যেসব কারণে টিকা নিতে চান না মার্কিনরা
‘হয় টিকা গ্রহণ করো, নয়তো চাকরি হারাও’—যুক্তরাষ্ট্রে চাকরিজীবীদের জন্য এমন কঠোর নীতি চালু করার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে জো বাইডেনের প্রশাসন। স্বাস্থ্যকর্মী ও শিক্ষকদের টিকা নেওয়া বাধ্যতামূলক করতে নির্দেশ জারি করবেন বলেও জানিয়েছেন বাইডেন। তবে এত কঠোরতার পরও যুক্তরাষ্ট্রে অনেকের মধ্যে টিকা গ্রহণে অনাগ্রহ দেখা গেছে। বিক্ষোভ করছেন স্বাস্থ্যকর্মীরা। এমনকি টিকার বাধ্যবাধকতা এড়াতে প্রয়োজনে চাকরি ছেড়ে দিতেও রাজি আছেন কেউ কেউ।
যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের টিকা গ্রহণে অনীহার কারণ অনুসন্ধান করে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। প্রতিবেদনের অংশ হিসেবে বিভিন্ন পেশার মানুষের কাছে টিকা গ্রহণে অনীহার কারণ জানতে চেয়েছে বিবিসি।
বাধ্যতামূলক টিকা গ্রহণের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ হয়েছে। নিউ হ্যাম্পশায়ার অঙ্গরাজ্যের কনকর্ড এলাকায় হাসপাতালের পোশাক পরে বিক্ষোভে যোগ দেন কিছুসংখ্যক স্বাস্থ্যকর্মীও।
বিক্ষোভকারীদের একজন নার্স লিয়াহ কুশমান। বিবিসিকে তিনি জানান, চাকরি হারাতে প্রস্তুত আছেন, কিন্তু টিকা নিতে রাজি নন। কুশমান বলেন, ‘আমি ধর্মবিশ্বাসী। আমি বিশ্বাস করি, আমার সৃষ্টিকর্তা আমাকে এমন রোগ প্রতিরোধক্ষমতা দিয়ে সৃষ্টি করেছেন, যা আমাকে সুরক্ষা দেবে। ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই আমি অসুস্থ হই। আমার প্রতিরোধব্যবস্থায় প্রভাব ফেলতে পারে—এমন ওষুধ আমি গ্রহণ করব না।’ নিজের এই বিশ্বাস কর্মক্ষেত্রের দায়িত্ব পালনে বাধা সৃষ্টি করবে বলে তিনি মনে করেন না।
কুশমান তাঁর অবস্থানের পক্ষে যুক্তি দেখিয়ে বলেন, কোভিডের টিকাগুলো ‘পরীক্ষামূলক’ অবস্থাতেই থেকে গেছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রে ফাইজারের টিকায় খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসনের (এফডিএ) পুরো অনুমোদন আছে। এর মানে হলো ফাইজারের টিকা নিরাপদ ও কার্যকর। তার পরও কুশমান কোনোভাবেই কোনো টিকা নিতে রাজি নন।
কিছু হাসপাতাল স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য টিকা বাধ্যতামূলক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কর্তৃপক্ষ মনে করছে, এতে হাসপাতালের রোগীরা নিজেদের নিরাপদ মনে করবে। তবে আপার কানেটিকাট ভ্যালি হাসপাতালের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা স্কট কলবি স্বীকার করেছেন, টিকা বাধ্যতামূলক করার পর প্রতিষ্ঠানের বেশ কয়েকজন স্বাস্থ্যকর্মী চাকরি ছেড়েছেন। তিনি মনে করেন, এখন পর্যন্ত টিকা গ্রহণ করাই সঠিক সিদ্ধান্ত। কারণ, টিকা নেওয়া কর্মীদের তুলনায় টিকা না নেওয়া কর্মীদের মধ্যে গুরুতর অসুস্থ হওয়ার ঝুঁকি বেশি। কলবি বলেন, টিকাদান রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, তা বলার সুযোগ নেই। তিনি আরও বলেন, এটি শুধু কোভিডের বিষয় নয়; এমএমআর (হাম, মাম্পস, রুবেলা) কিংবা হেপাটাইটিসের মতো অন্য টিকাগুলোও কর্মীদের গ্রহণ করতে হয়।
টিকা বাধ্যতামূলক করার প্রতিবাদে বিক্ষোভে অংশ নেওয়া নার্স লিয়াহ কুশমান একজন রাজনীতিবিদও। প্রতিনিধি পরিষদে রিপাবলিকান পার্টির প্রতিনিধিত্ব করছেন তিনি। কুশমানের দাবি, তাঁর অবস্থান স্বাধীনতার পক্ষে। তিনি বলেন, ‘বাইডেন প্রশাসন আমাদের সার্বভৌমত্বের অধিকারকে লক্ষ্যবস্তু করছে। আমরা চিকিৎসাকর্মী, তবে আমাদের শরীরের জন্য কোনটা ভালো হবে, তা বেছে নেওয়ার সুযোগ আমাদের নেই।’
বিক্ষোভরত নার্সদের অনেকে মনে করছেন, টিকা নিয়ে অনেক হাসপাতাল রাজনৈতিক খেলা খেলছে। তাঁদের মতে, টিকা নিলে যদি সত্যিই রোগীদের আত্মবিশ্বাস বাড়ে, তাহলে টিকার বদলে সাপ্তাহিকভাবে করোনা পরীক্ষার নিয়ম চালু করা যেতে পারে। তবে অনেক আমেরিকান আবার নিয়মিত করোনাও পরীক্ষা করাতে চান না।
