ইমরানকে উৎখাত, সেনাবাহিনীর প্রভাব বলয়েই পাকিস্তান
পাকিস্তানে ২০২২ সালটা শুরু হয়েছিল অনেকগুলো খারাপ লক্ষণ দিয়ে। মাত্র কয়েক মাস আগে প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় ফিরেছে। এদিকে দেশে শুরু হয়েছে অর্থনৈতিক সংকট। এসব সংকট খুব দ্রুতই দেশটির সার্বিক পরিস্থিতির ওপর প্রভাব ফেলতে শুরু করে। বছরের শুরুতেই ঘটে সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা। বছরের শেষে এসে আফগান তালেবানের অনুগত তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানের (টিটিপি) সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা নিয়ে অনেকটা উদ্বেগে ইসলামাবাদ। দেশটির অর্থনীতিও ধুঁকছে। এ অঞ্চলের দেশ শ্রীলঙ্কার মতো পাকিস্তানের অর্থনীতিও ধসে পড়তে পারে বলে শঙ্কা করছেন অনেকেই। এসবের মধ্যেই দেশটিতে ভয়াবহ বন্যা শুরু হয়। প্লাবিত হয় অর্ধেক উর্বর ভূমি। তবে সব ছাপিয়ে বছরজুড়ে আলোচনার কেন্দ্রে ছিল প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইমরান খানকে উৎখাত এবং সেনাবাহিনীর রাজনীতিতে আধিপত্যের বিষয়টি।
ইমরান খানকে উৎখাত
পাকিস্তানের বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেট তারকা ইমরান খান ২০১৮ সালে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তখন বিরোধী দলসহ গণমাধ্যমে এ খবর চাউর ছিল যে সেনাবাহিনীর ‘আশীর্বাদ’ নিয়ে তিনি ক্ষমতায় এসেছেন। যদিও সে সময় সেনাবাহিনী ও ইমরান খান এ অভিযোগ অস্বীকার করেন। তবে ধীরে ধীরে নানা বিষয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইমরান খানের সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে ইমরানকে ক্ষমতাচ্যুত করতে একাট্টা হয় বিরোধীরা।
এক দিকে অর্থনৈতিক সংকট, অন্য দিকে ক্ষমতাশালী সেনাবাহিনীর সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি—দুইয়ে মিলে ইমরানের ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার সব পথ তৈরি ছিল। মার্চে এসে বিরোধীরা ইমরানের বিরুদ্ধে জাতীয় পরিষদে অনাস্থা ভোট আনে। এরপর ইমরান খান জাতীয় পরিষদ ভেঙে দিয়ে আগাম নির্বাচন দেওয়ার জন্য প্রেসিডেন্টকে চাপ দিতে শুরু করেন। এর মধ্য দিয়ে দেশটিতে সাংবিধানিক সংকট শুরু হয়। তবে শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অনাস্থা ভোটে হেরে ক্ষমতা থেকে অপসারিত হন ইমরান খান। একই জাতীয় পরিষদ ১১ এপ্রিল শাহবাজ শরিফকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করে।
ইমরান খানের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের ষড়যন্ত্রের শিকার তিনি। তাঁকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করতে ওয়াশিংটনের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। তবে সেনাবাহিনী ও যুক্তরাষ্ট্র এ অভিযোগ অস্বীকার করে। যদিও বিশ্লেষকেরা বলেন, পাকিস্তানে ক্ষমতায় থাকতে হলে ক্ষমতাশালী সামরিক বাহিনীর আশীর্বাদপুষ্ট হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। দেশটির ইতিহাস ঘাটলেও অবশ্য সেই প্রমাণ পাওয়া যায়। ১৯৪৭ সালে স্বাধীন হওয়ার পর থেকে পাকিস্তানের ৭৫ বছরের ইতিহাসে তিন দশকের বেশি সময় সরাসরি ক্ষমতায় ছিল সেনাবাহিনী। আর বাকি সময়টা বেসামরিক সরকার ক্ষমতায় থাকলেও সেনাবাহিনীর আধিপত্য ছিল। সেনাবাহিনীর সমর্থন ছাড়া কেউই টিকে থাকতে পারেনি। স্বাধীনতার পর পাকিস্তান এখন পর্যন্ত ৩০ জন প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে। কোনো প্রধানমন্ত্রী পূর্ণ অর্থাৎ, পাঁচ বছর মেয়াদে ক্ষমতায় ছিলেন না। ইমরানের ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয়নি।
