বিশ্ব সিলেট সম্মেলনের ভূমিকা: একটি পর্যালোচনা
আগামী সেপ্টেম্বরের ১৬ ও ১৭ তারিখে নিউইয়র্কে জালাবাদ অ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকার উদ্যোগে পৃথিবীর সব জায়গায় ছড়িয়ে থাকা সিলেটীদের সমন্বয় সাধন করে বিশ্ব সিলেট সম্মেলন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। কলকাতা ও বাংলাদেশের সিলেট সম্মেলনের ধারাবাহিকতায় এটি একটি অনন্য পদক্ষেপ। এই সম্মেলন করার প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করার অভিপ্রায়ে সীমিত জ্ঞান নিয়ে সামান্য কিছু আলোচনা করার একটি ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।
সিলেটের ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার
বিরাট অঞ্চল নিয়ে প্রাচীন সিলেটের পরিচিতিতে অনেক ভৌগোলিক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। আজ সরকারিভাবে সিলেট বলতে শুধু সিলেট সদরকেই বোঝায়। সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, জকিগঞ্জ আজ স্বনামে পরিচিত। তাতে কিছু আসে যায় না। তাই আদি ও বৃহত্তর সিলেটের আকর্ষণই হচ্ছে সত্যিকারের সিলেটী ঐতিহ্য। আজ সিলেট একটি শুধু মানচিত্র নয়, আজ সিলেটের বিশ্বায়ন হয়েছে। সিলেটের সেই পুরোনো ঐতিহ্য ও তার অনুভবের প্রভাবে আজ সিলেটী ভালোবাসা পুনর্জাগরণে সবার মনের কোঠায় চিরস্থায়ী আসন করে নিয়েছে। কিন্তু কি সে ভালোবাসা? এর উৎপত্তি কোথায়? এর সঙ্গে অন্যান্য জেলার আঞ্চলিক বন্ধনের তফাৎ কোথায়? এই সব প্রশ্নের উত্তর দেখতে গেলে কিছু ঐতিহাসিক তথ্যের বিশ্লেষণ করতে হয়, মনের জানালায় উঁকি দিয়ে কৈশোরের স্মৃতি উন্মোচন করতে হয়। সিলেট সবাইকে আপন করার নেওয়ার কারণে “সিলেটী” হওয়ার সংজ্ঞা আজ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। অনেকে সিলেটে অনেক দিন বসবাস করে সিলেটকে নিজের করে নিয়েছেন, অনেকে সিলেটে কোনো দিন যায়নি, কিন্তু পূর্বপুরুষের আবাসের জন্য সিলেটী। যারা এই ঐতিহ্য নিয়ে গর্ব বোধ করে তারাই সিলেটী। প্রবাসী সিলেটী বলতেও আর কিছু নেই। ভৌগোলিক সিলেটের বাইরে থেকেও ঐতিহাসিক সিলেটের অনুপ্রেরণায়, সামাজিক সিলেটের ভালোবাসায়, সাংস্কৃতিক সিলেটের ঐতিহ্যে, অসাম্প্রদায়িক সিলেটের আত্মীয়তা বুকে ধারণ করে সবাই আজ স্ব স্ব জায়গায় থেকেও সিলেটী। তাই তারা সবাই বিশ্ব সিলেটী।
সিলেটীরা বাঙালি
অনেকের মনে প্রশ্ন আসে সিলেটীরা কি বাঙালি? তবে সিলেটের বাইরের মানুষকে সিলেটের বেঙ্গলি বলেন কেন? অনেক সিলেটী নিজেদের একটি ভাষা আছে (যার নাম “সিলেটী নাগরী”) বলে দাবি করেন কেন?
তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতে ১৮৭৮ সালে আসাম প্রদেশ ভালো করে শাসন করার জন্য বেঙ্গল প্রদেশ থেকে সিলেট অঞ্চলকে আসাম প্রদেশের সঙ্গে যুক্ত করে। সিলেটের বাঙালিরা বহু আপত্তি করার পরেও কোনো ফল হয়নি। আসামের সঙ্গে যুক্ত হওয়ায় চাকরি বা ব্যবসার জন্য আসা যাওয়া হতো শুধু আসামের শিলং, গুয়াহাটি ইত্যাদি জায়গায় যেখানে নিজেরা শুধু সিলেটী ভাষা বলে কথোপকথন চালিয়ে যেতে পারতেন। সিলেটী ভাষা অন্য অনেক আঞ্চলিক ভাষার মতো বাংলার আরেকটি ভাষা, যার মোটামুটি সব শব্দ বাংলা শব্দ। তবে ঐতিহাসিক কারণে প্রচুর আরবি, ফারসি ইত্যাদি শব্দ ঢুকেছে। ঠিক যেমনটি নোয়াখালী বা চট্টগ্রাম অঞ্চলের ভাষায় ঢুকেছে। শুদ্ধ বাংলা ভাষা বলার প্রয়োজন হতো যাদের কোনো কারণে বেঙ্গল প্রদেশের কলকাতা বা ঢাকা যেতে হতো। কিন্তু বেঙ্গল প্রদেশের কুমিল্লা, নোয়াখালী, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ উত্তরবঙ্গের সব জায়গায় চাকরি বা ব্যবসার কারণে যাতায়াতের জন্য আঞ্চলিক ভাষার পরিবর্তে তাঁদের সবাইকে প্রমিত বাংলায় কথা বলতে হতো, সিলেটীরা তখন বাঙালি হয়েও বেঙ্গল প্রদেশের বাইরে অবস্থান করতে গিয়ে নিজেদের আসামিয়া বলতে চাইতেন না কারণ আসামিয়ারা অন্য একটি বিশেষ ঐতিহ্যবাহী জাতি। তারা তাই নিজেদের “সিলেটী” বলে আসামের ভেতরে বিশেষ একটি জনগোষ্ঠী হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। এই ভালোবাসার ও রেওয়াজের ধারাবাহিকতা পাকিস্তান হওয়ার পর অন্যদের কাছে একটি সংকীর্ণ আঞ্চলিকতার মতো দেখা হতো। অবশ্য পরবর্তী পর্যায়ে এর ভুল ভেঙেছে। সিলেটীরা ব্রিটিশ ভারতের সময় আসামে বাংলা চালু করে। অনেকেই জানেন যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলনের অনুপ্রেরণায় ১৯৬১-এর ১৯ মে মাসে স্বাধীন ভারতের আসামের কাছাড় জেলায় (১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় সিলেটের যে অঞ্চল আসামে রয়ে গেছে) বাংলা ভাষাকে আসামের অপর মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের সংগ্রামে ১১ জন সিলেটী মানুষ শহীদ হয়েছেন। তাদের মধ্যে কমলা ভট্টাচার্য নামে এক তরুণী বাংলা ভাষার জন্য আত্মাহুতি দেওয়া প্রথম নারী।
সিলেটী নাগরী ভাষা একটি সহজ লিখিত ভাষা হিসেবে প্রচলিত হয়েছিল স্বল্প শিক্ষিত সাধারণ মানুষের বিশেষ করে ধর্মীয় পুঁতি পড়ার জন্য। অনেক সময়ে ব্যবহারিক হিসেবের ও দাপ্তরিক কাজেও ব্যবহৃত হয়েছে। তবে কোনো দিন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়নি এবং বাংলা ভাষার বিকল্প হিসেবে ব্যবহারের ও প্রচেষ্টা হয়নি। ভাষাটি অনেক দিন থেকেই বিলুপ্ত।
সিলেটের হিন্দু মুসলিম সুসম্পর্কের কি কারণ এবং পাকিস্তান হওয়ার সময় থেকে বাংলার অন্যান্য মানুষের মাঝে একটি দূরত্ব কীভাবে তৈরি হলো?
