১ সালের মাঝামাঝি বন্ধ হওয়ার আগে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়া ছাপিয়ে মধ্য এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে।
পেন্টাগনের একজন মুখপাত্র প্রচারণায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ যোগাযোগের একাধিক প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। এ প্রচারণার লক্ষ্য ছিল, যুক্তরাষ্ট্র, এর মিত্রদেশগুলো ও শরিকদের বিরুদ্ধে চীনের নেতিবাচক প্রভাবযুক্ত প্রচার-প্রচারণা ঠেকানো। তাঁর দাবি, যুক্তরাষ্ট্র কোভিড-১৯ ছড়াচ্ছে বলে মিথ্যা তথ্য ছড়াতে চীন একটি প্রচারণাও শুরু করেছিল।
গতকাল শুক্রবার রয়টার্সের প্রকাশিত এক তদন্ত প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তরের এক কর্মকর্তা এ গোপন প্রচারণার কথা স্বীকার করেছেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অপপ্রচারের অংশ হিসেবে প্রাথমিকভাবে ফিলিপাইনের নাগরিকের ছদ্মবেশে কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কয়েক শ অ্যাকাউন্ট খোলা হয়। অ্যাকাউন্টগুলো থেকে চীনের তৈরি করোনার টিকা সিনোভ্যাক, মাস্ক ও করোনা পরীক্ষার সরঞ্জামের গুণগত মান নিয়ে মিথ্যা তথ্য প্রচার করা হয়। অথচ ফিলিপাইনে করোনার টিকাগুলোর মধ্যে সবার আগে পৌঁছেছিল সিনোভ্যাক। দেশটিতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাজার হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর গোপন এ প্রচারণা নিয়ে রয়টার্সের আগে আর কোনো সংবাদমাধ্যম প্রতিবেদন প্রকাশ করেনি। প্রচারণাটির উদ্দেশ্য ছিল, চীনের সরবরাহ করা টিকা ও জীবন রক্ষাকারী অন্যান্য উপকরণের সুরক্ষা এবং কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ ছড়িয়ে দেওয়া।
রয়টার্সের তদন্তে এক্সের (সাবেক টুইটার) অন্তত এমন ৩০০টি অ্যাকাউন্ট শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে, যেগুলোর ওই সময়কার পোস্টের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক সামরিক কর্মকর্তাদের দেওয়া বিবরণের মিল পাওয়া গেছে। এসব অ্যাকাউন্টের প্রায় সবই ২০২০ সালের মাঝামাঝি খোলা হয়। এগুলোর স্লোগান ছিল #চায়নাঅ্যাংগভাইরাস। এটি ফিলিপাইনের বড় একটি জনগোষ্ঠীর ব্যবহার করা ট্যাগালগ ভাষার শব্দগুচ্ছ, যার অর্থ চীনই ভাইরাস।
২০২০ সালের জুলাইয়ে এসব অ্যাকাউন্টের একটি থেকে টুইট করা হয়েছিল, ‘কোভিড এসেছে চীন থেকে। টিকাও এসেছে চীন থেকে। তাই চীনকে বিশ্বাস করা যায় না।’ পোস্টের সঙ্গে একটি ছবি ছিল। ছবিতে একটি সিরিঞ্জের পাশে ছিল চীনের জাতীয় পতাকা ও সংক্রমণ বৃদ্ধির তালিকা। আরেক পোস্টে বলা হয়েছিল, ‘চীনের পিপিই, মাস্ক, টিকা ভুয়া। কিন্তু করোনাভাইরাস সত্যি।’
রয়টার্সের পক্ষ থেকে এক্সের কাছে অ্যাকাউন্টগুলোর বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল। এরপর প্রতিষ্ঠানটি অ্যাকাউন্টগুলো মুছে দেয়। এতে এটিই প্রমাণিত হয়, এর সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটিরও যোগসাজশ রয়েছে।
মার্কিন প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর পেন্টাগনের ওই প্রচারণা ফিলিপাইনের পর মধ্য এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। একাধিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে ভুয়া অ্যাকাউন্ট থেকে এ প্রচারণা চালানো হতো। এসব অঞ্চলে প্রচারণা চালানোর উদ্দেশ্য ছিল মুসলমানদের মধ্যে চীনা টিকাবিরোধী মনোভাব তৈরি করা। অথচ তখন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে দিনে হাজার হাজার মানুষ মারা যাচ্ছিলেন। পেন্টাগনের এ পর্যায়ের প্রচারণার একটি কৌশল ছিল বিতর্কিত বিষয়কে আরও বিতর্কিত করা।
ওই প্রচারণা শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের আমলেই। বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রথম কয়েক মাসেও এটি অব্যাহত ছিল। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পক্ষ থেকে মার্কিন প্রশাসনকে পেন্টাগনের মিথ্যা প্রচার সম্পর্কে সতর্ক করার পরও তা চলছিল।
তবে বাইডেনের ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০২১ সালের বসন্তে টিকাবিরোধী ওই কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে একটি আদেশ জারি করা হয়। এরপর নিজেদের প্রচারণা পর্যালোচনা করতে সম্মত হয়েছিল পেন্টাগন।
গোপন কর্মসূচি সম্পর্কে জানতে রয়টার্স ট্রাম্প ও বাইডেনের মুখপাত্রদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। কিন্তু তাঁরা সাড়া দিতে রাজি হননি।
মার্কিন প্রতিরক্ষা বিভাগের একজন কর্মকর্তা উন্নয়নশীল বিশ্বের দেশগুলোতে চীনা টিকাবিরোধী যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর গোপন প্রচারণা চালানোর বিষয়টি স্বীকার করেন। কিন্তু নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই কর্মকর্তা বিস্তারিত কিছু বলতে সম্মত হননি।
পেন্টাগনের একজন মুখপাত্র প্রচারণায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ যোগাযোগের একাধিক প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের বিষয়টি স্বীকার করেছেন। এ প্রচারণার লক্ষ্য ছিল, যুক্তরাষ্ট্র, এর মিত্রদেশগুলো ও শরিকদের বিরুদ্ধে চীনের নেতিবাচক প্রভাবযুক্ত প্রচার–প্রচারণা ঠেকানো। তাঁর দাবি, যুক্তরাষ্ট্র কোভিড–১৯ ছড়াচ্ছে বলে মিথ্যা তথ্য ছড়াতে চীন একটি প্রচারণা শুরু করেছিল।