ক্ষমতা থেকে অপসারিত হয়েও অবশ্য দমে যাননি ইমরান খান। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরপরই আগাম নির্বাচনের দাবিতে সরব হন তিনি। দেশজুড়ে বিক্ষোভ-আন্দোলন শুরু করেন। তাঁর সমর্থনে বহু মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। রাজধানী ইসলামাবাদ অভিমুখে দলবল নিয়ে লংমার্চও শুরু করেন তিনি। শাহবাজ শরিফের সরকার এতে কিছুটা চাপে পড়লেও স্পষ্ট জানিয়ে দেয় যে ২০২৩ সালের অক্টোবরে নির্ধারিত সময়েই নির্বাচন হবে। সরকার দৃঢ় এ অবস্থান জানানোর পর ইমরান আবার দলীয় নেতা-কর্মী-সমর্থকদের নিয়ে মাঠে নেমে পড়েন। নির্বাচনের দাবিতে সোচ্চার হন। এর মধ্যে গত ৬ নভেম্বরে এক জনসমাবেশে তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি করার ঘটনা ঘটে। ইমরান খান ও তাঁর দল পিটিআইয়ের দাবি, সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে হত্যা করতেই তাঁকে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়। ইমরান খান এমন দাবিও করেছেন, তাঁকে হত্যার এই চেষ্টায় সেনাবাহিনীও জড়িত ছিল।
সেনাবাহিনীর প্রভাব
বিশ্লেষকদের কারও কারও মতে, পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্রনীতি সরকারের হাতে নয়, বরং দেশটির সেনাবাহিনীর মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হয়। এমন গুঞ্জনও আছে যে ইমরান খান ওয়াশিংটনের পাশ থেকে সরে এসে বেইজিংয়ের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়েছিলেন। এটা সেনাবাহিনী মানতে পারেনি। সেনাবাহিনী সব সময় চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা ভারসাম্য রাখতে চায়। এ জন্য ইমরানের চীনঘেঁষা নীতি তাদের পছন্দ হয়নি। এ জন্য সেনাপ্রধান কামার জাভেদ বাজওয়ার সঙ্গে ইমরানের মতপার্থক্য দেখা দেয়। এর জেরে সেনাবাহিনী ইমরান খানকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর সরাসরি জড়িয়ে পড়া নিয়ে চলমান এসব সংকটের মধ্যে সেনাবাহিনীতে বড় পরিবর্তনের সময় আসে। দুই মেয়াদে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পালন করা জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়ার অবসরের সময় ঘনিয়ে এলে নতুন সেনাপ্রধান কে হতে যাচ্ছেন, সেটা নিয়ে শুরু হয় জল্পনা। গত ২৯ নভেম্বর বাজওয়া অবসরে যাওয়ার আগেই প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বাজওয়ার ‘অনুসারী’ হিসেবে পরিচিত সাবেক গোয়েন্দাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরকে সেনাপ্রধান নিয়োগ করেন।
আসিম মুনির সম্পর্কে খুবই কম জানা যায়। তবে তাঁকে বাজওয়ার ঘনিষ্ঠ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনিও তাঁর পূর্বসূরির মতো ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে চান। একই সঙ্গে ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের সঙ্গে সমানভাবে ভালো সম্পর্ক রাখতে চান তিনি। এ জন্য ইমরানকে তাঁর পছন্দ নয়।
পাকিস্তানের রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর আধিপত্যের বিষয়টি ইঙ্গিতে হলেও স্বীকার করেছেন সাবেক সেনাপ্রধান বাজওয়া। অবসরে যাওয়ার কয়েক দিন আগে তিনি বলেন, সেনাবাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রকারন্তরে অর্থ দাঁড়ায়, এত দিন সেনাবাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করত।
শুধু বাজওয়া নন, রীতিমতো সংবাদ সম্মেলন করে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইপ্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল নাদিম আনজুম ইমরান খানের সমালোচনার জবাব দিয়েছেন। সাধারণত আইএসআইপ্রধানের প্রকাশ্যে এ ধরনের মন্তব্যের ঘটনা তেমন একটা দেখা যায় না। জেনারেল নাদিম ইমরানের দাবিকে অগ্রাহ্য করেননি, উল্টো বলেছেন, ক্ষমতায় থাকার জন্য বেআইনিভাবে সেনাবাহিনীর সাহায্য চেয়েছিলেন ইমরান খান। তিনি বলেছেন, সামরিক বাহিনী ইমরানের অসাংবিধানিক পন্থায় চাওয়া সাহায্যের বিষয়ে সাড়া না দেওয়ায় তিনি সেনাবাহিনীকে আক্রমণ করছেন।
আইএসআইপ্রধানও রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের বিষয়টি নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, অতীতে (রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে) সেনাবাহিনী ভুল করেছে। তবে সম্প্রতি সামরিক বাহিনী প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে তারা আর হস্তক্ষেপ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার কথাতেও রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপের বিষয়টি স্পষ্ট।
