পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত বিশ্ব গড়ার প্রচেষ্টায় শান্তিতে নোবেল

পারমাণবিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী জনমত গড়ে তোলার স্বীকৃতি হিসেবে এ বছর শান্তিতে নোবেল পেয়েছে জাপানে পারমাণবিক বোমা হামলার ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের সংগঠন নিহন হিদানকায়ো। গতকাল শুক্রবার বাংলাদেশ সময় বেলা তিনটায় নরওয়ের রাজধানী অসলোর নোবেল ইনস্টিটিউট থেকে এবারের শান্তিতে নোবেল বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হয়।

১৯৪৫ সালে জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে পারমাণবিক বোমা হামলা চালায় যুক্তরাষ্ট্র। নোবেল কমিটি বলেছে, সে হামলায় বেঁচে যাওয়া ব্যক্তিদের সংগঠন নিহন হিদানকায়ো বিশ্বকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত করার যে অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, এবারের শান্তির নোবেল তারই স্বীকৃতি।

নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান ইয়েরগেন ওয়াটনে ফ্রিডনেস বলেছেন, পারমাণবিক অস্ত্রের ব্যবহার চিরতরে বন্ধে জনমত গড়ে তুলতে বহু বছর ধরে কাজ করছে নিহন হিদানকায়ো। এ লক্ষ্যে হামলার শিকার ব্যক্তি ও প্রত্যক্ষদর্শীরা দুঃসহ সে অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেওয়ার মাধ্যমে বিশ্ববাসীর সামনে এর ভয়াবহতা তুলে ধরার কাজটি করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, পারমাণবিক অস্ত্র যে একটি নিষিদ্ধ বিষয় তা প্রতিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে সংগঠনটি।

নিহন হিদানকায়ো পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহতা তুলে ধরার এ কাজ শুরু করে হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে হামলার এক দশক পর। ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠিত এ সংগঠন ভয়াবহ সেই পারমাণবিক হামলার নির্মমতা, ভোগান্তি ও দুর্বিষহ অভিজ্ঞতা যেন মানুষ জানতে পারে, এ লক্ষ্যে হামলার শিকার ব্যক্তি ও প্রত্যক্ষদর্শীদের বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পাঠিয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের একটি বোমারু বিমান থেকে হিরোশিমা শহরে পারমাণবিক বোমা হামলা চালানো হয়। এতে প্রাণ হারান প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ। এর তিন দিন পর নাগাসাকি শহরে মার্কিন বাহিনীর পারমাণবিক বোমা হামলায় আরও প্রায় ৭৪ হাজার মানুষ নিহত হন। সেই প্রথম ও শেষবার পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহার দেখেছে বিশ্ব।

শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য এর আগেও একাধিকবার মনোনয়ন পেয়েছিল নিহন হিদানকায়ো। ২০০৫ সালে নোবেল কমিটি বিশেষভাবে সংগঠনটির নাম উল্লেখ করে। নিহন হিদানকায়ো শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছে জানার পর সংগঠনটির উপপ্রধান তোশিইউকি মিকামি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। বার্তা সংস্থা এএফপির প্রতিবেদন অনুযায়ী, অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে জাপানি সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি এটা ঘটতে পারে।’ পারমাণবিক অস্ত্রের ইতিবাচকতার কথা যাঁরা বলেন তাঁদের সমালোচনা করে মিকামি বলেন, বলা হয় যে পারমাণবিক অস্ত্রের কারণে নাকি বিশ্বে শান্তি বিরাজ করছে। কিন্তু পারমাণবিক অস্ত্র তো সন্ত্রাসীরাও ব্যবহার করতে পারে।

গত বছর বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তোশিইউকি মিকামি বলেন, হিরোশিমায় পারমাণবিক বোমা হামলার সময় তাঁর বয়স ছিল মাত্র তিন। কম বয়স হলেও তাঁর বাড়ির সামনে দিয়ে ঝলসানো ও দগ্ধ মানুষজনের ছোটাছুটির সেই দুঃসহ স্মৃতি আজও তিনি মনে করতে পারেন।

প্রতিষ্ঠার পর থেকে পারমাণবিক যুদ্ধ এড়ানো ও বিদ্যমান পারমাণবিক অস্ত্র ধ্বংসের ব্যাপারে প্রচার চালিয়ে আসছে নিহন হিদানকায়ো। পারমাণবিক অস্ত্রের ওপর পূর্ণ নিষেধাজ্ঞার জন্য আন্তর্জাতিক একটি চুক্তিরও আহ্বান জানিয়ে আসছে সংগঠনটি।