টিকা গ্রহণের বাধ্যবাধকতাকে কেন্দ্র করে কানেটিকাটের ওয়ালিংফোর্ডে সদ্যই চাকরি হারিয়েছেন স্কুলশিক্ষক কাহসেইম আউটলো। গত বছরই স্কুলে তিনি বর্ষসেরা শিক্ষকের স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। তবে টিকা গ্রহণ বাধ্যতামূলক করে অঙ্গরাজ্য কর্তৃপক্ষের জারি করা নির্দেশিকা মানতে রাজি হননি তিনি। কাহসেইম বলেন, ‘চিকিৎসার জন্য, সম্পূরক কিংবা খাদ্য হিসেবে যা–ই বলেন না কেন, আমি আমার জীবনে কোনো দিন সিনথেটিক উপকরণ ব্যবহার করিনি। টিকা গ্রহণের এ নিয়ম আমার জীবনযাপন পদ্ধতির সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক।’
অঙ্গরাজ্যের অন্য শিক্ষকদের মতো কাহসেইম আউটলোকে বলা হয়েছিল, টিকা গ্রহণ না করলে তাঁকে প্রতি সপ্তাহে করোনা পরীক্ষা করাতে হবে। তবে এই পদ্ধতিকে অস্বস্তিকর বলে মনে করেন তিনি।
কাহসেইম বলেন, ‘আত্মার সঙ্গে যখন আমাদের কথোপকথন হয়, তখন এটি আমাদের বলে, কোনটি ঠিক আর কোনটি ঠিক নয়। আর আমার আত্মা আমাকে বলছে, আমি যে সিদ্ধান্ত নেব, তা যেন এখনই নিয়ে নিই।’
তবে কাহসেইম অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করাতে রাজি আছেন। তাঁর বিশ্বাস, তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং তাঁর শরীরে ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রাকৃতিকভাবে প্রতিরোধব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। কত দিন এই প্রাকৃতিক প্রতিরোধব্যবস্থা কার্যকর থাকবে, সে ব্যাপারে কোনো নিশ্চয়তা নেই বলেও স্বীকার করেছেন তিনি। তবে অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করানোর এই প্রস্তাবে সায় দেয়নি তাঁর নিয়োগদাতা প্রতিষ্ঠান।
কাহসেইম আউটলোর কাছে আরও যুক্তি আছে। যেসব কর্মী বাড়িতে বসে কাজ করেন, তাঁদের টিকা গ্রহণে বাধ্য করার অধিকার নিয়োগকারীদের আছে কি না, তিনি জানতে চান।
নিউ হ্যাম্পশায়ারের মাউন্ট মোনাডনক এলাকার কাছাকাছি বসবাস করেন রব সেগ্রিন। একটি তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন তিনি। তাঁকে সতর্ক করা হয়েছে, এ মাসের শেষ নাগাদ কোভিড-১৯–এর টিকা না নিলে চাকরি হারাবেন। সেগ্রিন বলেন, ‘ফেডারেল ঠিকাদারেরা যেভাবে বাড়িতে বসে কাজ করেন, সে ধরনের কাজ এটি। আমাকে কখনো অফিসে যেতে হয় না, মানুষের সঙ্গে আমাকে মিথস্ক্রিয়ায় অংশ নিতে হয় না। আমি টিকার বিরোধিতা করছি, কারণ আমি মনে করি, এটি নিয়ে যথেষ্ট গবেষণা হয়নি। যেভাবে পারি পরিবারের সুরক্ষা আমাকে নিশ্চিত করতে হবে। আমি মনে করি, “এ কাজ করো, নয়তো চাকরি হারাবে”—এমন ধরনের আদেশ দেওয়া আমার নিজের ও পরিবারের ওপর ব্যক্তিগত হামলা। এ যেন আমার জীবিকার ওপরই আঘাত।’
সেগ্রিন আরও বলেন, এখন পর্যন্ত নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাঁর যে আলোচনা হয়েছে, তা ফলপ্রসূ নয়। পরিস্থিতি এখন যে পর্যায়ে আছে, তাতে পূর্ণকালীন চাকরি হারাতে হবে। সেই সঙ্গে স্বাস্থ্যবিমা ও পরিবারের জন্য নির্ধারিত স্বাস্থ্যসুবিধাও হারাতে হবে তাঁকে।
বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে টিকাসংক্রান্ত সরকারি নীতিমালার ক্ষেত্রে বড় ধরনের অসামঞ্জস্য রয়েছে। করোনা মহামারির সময় প্রতিটি ক্ষেত্রে অসামঞ্জস্য দেখা গেছে। বিভিন্ন রিপাবলিকান অঙ্গরাজ্যে টিকা নির্দেশিকার বিরোধিতা দেখা গেছে।
এদিকে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা ও জনস্বাস্থ্য নিয়ে চলমান বিতর্ক ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র যখন হিমশিম খাচ্ছে, তখন পরিসংখ্যান বলছে, এখনো দৈনিক প্রায় দেড় হাজার আমেরিকানের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে ভাইরাস।