ট্রাম্পের পরাজয়ে কেন উজ্জীবিত ব্রাজিলের বামপন্থীরা
এ মাসের শুরুতে মার্কিন নির্বাচনে জো বাইডেনের কাছে হেরে গেছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্পের নির্বাচনে পরাজয়ের খবরে বিশ্বের অনেকের হয়তোবা মন খারাপ, আবার অনেকেই উল্লসিত। যেমন ব্রাজিলের বামপন্থী নেতারা বেশ উল্লসিত ট্রাম্পের পরাজয়ে। আর কী কারণে বামপন্থীরা উজ্জীবিত, তা তুলে ধরে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান।
ডোনাল্ড ট্রাম্পের পরাজয়ের সংবাদ যখন উত্তর-পূর্ব ব্রাজিলের বাম নেতা ফ্লাভিও ডিনোর বাড়িতে পৌঁছাল, তখন তিনি আনন্দিত, উল্লসিত। কারণ, এই বাম নেতার মতে, ট্রাম্প ছিলেন একজন বিদ্বেষপূর্ণ ব্যক্তি। ব্রাজিলের মারানহো প্রদেশের কমিউনিস্ট পার্টির এই গভর্নর বলছেন, ট্রাম্পের পরাজয় মানে তো মানবতার জয়।
জো বাইডেনের জয় অনেক ব্রাজিলিয়ান বামপন্থীর জন্য আশার খবর। কারণ, দক্ষিণ আমেরিকার ‘গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ট্রাম্প’ নামে পরিচিত ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারোকে হটানোর স্বপ্ন দেখছেন তাঁরা। ট্রাম্পের হার তাঁদের জন্য স্বস্তিদায়ক; কারণ, তাঁরা ভাবছেন, ট্রাম্প হারলে বলসোনারোকে পরাজিত করা সম্ভব হতে পারে। তবে ব্রাজিলের বামপন্থীরা স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য আরও দু বছর সময় পাবেন। এরপর ফুটবলের দেশটিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
ব্রাজিলের সমাজতান্ত্রিক দলের কংগ্রেসম্যান আলেসান্দ্রো মোলোন দাবি করেন, ট্রাম্পের পরাজয় বলসোনারোর পরাজয়ের ইঙ্গিত। ব্রাজিলের নিম্নকক্ষের বিরোধীদলীয় নেতা মোলোন বলেন, ট্রাম্পের হার স্পষ্টতই দেখিয়ে দিয়েছে যে আমেরিকায় যেমন কর্তৃত্ববাদ, উগ্রবাদ ও ফ্যাসিবাদ পরাজিত হয়েছে, ব্রাজিলেও তেমনটি হতে পারে।
তবে এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, কীভাবে আর কেমন করে হবে জইর বলসোনারোর পরাজয়।
ফ্লাভিও ডিনো বলেন, জো বাইডেনের জয়ের খবরে বার্তাটি ছিল পরিষ্কার। একতা, মধ্যপন্থা এবং সংযমই আমাদের সামনের পথ। কারণ, এ পথেই বাইডেনের জয় হয়েছে। আর ২০১৮ সালে যাঁরা বলসোনারোকে ভোট দিয়েছিলেন, তাঁদের সামনে এসব নিয়েই এগোতে চায় ব্রাজিলের বামপন্থীরা।
আগামী নির্বাচনে বলসোনারোর বিরুদ্ধে গঠিত ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা ডিনো বলেন, ডানপন্থী এবং সমসাময়িক একবিংশ শতাব্দীর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য কর্মী–সমর্থকদের এককাট্টা করতে হবে। তিনি বলেন, যুক্তরাজ্যের প্রধান বিরোধী দল লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন যেভাবে প্রগতিশীল কর্মসূচি নিয়ে নির্বাচনে অবস্থান নিয়েছিলেন, আমরাও তা–ই করতে চাই। করবিন হয়তো ক্ষমতায় যেতে পারেননি, তবে পথটা দেখিয়েছেন।
ডিনো বলেন, ‘করবিন নিঃসন্দেহে প্রগতিশীলতার সঙ্গে বামপন্থী অবস্থান নিয়েছিলেন, তবে নির্বাচনে জিততে হয়তো পারেননি। বাইডেন জোরালো অবস্থান নিয়েছিলেন আর বামপন্থীদের সমর্থন পেয়েছিলেন। ফলাফল—জয়ী হতে পেরেছিলেন বাইডেন। মার্কিন নির্বাচন আর যুক্তরাজ্যের নির্বাচনের দিকে তাকালে আপনারা দেখবেন যে ভালো ফল কীভাবে করা যায়, তা বোঝা যাবে।’
লাতিন আমেরিকা অঞ্চলের বলিভিয়া ও চিলির ভোটের উদাহরণ তুলে ধরে ফ্লাভিও ডিনো বলেন, বলিভিয়ায় লুইস আরসের জয়ে বামপন্থীরা শক্তি ফিরে পেয়েছে। এ ছাড়া চিলির ভোটেও একই চিত্র চোখে পড়ে।