নিহন হিদানকায়োকে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার পর গতকাল একটি বিবৃতি দেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা। বিবৃতিতে তিনি বলেন, পারমাণবিক অস্ত্রের বিলুপ্তির জন্য বহু বছর ধরে কাজ করে আসা একটি সংগঠনকে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত করা সত্যিই অর্থবহ।

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এক বিবৃতিতে বলেন, হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া এসব মানুষ নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। পারমাণবিক অস্ত্রের জন্য মানুষকে যে চরম মূল্য দিতে হয়েছে, সে সাক্ষ্য বহন করে চলেছেন তাঁরা। এসব মানুষ যতটা স্পষ্ট দেখেছেন, সেই চোখেই পারমাণবিক অস্ত্রের ভয়াবহতাকে দেখতে হবে বিশ্বনেতাদের। এ মৃত্যুযন্ত্র কোনোভাবেই সুরক্ষা ও নিরাপত্তা দিতে পারে না। পারমাণবিক অস্ত্রের হুমকিমুক্ত হওয়ার একমাত্র উপায় সব পারমাণবিক অস্ত্র একসঙ্গে ধ্বংস করে ফেলা।

নরওয়েজিয়ান নোবেল ইনস্টিটিউট জানিয়েছে, এবার শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পাওয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ছিল ২৮৬। এর মধ্যে ব্যক্তি ছিলেন ১৯৭ জন। আর প্রতিষ্ঠান ৮৯টি। এবারের নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার ক্ষেত্রে সম্ভাব্য তালিকায় আরও দুটি প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল। প্রতিষ্ঠান দুটি হলো জাতিসংঘের ফিলিস্তিনবিষয়ক শরণার্থী সংস্থা (ইএনডব্লিউআরএ) ও আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে)।

নোবেল পুরস্কারের অর্থমূল্য হিসেবে ১ কোটি ১০ লাখ ক্রোনার (সুইডিশ মুদ্রা) ও একটি স্বর্ণপদক পাবে নিহন হিদানকায়ো। গত বছর শান্তিতে নোবেল পেয়েছিলেন ইরানের কারাবন্দী মানবাধিকারকর্মী নার্গিস মোহাম্মদি। দেশটিতে নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াইয়ের স্বীকৃতি হিসেবে তাঁকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়।

নোবেল পুরস্কারের প্রবর্তক সুইডিশ বিজ্ঞানী আলফ্রেড নোবেল। তাঁর ইচ্ছা অনুসারে ১৯০১ সাল থেকে প্রতিবছর নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়। গবেষণা, উদ্ভাবন ও মানবকল্যাণে যাঁরা অবদান রাখেন, তাঁরা পান বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ এ পুরস্কার।

প্রতিবছরের মতো চিকিৎসাবিজ্ঞানের মধ্য দিয়ে ৭ অক্টোবর থেকে এ বছরের নোবেলজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হচ্ছে। চিকিৎসার পর ৮ অক্টোবর পদার্থবিদ্যা, ৯ অক্টোবর রসায়ন, ১০ অক্টোবর সাহিত্যে এবারের নোবেল বিজয়ীদের নাম ঘোষণা করা হয়। ১৪ অক্টোবর অর্থনীতিতে নোবেলজয়ীর নাম ঘোষণা করা হবে। আগামী ১০ ডিসেম্বর আলফ্রেড নোবেলের মৃত্যুবার্ষিকীতে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এবারের নোবেলজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হবে।

ড. ইউনূসের অভিনন্দন

শান্তিতে নোবেল পাওয়ায় নিহন হিদানকায়োকে অভিনন্দন জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল এক বিবৃতিতে ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেলজয়ী ড. ইউনূস বলেন, ‘পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণ ও শান্তির জন্য আপনাদের অবিচল অবস্থান আমাদের সবার জন্য একটি অনুপ্রেরণা। হিরোশিমা ও নাগাসাকির দুঃসহ স্মৃতি যাতে বিশ্ব কখনো ভুলে না যায়, এ জন্য আপনাদের নিরলস প্রচেষ্টা একটি নিরাপদ পৃথিবীর জন্য আমাদের প্রত্যাশাকে গভীরভাবে ছুয়ে যায়। সাহসিকতা ও নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে যাওয়ায় আপনাদের ধন্যবাদ।’

আরও পড়ুন