অক্টোবরের শেষে ওই সংবাদ সম্মেলনে জেনারেল আনজুম বলেন, উত্তেজনা নিরসনে সম্প্রতি ইমরান খান ও সেনাপ্রধান জেনারেল কামার জাভেদ বাজওয়া বৈঠক করেছেন। গোয়েন্দাপ্রধান আনজুম দাবি করেন, ইমরান খান রাতের আঁধারে সামরিক নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক করে সাহায্য চান এবং পরদিন একই ব্যক্তিদের নামে নানা কথা বলে বেড়ান।
জেনারেল আনজুম আরও বলেন, মার্চ মাসে যখন ইমরান খানের সরকারের ওপর বিরোধীদের চাপ বাড়ছিল, তখন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বাজওয়াকে আজীবন সেনাপ্রধান করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। ইমরান ও তাঁর দলের নেতারা এ বিষয়ে কোনো জবাব দেননি।
নজিরবিহীনভাবে আইএসআইপ্রধান কেন প্রকাশ্যে এসব কথা বলেছেন, ওই দিনই এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেনাবাহিনীর মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট জেনারেল বাবর ইফতিখার। তিনি সংবাদ সম্মেলনে আইএসআইপ্রধানের পাশে বসে ছিলেন। জেনারেল ইফতেখার বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে দেশে নোংরা প্রচারণা চালানো হচ্ছে। এ কারণে আইএসআইপ্রধান বাধ্য হয়ে প্রকাশ্যে এসব সমালোচনার জবাব দিতে এসেছেন।
তবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, সেনাবাহিনীর রাজনীতি থেকে দূরে থাকার সিদ্ধান্তের বিষয়ে তাঁরা সন্দিহান। তাঁদের মতে, রাজনীতিতে সেনাবাহিনীর প্রভাব থাকবেই। এখন নতুন সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের কাজ হবে অপ্রয়োজনে প্রকাশ্য না হয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইমরান খানের সম্পর্কের এই উত্তেজনা কমিয়ে একটি ‘হাইব্রিড’ সরকার পরিচালনা করা। নতুন সেনাপ্রধানের এখন প্রধান দুটি কাজ হচ্ছে, প্রথমত ইমরান খানের প্রচারণার কারণে সেনাবাহিনীর ওপর জনগণের যে আস্থা কমে গেছে, সেটা ফিরিয়ে আনা। দ্বিতীয়ত, ইমরানের সঙ্গে সেনাবাহিনীর চলমান দ্বন্দ্ব কমিয়ে সহনীয় মাত্রায় নিয়ে আসা। এতে করে পাকিস্তানের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের সম্পর্কের উন্নতি হবে এবং একই সঙ্গে সেনাবাহিনীও এ কথা বলতে পারবে যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরানোর জন্য তারা চেষ্টা চালাচ্ছে।
সামনে কী
তবে আসিম মুনিরের জন্য কাজটা সহজ হবে না। কারণ, ইমরান খানের প্রচারণার কারণে সেনাবাহিনীর জনপ্রিয়তা অনেক কমে গেছে। এদিকে ইমরানের দল পিটিআইও শক্তিশালী বিরোধী দল। ক্ষমতাসীন পিএমএল-এন জোটকে সহজে ছাড় দেবেন না ইমরান। এ ছাড়া ইমরানের সঙ্গে নতুন সেনাপ্রধানের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের একটি বিষয়ও রয়েছে। বাজওয়ার পরামর্শেই ২০১৮ সালে আসিম মুনিরকে প্রভাবশালী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের প্রধান নিয়োগ দেন ইমরান খান। তবে মাত্র আট মাসের মাথায় ওই পদ থেকে সরে যেতে হয়েছিল তাঁকে। কারণ, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান তাঁকে এ পদে আর দেখতে চাননি।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বর্তমানে সেনাপ্রধান আসিম মুনিরের বিষয়ে ইমরান সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। তবে ইমরান-সৃষ্ট নানা পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে তাঁকে। আর পরবর্তী নির্বাচনে যদি ইমরান আবার প্রধানমন্ত্রী হন, তাহলে তিনি নতুন সেনাপ্রধান নিয়োগের ক্ষমতা পাবেন। সে ক্ষেত্রে আসিম মুনিরকে সেনাপ্রধানের দায়িত্ব থেকে সরিয়েও দিতে পারেন।
আসিম মুনিরের সামনে আরেকটি চ্যালেঞ্জ হতে পারে দিন দিন বাড়তে থাকা ইমরানের জনপ্রিয়তা। নানা অভিযোগ সত্ত্বেও ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ইমরানের জনপ্রিয়তা বাড়ছে। তাঁকে উৎখাত করতে সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ এবং তাঁকে হত্যার জন্য গুলির ঘটনায় ইমরান খানের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। এমন এক ঘোলাটে পরিস্থিতিতে জেনারেল আসিমের নানা পদক্ষেপ সাধারণ মানুষের, বিশেষ করে ইমরান খানের দল পিটিআই সমর্থকদের অসন্তোষের মুখে পড়তে পারে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞদের অনেকে।
তথ্যসূত্র: বিবিসি, রয়টার্স, এএফপি, দ্য ডন