লুলা দা সিলভা: প্রেসিডেন্ট থেকে কয়েদি, আবার সদর্পে ফেরা

ছাদখোলা গাড়িতে চড়ে শপথ নিতে যাওয়ার পথে সমর্থকদের উদ্দেশে হাত নাড়ছেন লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা। গতকাল ব্রাজিলের ব্রাসিলিয়ায়
ছবি: রয়টার্স

লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভার জীবন বেশ নাটকীয়। ব্রাজিলের উত্তর–পূর্বাঞ্চলের পারনামবুকোর এক গরিব পরিবারে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। শুরুতে ছিলেন শ্রমিক। সেখান থেকে বামপন্থায় ঝুঁকে পড়া। শ্রমিক রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া। এরপর ধাপে ধাপে দেশটির সর্বোচ্চ পদ প্রেসিডেন্টের আসনে বসেছিলেন তিনি। পরবর্তী সময়ে লুলার বিরুদ্ধে ওঠে অর্থ পাচার ও দুর্নীতির অভিযোগ। জেলেও যেতে হয় তাঁকে। তবে দমে যাননি তিনি।

তৃতীয়বারের মতো লাতিন আমেরিকার সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন লুলা। গতকাল রোববার শপথ নিয়েছেন ৭৭ বছর বয়সী বামপন্থী এ নেতা। ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি ব্রাজিল থেকে দারিদ্র্য, ক্ষুধা ও দুর্নীতি দূর করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।

লুলার এ ফিরে আসাটা ঐতিহাসিক। সদ্য সাবেক প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারোর আমলে ব্রাজিলে বেড়েছে দারিদ্র্য। মধ্যবিত্তের জীবনে কষ্ট বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভক্তি। আর সেটাই কাজে লাগিয়েছেন লুলা। ২০০৩ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত তিনি যখন ক্ষমতায় ছিলেন, তখন দেশে অর্থনৈতিক সংস্কার এনেছিলেন লুলা। মানুষের কষ্ট অনেকটাই লাঘব করেছিলেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে তাই সাধারণ মানুষ পরিবর্তনের আশায় আবারও লুলাকে বেছে নিয়েছেন। যদিও লুলা–বলসোনারোর ভোটের ব্যবধান ছিল সামান্যই।

এ বিভক্তির কথা লুলাও জানেন। তাই শপথ নিয়ে তিনি দেশে ঐক্য ফেরানোর কথা বলেছেন। লুলা বলেছেন, ‘আমি সব ব্রাজিলিয়ানের প্রেসিডেন্ট হতে চাই। সবাইকে সঙ্গে নিয়ে দেশ পুনর্গঠন করতে চাই।’ লুলার মন্তব্য, ‘এখানে দুটি ব্রাজিল নেই। আমাদের একটিই দেশ, আমরা একই মানুষ।’ দেশ থেকে দারিদ্র্য, বর্ণবাদ ও লৈঙ্গিক বিভাজন দূর করা এবং আমাজন বন ধ্বংস করা ঠেকানো অগ্রাধিকারের তালিকায় থাকবে বলেও জানিয়েছেন লুলা। লুলার ভাষ্য, তিনি দেশকে আবারও বিশ্বের ‘শীর্ষ খাদ্য উৎপাদনকারী ও সবুজ জ্বালানির পরাশক্তি’ হিসেবে দেখতে চান।

বিদায়ী প্রেসিডেন্ট নতুন প্রেসিডেন্টকে উত্তরীয় পরিয়ে বরণ করে নেন, এটাই ব্রাজিলে রেওয়াজ। এবার ব্যতিক্রম দেখা গেছে। লুলার শপথের আগেই গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় পাড়ি জমিয়েছেন বলসোনারো। ভোটের ফল মেনে নিলেও তিনি নিজ হাতে লুলাকে উত্তরীয় পরাবেন না বলে আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন। তাই লুলার এবারের শপথ ভিন্ন রকম ছিল। লুলা বলেছেন, ব্যক্তিগত ও আদর্শিক কারণে যাঁরা দেশকে পিছিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের ওপর প্রতিহিংসার মনোভাব পোষণ করবেন না তিনি ও তাঁর প্রশাসন।

আরও পড়ুন
জইর বলসোনারো ও লুলা দা সিলভা
ফাইল ছবি: রয়টার্স

আমাজন বন ধ্বংস, দেশে করোনার বিস্তার ঠেকাতে না পারা, অর্থনৈতিক শ্লথতা, দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়া, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, বিজ্ঞানের মতো প্রয়োজনীয় নানা বিষয়ে বরাদ্দ কমিয়ে আনায় তুমুল সমালোচিত ছিলেন ডানপন্থী বলসোনারো। সেখান থেকে দেশকে ঘুরে দাঁড় করাবেন, দেশবাসীকে এমন স্বপ্ন দেখিয়ে ক্ষমতায় বসেছেন লুলা। তাই তাঁর সামনে চ্যালেঞ্জও সীমাহীন। যদিও লুলা বলেছেন, ব্রাজিলে করোনায় সাড়ে ছয় লাখের বেশি মানুষের মৃত্যু গণহত্যার শামিল। এ বিষয়ে আগের প্রশাসনের ব্যর্থতা তদন্ত করে দেখা হবে।

আরও পড়ুন

ব্রাজিলের কংগ্রেসে বলসোনারোর দলের আধিক্য রয়েছে। আর গত শনিবার ডাটাফোলহা ইনস্টিটিউটের এক জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ৫১ শতাংশ ব্রাজিলিয়ান মনে করছেন, বলসোনারোর চেয়ে লুলা ভালো কাজ করতে পারবেন। তাই কাজের ক্ষেত্রে বিরোধী রাজনীতিক ও জনগণ—দুই পক্ষেরই মন জুগিয়ে চলতে হবে লুলাকে।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও বিতর্কিত ছিলেন বলসোনারো। এ জন্য অনেক দেশের সঙ্গে ব্রাজিলের সম্পর্কে ফাটল দেখা গেছে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জনপ্রিয় লুলাকে দেশের হারানো ভাবমূর্তি ফেরাতে হবে। এর ঝলক দেখা গেছে তাঁর শপথ অনুষ্ঠানে। লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশ, জার্মানি ও পর্তুগালের প্রেসিডেন্ট এবং স্পেনের রাজাসহ ১৯ দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানেরা এতে অংশ নিয়েছেন।

আরও পড়ুন

আবারও প্রেসিডেন্ট হওয়ায় লুলাকে অভিনন্দন জানিয়ে টুইট করেছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ। টুইটে লুলাকে ‘প্রিয় প্রেসিডেন্ট, প্রিয় বন্ধু’ উল্লেখ করেছেন মাখোঁ। অন্যদিকে লুলাকে অভিনন্দন জানিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন টুইটে লিখেছেন, ‘বিশ্বের সামনে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে।’

আরও পড়ুন