অনেক বছর বেঙ্গল প্রদেশের বাইরে থাকায় অন্যান্য বিভাগের মানুষের সঙ্গে কম পরিচিতি ঘটেছে এবং পাকিস্তানের জন্মের পরপর সিলেটী ভাষাকে অনেকের কাছে বোধগম্য হতে সময় লেগেছে। সিলেট অঞ্চলের মানুষেরা আসামে থাকার কারণে বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধাও ভোগ করেছেন যেমন শিক্ষা ক্ষেত্রে, চাকরিতে, প্রদেশের রাজনীতিতে ও ব্যবসায় আসামি জনগোষ্ঠী থেকে এগিয়ে ছিল। আসামের আইনসভায় সিলেটের বেশ প্রতিপত্তি ছিল এবং অনেকেই উচ্চশিক্ষা লাভ করার সুযোগ পেয়েছেন। অনেকে আসামের মন্ত্রী হয়েছেন এবং অনেকেই বড় বড় সরকারি চাকরি করেছেন। বেঙ্গল প্রদেশের অনেকের থেকে সিলেটী বাঙালিরা অনেক এগিয়ে ছিলেন। তাতে অবশ্য আসামিয়াদের কাছে বিরাগভাজনও হতে হয়েছে এবং পরিণাম স্বরূপ আসামিদের “বাঙালি খেদাও” আন্দোলনে নিগৃহীত ও শঙ্কিত থাকতে হয়েছে। সিলেটীরা (সিলেটের বাঙালিরা) তখন একটি প্রতিকূল পরিবেশের চাপে নিজেদের মধ্যে একতাবদ্ধ হতে থাকল। সিলেটের বাইরের এমনকি পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের বাঙালিদের সঙ্গে আসা যাওয়ার বা পরিচিতির সুযোগ না থাকায় সিলেটের নিজেদের অঞ্চলের মধ্যে বিয়ে সাদি থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসবে এক সঙ্গে অংশগ্রহণের জন্য পাড়া প্রতিবেশী এবং হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি আত্মীয়তার সম্পর্ক স্থাপন হলো। সিলেটের অনেক মুসলিম পরিবার মধ্যপ্রাচ্য থেকে এবং বেশির ভাগ স্থানীয়রা বর্ণ হিন্দু থেকে ধর্মান্তরিত হওয়ার (প্রখ্যাত কবি হাসান রাজার পূর্ব পুরুষ জমিদার বিজয় সিংহ) কারণে দুই গোত্রের ভেতর একটি সম্মানের সহাবস্থান বিরাজ করত। তদুপরি আসামের থাকার কারণে হিন্দু-মুসলিম দুই সম্প্রদায়ই সংখ্যালঘু হিসেবে গণ্য হতে থাকে। সিলেটের বাঙালিরা তাই নিজেদের মধ্যে আরও বেশি ঘনিষ্ঠ হওয়া, প্রয়োজনে একে ওপরের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া, দেখা হলে সিলেটী ভাষায় কথা বলে নিজেদের একাত্মতা দেখানো একটি রেওয়াজে পরিণত হয়ে গেল। প্রাচীনকাল থেকে সিলেটী মানুষের আতিথেয়তা, সহনশীলতা ও গ্রহণযোগ্যতার পাশাপাশি সিলেটের বন, জঙ্গল, পাহাড় ও হাওরের বিশাল জলাধার বিভিন্ন সময়ে বহিরাগতদের আশ্রয় দিয়েছে। ব্রিটিশ বিরোধী পরাজিত বিদ্রোহী সেনাদল থেকে শুরু করে রাজ্য থেকে বিতাড়িত মণিপুরি রাজা ও তার বাহিনীর জন্য হয়েছে অভয়াশ্রয়। সেই সংমিশ্রণে সিলেটী মানুষের ভেতর অনেক কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও জ্ঞান এর প্রভাব পড়ে। সেই সুবাদে প্রাচীনকাল থেকেই সিলেটে অনেক জ্ঞানী, গুণী, কবি, ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব সেই পরিবেশে গড়ে উঠেছেন। তদুপরি হজরত শাহজালাল (রা.) ইসলামিক সুফি আদর্শে ভালোবাসা ও সহনশীলতার অবকাঠামো মানুষকে ধর্মীয় দীক্ষা দেওয়ার কারণে মৌলবাদী ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে সাধারণ মানুষেরা অনেক দূরে ছিল। তাই আজও হিন্দু-মুসলিম সবাই তার দরগায় যেতে পারে। সিলেটের সন্তান মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্যের প্রভাবে কট্টরপন্থী ভাবধারার ঊর্ধ্বে থেকে হিন্দুদের মধ্যে বৈষ্ণব ধর্মের মানবিক গুণগুলো প্রসার লাভ করে। সে কারণে বিভিন্ন পল্লি কবির সুরে ও ছন্দে সব ধর্মের মানুষকে একই সুতায় গাঁথে।
পাকিস্তান ভারত ভাগ হওয়ার সময় সিলেটের ও ভাগ হলে তার প্রতিক্রিয়া কী হয়েছিল?