ফ্লাভিও ডিনো বলেন, সর্বশেষ (বলিভিয়া ও চিলি) দুটি ঘটনায় এটিই বার্তা যে পরবর্তী দুই বছরে বামদের যতটা সম্ভব ঐক্যবদ্ধ হয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচি এগিয়ে নেওয়া দরকার।
তবে বামদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথা শুধু ডিনো নন, অন্যরাও বলছেন।
মোলোন ব্রাজিলের গত রোববার হয়ে যাওয়া পৌরসভা নির্বাচনের কথা তুলে ধরেন। এ নির্বাচনে বামপন্থীরা ভালো ফল করেছে। তিনি বলেন, বার্নি স্যান্ডার্স বাইডেনকে পেছনে থেকে শক্তি জুগিয়েছেন। ডেমোক্রেটিক পার্টির মনোনয়ন না পেয়ে এ বছরের এপ্রিলে স্যান্ডার্স বলেছিলেন, সবাই এক থাকলে ‘আমরা ট্রাম্পকে এক মেয়াদি প্রেসিডেন্ট করতে পারব’।
আলেকজান্দ্রিয়া ওকাসিও-কার্টেজের কথা উল্লেখ করে মোলোন বলেন, মতাদর্শগত পার্থক্য থাকলেও জরুরি উদ্দেশ্যে এক হয়ে লড়াই যে করা যায়, তা–ই তিনি দেখিয়েছেন। ব্রাজিলের আগামী নির্বাচনে ডানপন্থী প্রেসিডেন্টকে দ্বিতীয় মেয়াদে আসার পথ বন্ধ করতে হবে। বোকা, বেপরোয়া একজন মানুষকে চার বছরের জন্য ব্রাজিল শাসন করতে দেওয়াই যথেষ্ট। আমরা আর ভুল করে তাঁকে আরও চারটি বছর দিতে পারি না। তিনি বলেন, ‘আমাদেরও ডেমোক্রেটিক পার্টির মতো একই পথ অনুসরণ করতে হবে...মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচনে যা হয়েছে, তা এখানেও করা দরকার।’
আর ব্রাজিলের বামপন্থীদের গত সপ্তাহে এই বার্তাই দিয়েছেন সাবেক প্রেসিডেন্ট সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব সাবেক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি লুলা দা সিলভা। লুলা এক অনুষ্ঠানে সমর্থকদের বলেন, ‘ব্রাজিলকে শাসনের করার জন্য বলসোনারোর মতো কৌতুকপূর্ণ ব্যক্তির দরকার নেই। আমি আপনাদের আশ্বাস দিতে পারি যে ওয়াকার্স পার্টি এবং আমার ওপর আস্থা থাকলে বামদের জন্য একটি জোট করব।’
তবে অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকই সন্দেহ পোষণ করছেন যে বামরা তাঁদের দীর্ঘদিনের নেতৃত্বের ভূমিকা ছেড়ে দিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বী জোটের প্রার্থীকে বলসোনারোর বিরুদ্ধে ২০২২ সালে দাঁড় করাতে পারবেন তো?
নানা মতবিরোধের জেরে ২০১৫ সালে লুলার দল ছাড়েন মোলোন। তিনি বলেন, এখনই সময় ব্রাজিলকে বাঁচানোর। এখন সময় এসেছে ভাবার যে দেশ আগে। প্রয়োজন দেশকে প্রথমে রাখার, একজন নেতাকে বিরোধীদের প্রগতিশীল শক্তির প্রধান বানানো; যিনি বলসোনারোকে পরাজিত করার জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করবেন। এর অর্থ এই নয় যে এককেন্দ্রিক প্রার্থী হওয়ার প্রয়োজন। প্রাথী হতে পারেন প্রগতিশীল...এমন কেউ হতে পারেন, যিনি (ভোটারদের) ভয় দেখাবেন না এবং ভোটারদের কাছে প্রত্যাখ্যাত হবেন না।
টমাস ট্রুমান একজন রাজনৈতিক ভাষ্যকার। তিনি বলেন, ব্রাজিলের বামরা মার্কিন ডেমোক্র্যাটদের একতা ও সাহস থেকে শিখতে পারে। কারণ, তারা (ডেমোক্র্যাটসহ অন্য ভোটাররা) বলেছেন, এখন ট্রাম্পের হাত থেকে আগে মুক্তি পাই, তারপরে দেখা যাবে আমরা কী করব।
ট্রুমান বলেন, ‘এটি মৌলিক অঙ্ক: বলসোনারোকে হারাতে আপনার এমন লোকদের সমর্থন প্রয়োজন, যাঁরা বলসোনারোকে গত নির্বাচনে ভোট দিয়েছেন। ডান–বাম না দেখে ভোটারদের আকৃষ্ট করতে হবে।’
তাই তো ডিনো আদর্শিক জায়গায় এক না হলেও প্রতিদ্বন্দ্বীদের বলসোনারোকে হারানোর জন্য এক হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলেলেন যে আর ব্রাজিল যদি তা না করে, তবে ‘অকল্পনীয় মূল্য’ আমাদের দিতে হবে।