ইমরান খানের বিরুদ্ধে মামলা, এরপর কী ঘটতে যাচ্ছে

পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান
ছবি: এএফপি

পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) চেয়ারম্যান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা হয়েছে। এ নিয়ে দেশটিতে রাজনৈতিক উত্তেজনার পারদ আরেক ধাপ বেড়েছে। জনসমাবেশে ‘অভিযোগমূলক’ মন্তব্য করায় পুলিশ তাঁর বিরুদ্ধে এ মামলা করে। রাজনীতিতে টিকে থাকার লড়াই চালিয়ে যাওয়া ইমরানের সামনে এখন কী আছে, তা নিয়ে বিশ্লেষণমূলক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আল-জাজিরা।

মামলার বিষয়ে ইমরান খান এখনো নিজে কোনো প্রতিক্রিয়া জানাননি। তাঁর আইনজীবীরা গতকাল সোমবার ইসলামাবাদ হাইকোর্টে আগাম জামিনের আবেদন করেন। আদালত তাঁকে বৃহস্পতিবার নাগাদ অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দিয়েছেন। ওই দিন তিনি রাজধানীর এ আদালতে হাজির হতে পারেন।

কেন ইমরানের বিরুদ্ধে এ মামলা

পিটিআই চেয়ারম্যানের চিফ অব স্টাফ শাহবাজ গিলকে গ্রেপ্তার ও রিমান্ডে নির্যাতনের অভিযোগে গত শনিবার সন্ধ্যায় ইসলামাবাদে প্রতিবাদ সমাবেশের আয়োজন করে দলটি। সমাবেশে দেওয়া বক্তব্যে ইমরান খান রাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের ‘হুমকি’ প্রদান ও তাঁদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার অঙ্গীকার করেন বলে অভিযোগ করা হয়। এর আগে ৯ আগস্ট গিলকে গ্রেপ্তার করা হয়।

আরও পড়ুন
ইমরান খানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা করায় দেশটিতে রাজনৈতিক উত্তেজনার পারদ আরেক ধাপ বেড়েছে
ছবি: রয়টার্স

ইমরান খান ইসলামাবাদ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এবং একজন নারী বিচারকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছিলেন। ওই বিচারক সপ্তাহের শুরুর দিকে গিলকে দুই দিনের আটকাদেশ দিয়েছিলেন। এর আগে দেশটির শক্তিশালী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহে উসকানির অভিযোগে গিলের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করা হয়।

পিটিআই চেয়ারম্যান বলেন, হেফাজতে নিয়ে গিলকে নির্যাতন করেছে পুলিশ। তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ ষড়যন্ত্রেরই অংশ। এর উদ্দেশ্য পিটিআইকে সামরিক বাহিনীর মুখোমুখি দাঁড় করানো। তবে নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করেছে পুলিশ।

সমাবেশে ইমরান খান বলেন, ‘আমি যখন ইসলামাবাদ পুলিশকে জিজ্ঞাসা করলাম, “গিলের সঙ্গে তোমরা কী করেছ আমাকে বলো।’ আমাকে বলা হলো, “আমরা কিছু করিনি। আমাদের আদেশ মানতে বাধ্য করা হয়েছে।”’

পিটিআই চেয়ারম্যানের মন্তব্যের নিন্দা জানিয়েছে ইসলামাবাদ পুলিশ। কেউ ‘পুলিশকে হুমকি দিলে এবং মিথ্যা অভিযোগ করলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণেরও’ হুঁশিয়ারি দিয়েছে তারা।

গত রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রানা সানাউল্লাহ বলেন, ‘উসকানিমূলক বক্তব্য’ দেওয়ায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মামলা করার বিকল্পগুলো খতিয়ে দেখছে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় রাতে ইমরান খানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে এজাহার করে পুলিশ।

আরও পড়ুন

কেন সন্ত্রাস দমন আইনে মামলা

ম্যাজিস্ট্রেট আলি জাভেদের সাক্ষ্যের ভিত্তিতে ইমরান খানের বিরুদ্ধে এজাহার করে পুলিশ। তিনি শনিবারের ওই সমাবেশে ছিলেন বলে দাবি করেন। জাভেদ বলেন, তিনি ইমরান খানকে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ও এক বিচারকের সমালোচনা করতে শুনেছেন।

পিটিআই চেয়ারম্যানকে বলতে শোনা যায়, ‘তোমরাও এর জন্য প্রস্তুত হও, আমরাও তোমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব। অবশ্যই তোমাদের সবাই লজ্জিত হবে।’ নতুন এ অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হলে ইমরান খানের কয়েক বছর কারাদণ্ড হতে পারে। দেশটির রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের অধীন পুলিশ কর্মকর্তাদের ও বিচারককে হুমকি দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আইনের ধারাবাহিকতায় এ আইন করা হয়েছে।

কেন ইমরানের বিরুদ্ধে এ পদক্ষেপ

পার্লামেন্টে আনা অনাস্থা প্রস্তাবে হেরে গত এপ্রিলে ক্ষমতাচ্যুত হন ইমরান খান। এর পর থেকে জনসম্পৃক্ততা বাড়াতে একের পর এক সমাবেশ করে যাচ্ছেন পিটিআই চেয়ারম্যান। এসব সমাবেশে নিজের রাজনৈতিক বিরোধী, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, পুলিশ, বিশেষ করে কথিত ‘নিরপেক্ষদের’ নিয়ে বিস্ফোরক মন্তব্য করেন ইমরান খান। দেশটির সামরিক বাহিনীকে বোঝাতে প্রতীকী অর্থে সচরাচর ‘নিরপেক্ষ’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়।