১৯৪৭-এ ভারত বিভক্তির সময় সিলেট আসাম থেকে বের হয়ে আবার বাংলার সঙ্গে মিশতে চাইল। কিন্তু ধর্মীয় কারণে বাঁধ সাধল রাজনীতির মতাদর্শ। সিলেটকে ব্রিটিশরা ভারতকে দিতে চাইল। কিন্তু তত দিনে দ্বিজাতিতত্ত্বের বিভক্তির শিকার হয়েছে সম্পূর্ণ ভারতবর্ষ। তাই ভারত ও পাকিস্তান সীমানা নির্ধারণে একমাত্র সিলেটেই গণভোট হলো। করিমগঞ্জ বাদে পুরো সিলেট তৎকালীন পূর্ববাংলার সঙ্গে পাকিস্তানে যোগ হলো। সিলেটে অনেক পরিবারের আত্মীয়স্বজন, বাড়িঘর এবং আশা-ভরসা দ্বিখণ্ডিত হলো। সদ্ভাব থাকার কারণে এই ইলেকশন হওয়া সত্ত্বেও এখানে কোনো দাঙ্গা হাঙ্গামা হয়নি। হৃদয় ভারাক্রান্ত হয়ে শান্তিপূর্ণ ভাবে বরাক নদীর দুই পারে অনেক হিন্দু ও মুসলিম অনিশ্চিত ভবিষ্যতের আশঙ্কায় ঠিকানা বদল করলেন। কিন্তু তাদের প্রাণটা পড়ে থাকল তাদের পূর্বপুরুষের ভিটেমাটির স্মৃতিতে। অনেক সিলেটী হিন্দু কলকাতাসহ ভারতের অন্যান্য স্থানে পাড়ি জমালেন। কিন্তু আজ ৭০ বছর পরেও কেউ কেউ মুম্বাই থেকেও সন্তানদের জন্য “সিলেটী পাত্রী চাই” বলে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন। সিলেটী সমিতি গড়ে তোলেন অনেক শহরে। সিলেটের উন্নতির জন্য এবং তার সঙ্গে সম্পৃক্ততার জন্য উত্তর আমেরিকা থেকে মার্কিন-ভারতীয়-সিলেটী ডা. কালিপদ চৌধুরী বহু বছর থেকে বড় একটা দাতব্য হাসপাতাল করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। এমনকি ইন্দো বাংলা সিলেট সম্মেলন নাম দিয়ে দক্ষিণ কলকাতা সিলেট অ্যাসোসিয়েশন প্রথম সিলেট সম্মেলন করেন সিলেট থেকে অনেক দূরে ভারতের কলকাতায়। আসামে খণ্ডিত বৃহত্তর সিলেটের অংশ শিলচরেও অনুষ্ঠিত হয়ে চলেছে সিলেটী সম্মেলন। এ বছরই বাংলাদেশের ঢাকায় ও সিলেটে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক সিলেট সম্মেলন নাম নিয়ে অনুষ্ঠান করে ঢাকার জালাবাদ অ্যাসোসিয়েশন। এই ধারাবাহিকতায় নিউইয়র্কে জালাবাদ অ্যাসোসিয়েশন অব আমেরিকার উদ্যোগে ১৬ ও ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭ তে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে প্রথমবারের মতো বিশ্ব সিলেট সম্মেলন।
যুক্তরাজ্যে বিশ্ব সিলেটী ইতিহাস ও তার ঐতিহ্য
বিভিন্ন কারণে সিলেটের অত্যন্ত সাহসী ও অ্যাডভেঞ্চার মানসিকতার মানুষ ব্রিটিশ ভারতে কলকাতায় গিয়ে জাহাজের লস্কর হয়ে চাকরি নিয়ে বিভিন্ন দেশের পাশাপাপাশি যুক্তরাজ্যে গেছেন। কিন্তু তারা যুক্তরাজ্যের মাটিতে নামতেন না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুক্তরাজ্যের অবস্থার অবনতি ঘটে এবং একবার জাহাজে প্রচণ্ড খাদ্যঘাটতি দেখা দেয়। তখন সিলেটী লস্করেরা বাধ্য হয়ে জাহাজ পরিত্যাগ করে লন্ডনে আশ্রয় নেয়। নিজেরা বেঁচে থাকার তাগিদে তখন দেশে ফেরার আশা ত্যাগ করে যুক্তরাজ্যের মানুষের সঙ্গে যুদ্ধাবস্থায় বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত হয়। প্রথমে সিলেট অঞ্চলের যারা যুক্তরাজ্যে বসতি স্থাপন করেছিল তাদের অধিকাংশই ছিল গ্রামের মানুষ। সে সময় অনেক এলাকা স্কুলের অভাবে শিক্ষায় পিছিয়ে ছিল। তবে তাদের মধ্যে যে প্রবল মনোবল ও শক্তি ছিল যার জন্য তারা শিগগিরই রেস্তোরাঁ ব্যবসায় অত্যন্ত সফল হয়। পরবর্তী পর্যায়ে তারা শুধু নিজেদের নিকটাত্মীয় নয়; গ্রামের অনেককেই যুক্তরাজ্যে নিয়ে যাওয়ার প্রয়াস পায়। সে জন্য যুক্তরাজ্যে প্রচুর সিলেটী মানুষের আগমন ঘটে।
