২৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আয়োজন দেখতে ক্লিক করুন
মূল সাইট দেখতে ক্লিক করুন

বহুদিন থেকেই পেলোসির চোখের বালি বেইজিং

ন্যান্সি পেলোসি
ফাইল ছবি

যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি এশিয়া সফর শুরু করেছেন। তবে পূর্বঘোষণা অনুযায়ী, তিনি তাইওয়ান সফরে যাবেন কি না, তা স্পষ্ট করে কিছু জানাননি। তাই বিষয়টি নিয়ে গুঞ্জন ডালপালা মেলেছে। পেলোসির এ সফরে ক্ষুব্ধ চীন। কূটনৈতিক কারণে হোয়াইট হাউসের মাথাব্যথাও কম নয়। পেলোসি বরাবরই চীনের ঘোর সমালোচক। সেই ১৯৮৯ সাল থেকেই পেলোসির চোখের বালি বেইজিং।

বিবিসির এক প্রতিবেদনে পেলোসির চীন বিরোধিতার অতীত তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়, বেইজিংয়ে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ দমনের দুই বছর পর ১৯৯১ সালে পেলোসি তিয়ানেনমেন স্কয়ার সফর করেন। সেখানে তিনি নিহত বিক্ষোভকারীদের প্রতি সম্মানসূচক ব্যানার প্রদর্শন করেন। সে সময় চীন সরকার পেলোসির প্রতি প্রকাশ্যেই ক্ষোভ প্রদর্শন করে। একসময় চীন পেলোসিকে ‘মিথ্যা ও বিভ্রান্তিপূর্ণ তথ্যে ভরপুর’ বলেও নাম দেয়।

চীনের কাছে স্বশাসিত তাইওয়ান বিচ্ছিন্ন এক প্রদেশ। তাইওয়ানের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি না দিতে অন্য দেশের ওপরও চাপ প্রয়োগ করেছে চীন। তাইওয়ানকে একীভূত করতে শক্তি প্রদর্শন করেছে চীন। তাই চীনবিরোধী পেলোসির তাইওয়ান সফরকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারছে না চীন। দেশটি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছে পেলোসির তাইওয়ান সফরে পরিস্থিতি ভয়ংকর হতে পারে।

চীন-তাইওয়ান নিয়ে যত কথা

যুক্তরাষ্ট্রের আগামী প্রেসিডেন্ট হিসেবে ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের পর ন্যান্সি পেলোসির নামই বেশি উচ্চারিত হচ্ছে। আর পেলোসি যদি তাইওয়ান সফরে যান, তাহলে পূর্বসূরি নিউট গিংরিচের পর তিনিই সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ মার্কিন রাজনীতিবিদ হিসেবে তাইওয়ান সফরে নাম লেখাবেন। ১৯৯৭ সালে নিউট দেশটি সফর করেন।

ন্যান্সি পেলোসি
এএফপি ফাইল ছবি

পেলোসি গত রোববার সিঙ্গাপুরে গেছেন। এরপর পেলোসির ইন্দোনেশিয়া ও জাপান সফরের পরিকল্পনা রয়েছে। পেলোসি এর আগে জানিয়েছিলেন, তিনি তাইওয়ানেও যাবেন। তবে তাঁর এ সফরের পেছনে কী উদ্দেশ্য, তা জানা যায়নি।

যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারাও পেলোসিকে তাইওয়ান সফর থেকে বিরত থাকতে পরামর্শ দিয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সম্প্রতি সাংবাদিকদের বলেছেন, সামরিক বাহিনী মনে করে, তাইওয়ান সফর পেলোসির ভালো পরিকল্পনা নয়।

পেলোসি তিয়েনআনমেন স্কয়ারে যা করেছিলেন

চীনের কমিউনিস্ট পার্টির বাহিনীর দ্বারা বেইজিংয়ের তিয়েনআনমেন স্কয়ারে বিক্ষোভকারীদের কঠোর হাতে দমনের দুই বছর পর ১৯৯১ সালে তৎকালীন ক্যালিফোর্নিয়ার একটি প্রতিনিধিদল বেইজিং সফর করে। সফরসঙ্গী দুই কংগ্রেস সদস্যসহ কাউকে কিছু না জানিয়ে পেলোসি তিয়েনআনমেন স্কয়ারে চলে যান। সেখানে যেতে চীনের কর্তৃপক্ষের যে অনুমতি নিতে হয়, সেটাও তিনি নেননি।

তিয়েনআনমেন স্কয়ার
রয়টার্স ফাইল ছবি

পরে পেলোসির দুই সফরসঙ্গীও তিয়েনআনমেন স্কয়ারে হাজির হন। তিয়েনআনমেন স্কয়ারে গিয়ে তাঁরা হাতে আঁকা একটি ব্যানার প্রদর্শন করেন। ছোট কালো রঙের ওই ব্যানারে লেখা ছিল ‘যারা চীনের গণতন্ত্রের জন্য প্রাণ দিয়েছেন’। পরে অবশ্য চীনের পুলিশ দ্রুত এই কর্মসূচি বন্ধ করে দেয়। তারা যেসব সাংবাদিক এই কর্মসূচির খবর সংগ্রহ করছিলেন এবং যেসব আইনপ্রণেতা সেখানে ছিলেন, তাঁদের সরিয়ে দেয়। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পরে এ ঘটনার নিন্দা জানান। তিনি বলেন, এটি ছিল ‘পূর্বপরিকল্পিত প্রহসন’।