ইমরান খান অভিযোগ করে বলেন, ‘বিদেশি ষড়যন্ত্রের’ অংশ হিসেবে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রকে ইঙ্গিত করে তিনি এ কথা বলেন। যদিও নিজের অভিযোগের সপক্ষে কোনো প্রমাণ দেননি সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।

তবে সামরিক বাহিনীকে নিয়ে মন্তব্য করার ক্ষেত্রে সতর্ক শব্দচয়নে সচেষ্ট থেকেছেন ইমরান খান। তিনি তাঁদের ‘নিরপেক্ষ না থাকার’ এবং ক্ষমতাসীন জোটের পক্ষ না নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছেন। এ ছাড়া এ সরকারকে ‘দুর্নীতিবাজ’ তকমা দিয়েছেন পিটিআই চেয়ারম্যান।

তবে ইমরান খান মে মাসে ইসলামাবাদ অভিমুখে দলের লংমার্চ কর্মসূচিতে নেতা-কর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন চালানোর ঘটনায় ‘নিরপেক্ষদের’ দায়ী করেন। ইমরান বলেন, ‘২৫ মার্চ যখন পুলিশ আমাদের বিরুদ্ধে সহিংস আচরণ করে, তখন অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলো থেকে আমাকে বলা হলো, তাঁরা ওপরের নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করছেন। এতে বোঝা যায়, পিটিআইয়ের কর্মীদের মারধর করতে তাঁরা নিরপেক্ষদের চাপের মধ্যে ছিল।’

‘প্রতিটি সিদ্ধান্ত পিটিআইয়ের বিরুদ্ধে নেওয়ায়’ নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। প্রধান নির্বাচন কমিশনারও রাজনৈতিক চাপে আছেন বলে অভিযোগ করেন তিনি।

ইমরানকে কি কারাগারে পাঠানো হবে

ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ হায়দার রসুলের মতে, সন্ত্রাস দমন আইনে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীকে বৃহস্পতিবার অবশ্যই আদালতে হাজির হতে হবে।

হায়দার রসুল বলেন, ‘ইমরান খানকে সশরীর আদালতে হাজির হতে হবে। শুধু মেরিট (আইনি গ্রহণযোগ্যতা) বিবেচনায় মামলাটি খারিজ করা যাবে না। তাঁকে আদালতে হাজির হতে হবে, তাঁর জামিনসংক্রান্ত বন্ড জমা দিতে হবে। খুব সম্ভবত তাঁকে আরও কয়েক দিনের অতিরিক্ত জামিন দেওয়া হবে।’

হায়দার রসুল বলেন, আদালত জামিন আবেদন প্রত্যাখ্যান করলে আনুষ্ঠানিকভাবে ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করা হতে পারে। তবে এ আশঙ্কা খুবই কম। ইমরান খানের আইনজীবী ফায়সাল ফরিদ চৌধুরী বলেন, এজাহারটি তাৎক্ষণিক খারিজ করে দেওয়া হবে। কারণ, এটি সুপ্রিম কোর্টের বিগত আদেশগুলোর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

অন্য আইনজ্ঞদের সঙ্গেও কথা বলেছে আল-জাজিরা। এজাহারটি আইনি বিতর্কমুক্ত নয় এবং এটি খারিজ হয়ে যেতে পারে বলে তাঁরা একমত হয়েছেন। সংবিধান বিশেষজ্ঞ আবুজর সালমান নিয়াজি বলেন, ইমরান খানের বিরুদ্ধে করা এজাহারের কোনো মেরিট নেই।

আবুজর সালমান নিয়াজি বলেন, ‘হাইকোর্টে যাওয়ার আগেই খারিজ হয়ে যাওয়ার মতো একটি মামলা এটি। ১৯৯৭ সালের সন্ত্রাস দমন আইনের অধীন সন্ত্রাসবাদ শব্দটির প্রয়োগ একেবারেই সুনির্দিষ্ট। “আমরা তোমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব”—কেবল এমনটা বলা সন্ত্রাসের পর্যায়ে পড়ে না। এমনকি এটি পাকিস্তান দণ্ডবিধির অধীন অপরাধমূলক ভীতি প্রদর্শনের মধ্যেও পড়ে না।’

নিয়ম অনুযায়ী বৃহস্পতিবার বিচারিক আদালতে ইমরান খানের জামিন হওয়ার কথা উল্লেখ করে নিয়াজি বলেন, ‘যদি এমনটা না হয়, সে ক্ষেত্রে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হতে পারে। আপনাকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, পাকিস্তানে সন্ত্রাস দমন আইন সচরাচর মেরিটের ভিত্তিতে নয়, রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়।’

যা হোক, রাজনৈতিকভাবে এ ধরনের যেকোনো পদক্ষেপ আগুনে ঘৃতাহুতির মতো কাজ করতে পারে। ইমরান খানের সরকারকে উৎখাতের ঘটনায় বিপুলসংখ্যক মানুষ অসন্তোষ প্রকাশ করেছে। তাঁকে গ্রেপ্তারের মতো পদক্ষেপ কেবল অনিশ্চয়তা ও অস্থিতিশীলতাকেই বাড়িয়ে তুলবে, যা ইতিমধ্যে পাকিস্তানকে অর্থনৈতিকভাবে অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে ফেলেছে।