এই সব সিলেটী মানুষের দুরন্ত সাহস ও তাদের অন্তর্নিহিত জেনেটিক শক্তি থাকার জন্য তাদের পরবর্তী প্রজন্মরা আজ সেই শক্তির অধিকারী হয়ে বিভিন্ন পেশায়, ব্যবসায় এমনকি মূল রাজনীতিতে বিরাট ভূমিকা রাখতে সক্ষম হচ্ছে। যুক্তরাজ্যে সিলেটের অনেক সফল প্রজন্মরা আজ অনেকের ঈর্ষার ও সম্মানের অধিকারী। তবে তাদের মধ্যে একটি দ্বিধাদ্বন্দ্ব বিরাজ করছে। তার বেশ কিছু কারণ আছে। প্রথমত তারা নিজেদের জীবন নিয়ে ব্যস্ত তদুপরি তাদের পিতামাতার জন্মস্থান সিলেটের বিভিন্ন পরিস্থিতি, তাদের ভুল মূল্যায়ন ও তাদের মা বাবার বিভিন্ন আবেগ-অনুভূতির দুঃখজনক পরিণতি তাদের সিলেটের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থেকে দূরে থাকার প্রয়াস পাচ্ছে।
সিলেটে নিজেদের আত্মপরিচয়কে সমৃদ্ধি করার জন্য তাদের অনেকের মা-বাবা অনেক অর্থ ও সময় ব্যয়ে গ্রামের উন্নতি করা ছাড়াও বিভিন্ন সহায় সম্পত্তি গড়ে তুলেছেন। তাদের এই স্বপ্ন তাদের সন্তানদের কাছে এখনো প্রতীয়মান হয়নি। অথচ তাদের অনুপ্রাণিত ও সম্পৃক্ত করতে পারলে আজকে এই প্রজন্ম সিলেটসহ সম্পূর্ণ বাংলাদেশে তাদের মেধা ও অর্থ দিয়ে উন্নতির জন্য অনেক অবদান রাখতে পারে। আজকে প্রবাসের সবচেয়ে বেশি সিলেটী ঐতিহ্য ধরে রাখার জন্য যুক্তরাজ্যে প্রবাসী সিলেটীরা সে দেশের সর্ব ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। ব্রিটিশ ভারত থেকে শুরু করে পাকিস্তানের সময়, মুক্তিযুদ্ধের সময় এবং এখনো দেশের যেকোনো সাহায্যের জন্য সাহসী ভূমিকা রাখেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় লন্ডনের সিলেটীদের অবদান কিংবদন্তির মতো। সিলেটী মানুষের এই অনুভূতি অত্যন্ত প্রবল ছিল এবং যুক্তরাজ্যে পরবর্তী পর্যায়ে সব বাঙালিকে তারা নিজেদের একজন মনে করে আন্তরিকভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতেন। উত্তর আমেরিকায়ও ইতিহাস গড়ে উঠেছে। বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকা, নিউইয়র্কে মুক্তিযুদ্ধের সময় বিরাট ভূমিকা রাখে এবং সিলেটীরা তাতে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেন।
বিশ্ব সিলেটী
পৃথিবীর সব জায়গায় আজ সিলেটীরা ছড়িয়ে আছে। এই বিস্তারের জন্য যোগাযোগ কমে এসেছিল তবে আজ ইন্টারনেটের যুগে সেই দূরত্ব মুছে ফেলে বিশ্ব সিলেটীরা আবার আহ্বান জানাচ্ছে “আয় প্রাণের মাঝে যায়”। বিশ্ব বাঙালিও আজ সিলেটীদের ঐতিহ্য ও ভালোবাসার আলোকে নিজেদের মধ্যে আরও বন্ধন সুদৃঢ় করার প্রয়াসী হবে বলে আমার বিশ্বাস।
ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ, ফিলাডেলফিয়া, আমেরিকা।