তিয়েনআনমেন স্কয়ার: ১৯৮৯ সালের বিক্ষোভে কী ঘটেছিল

১৯৯১ সালে সফরের সময় পেলোসির এই আচরণের সমালোচনা অনেকেই করেন। সিএনএনের সাবেক বেইজিং ব্যুরোপ্রধান মাইক চিনয় পররাষ্ট্রনীতিবিষয়ক এক কলামে লেখেন পেলোসির কারণেই সেদিন তিনি ঘটনাস্থল থেকে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। ওই কলামে চিনয় আরও লেখেন, পেলোসির তিয়েনআনমেন স্কয়ারে কী করার পরিকল্পনা ছিল, তা তিনি জানতেন না। পুলিশ ঘটনাস্থল পরিদর্শনকারী বিদেশি বিশিষ্ট ব্যক্তি পেলোসিকে গ্রেপ্তার করতে না পেরে তাঁকে (চিনয়) গ্রেপ্তার করে।

চিনয় ওই কলামে আরও লেখেন, চীনের কমিউনিস্ট শাসকদের হেনস্তা করতে পেলোসির এমন কর্মকাণ্ড ছিল তাঁর জন্য একধরনের অভিজ্ঞতা।

পেলোসি ১৯৮৯ সালে বিক্ষোভকারীদের দমনে চীনা সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের নিন্দা জানিয়ে দেওয়া প্রস্তাবের বিষয়েও সহায়তা করেন। নব্বইয়ের পরও কয়েক বছর ধরে পেলোসি বিক্ষোভকারীদের হত্যার অভিযোগ তোলেন। এ ঘটনার প্রতিবাদেও তিনি সোচ্চার ছিলেন। চলতি বছরও তিনি তিয়েনআনমেন স্কয়ারের ঘটনার ৩৩তম বার্ষিকীতে একটি বিবৃতি দেন। সেখানে এ ধরনের বিক্ষোভকে রাজনৈতিকভাবে অন্যতম সাহসী কাজ বলে উল্লেখ করেন তিনি। কমিউনিস্ট দলের শাসনকে অত্যাচারী বলে অভিহিত করে নিন্দা জানান।

হুকে চিঠি

২০০২ সালে সে সময়ের চীনা ভাইস প্রেসিডেন্ট হু জিনতাওয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন পেলোসি। ওই বৈঠকে পেলোসি তাঁকে চারটি চিঠি দেওয়ার চেষ্টা করেন। এসব চিঠিতে চীন ও তিব্বতের বিক্ষোভকারীদের আটক ও কারাগারে রাখার বিষয়ে উদ্বেগ জানানো হয়। তাঁদের মুক্তির জন্য আহ্বান জানানো হয়। তবে হু ওই চিঠি প্রত্যাখ্যান করেন।

অলিম্পিকে যোগ দিতে দেশের প্রধান হিসেবে আপনারা চীনে যাচ্ছেন। অথচ চীনে গণহত্যা চলছে। এ অবস্থায় প্রশ্ন জাগে, এই আসনে বসে থেকে বিশ্বের কোনো দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কথা বলার কতটুকু নৈতিক অধিকার আপনাদের আছে
পেলোসি

এ ঘটনার সাত বছর পর সে সময়ের প্রেসিডেন্ট হুকে হাতে হাতে আরেকটি চিঠি দেন পেলোসি। ওই চিঠিতে তিনি ভিন্নমতের নেতা লিউ জিয়াবোসহ অন্য রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি দিতে আহ্বান জানান। চীনা সরকারবিরোধী ভিন্নমতের নেতা লিউ জিয়াবো ২০১০ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান। তবে সেই পুরস্কার নিতে তাঁকে নরওয়ে যেতে অনুমতি দেওয়া হয়নি। তিনি ২০১৭ সালে চীনের কারাগারে ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।

অলিম্পিক কৌশল

মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত অলিম্পিক গেমসের আয়োজন থেকে চীনকে বিরত রাখতে চেয়েছেন পেলোসি। তিনি অলিম্পিক গেমসের আয়োজক দেশ হিসেবে চীনকে নেওয়ার বিরোধিতা করেছেন।

২০০৮ সালে চীনে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বয়কট করতে সে সময়ের যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশকে যেসব আইনপ্রণেতা অনুরোধ জানিয়েছিলেন, তাঁদের একজন ছিলেন পেলোসি। এ বছরও প্রায় একই চেষ্টা করেন পেলোসি। চীনে উইঘুর মুসলিমদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগে এ বছর শীতকালীন অলিম্পিকে বেইজিংকে কূটনৈতিকভাবে বয়কট করতে আহ্বান জানান হাউস অব স্পিকার পেলোসি।

পেলোসি বলেন, ‘অলিম্পিকে যোগ দিতে দেশের প্রধান হিসেবে আপনারা চীনে যাচ্ছেন। অথচ চীনে গণহত্যা চলছে। এ অবস্থায় প্রশ্ন জাগে, এই আসনে বসে থেকে বিশ্বের কোনো দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে কথা বলার কতটুকু নৈতিক অধিকার আপনাদের আছে।’

পেলোসির এ ধরনের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় ওয়াশিংটনে নিযুক্ত চীনা দূতাবাসের মুখপাত্র বলেন, চীনের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন সমালোচনা করার মতো অবস্থায় নেই যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিবিদেরা।

বছরের পর বছর ধরে পেলোসি চীনের মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে দেশটির বাণিজ্যিক অবস্থাকে মেলাতে চেয়েছেন। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় প্রবেশ নিয়ে চীনের ওপর শর্ত আরোপেরও চেষ্টা করেছেন পেলোসি। বুশ এ ধরনের আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকবার ভেটো দিয়েছেন। সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন প্রাথমিকভাবে আইন প্রণয়নে সমর্থন জানান। তবে পরে প্রত্যাখ্যান করেন। ক্লিনটন বলেন, এ ধরনের আইন প্রণয়ন যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থের পরিপন্থী।