চকলেট চুরির অভিযোগে ১৩ বছরের গৃহকর্মীকে হত্যা

গৃহকর্মীপ্রতীকী ছবি

বাড়ির ১৩ বছরের গৃহকর্মী ইকরা। সারা গায়ে আঘাতের চিহ্ন। এসব আঘাত নিয়ে হাসপাতালে গত বুধবার মারা যায় শিশুটি। পুলিশ প্রাথমিক তদন্তে জানতে পেরেছে, শিশুটি চকলেট চুরি করেছিল অভিযোগ তুলে তাকে মারধর করা হয়। এরই মধ্যে এই গৃহকর্ত্রী ও গৃহকর্তাকে পুলিশ আটক করেছে।

ঘটনাটি পাকিস্তানের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাওয়ালপিন্ডিতে। এ ঘটনায় শিশুশ্রম এবং গৃহকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি হয়েছে। এরই মধ্যে # জাস্টিসফরইকরা হ্যাশট্যাগ তৈরি করে পোস্ট দেওয়া হয়েছে। এসব পোস্ট এরই মধ্যে হাজার হাজার মানুষ দেখেছে।

ইকরার বাবা সানা উল্লাহ বিবিসিকে বলেন, মেয়ের মৃত্যুতে তিনি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছেন। তিনি জানান, গত বুধবার তিনি পুলিশের কাছ থেকে কল পেয়ে হাসপাতালে ছুটে আসেন। এসে দেখেন মেয়ে অচেতন হয়ে পড়ে আছে। এর কয়েক মিনিট পরেই সে মারা যায়।

আট বছর বয়স থেকে ইকরা অন্যের বাড়িতে কাজ করে। তার বাবা ৪৫ বছর বয়সী একজন কৃষক। ঋণের জালে জর্জরিত এই বাবা সংসারের ভার টানতে না পেরে মেয়েকে কাজে দেন।

বেশ কয়েকজনের বাড়িতে কাজ করার পর এই দম্পতির বাড়িতে কাজে যায় দুই বছর আগে। এখানে ইকরা কাজ করে মাসে প্রায় আট হাজার পাকিস্তানি রুপি (প্রায় সাড়ে তিন হাজার টাকা) বেতন পেত। এই দম্পতির আট সন্তান রয়েছে।

পুলিশ জানায়, ইকরার বিরুদ্ধে অভিযোগ, সে ঘর থেকে চকলেট চুরি করেছে। প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে ইকরাকে নির্যাতন করা হয়েছে। প্রায়ই তাকে নির্যাতন করা হতো, এর প্রমাণও পুলিশ পেয়েছে।

বিবিসি তাদের হাতে আসা কিছু ছবি ও ভিডিওতে দেখতে পেয়েছে শিশুটির পা ও হাতের বিভিন্ন জায়গা ভেঙে গেছে, এমনকি তার মাথায়ও গুরুতর আঘাত আছে। ময়নাতদন্তের প্রতিবেদন পেলে প্রকৃত কারণ জানা যাবে। পুলিশ বিবিসিকে জানায়, তারা চূড়ান্ত মেডিকেল প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা করছে।

এ ঘটনার বিষয়ে অধিকারকর্মী শেহর বানু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে লিখেছেন, ‘আমার হৃদয়ে রক্তের অশ্রু ঝরছে। আর কত ...অন্যের বাড়িতে কাজ করতে গিয়ে সহিংসতার শিকার হবে? গরিবেরা আর কত তাদের মেয়েদের এভাবে কবরে পাঠাবে?’

পাকিস্তানের আরেকজন লিখেছেন, চকলেটের জন্য তাকে মেরে ফেলল? আরেকজন লিখেছেন, ‘এটি শুধু অপরাধ নয়, এটি একটি ব্যবস্থার প্রতিফলন, যে ধনীরা গরিবদের যেমন খুশি তেমনভাবে ব্যবহার করতে পারে।’

ইকরা যে বাসায় কাজ করত সেই গৃহকর্তা রশিদ শাফিক ও তাঁর স্ত্রী সানা আট সন্তানের মা–বাবা। পুলিশ এই দম্পতির পাশাপাশি ওই পরিবারের শিশুদের পারিবারিক ধর্মীয় শিক্ষককেও আটক করা হয়েছে। ওই শিক্ষকই ইকরাকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন এবং হাসপাতাল স্টাফকে বলেন শিশুটির বাবা নেই ও মা–ও কাছে থাকে না। এরপর তিনি হাসপাতাল থেকে চলে যান।

এ ধরনের ঘটনায় জনগণের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় আদালতের বাইরে বাদী-বিবাদীর মধ্যে বিষয়টি ফয়সালা হয়ে যায়। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে বিচার হওয়ার ঘটনা খুবই বিরল।

২০১৮ সালে ১০ বছরের এক শিশু গৃহকর্মীকে নির্যাতনের দায়ে এক বিচারক ও তাঁর স্ত্রীর তিন বছর করে কারাদণ্ড হয়। সে সময় এ ঘটনা বেশ আলোচিত ছিল। কিন্তু পরে দেখা যায় তাদের শাস্তি কমে এক বছর হয়।

পাকিস্তানি আইন অনুযায়ী বেশ কিছু গুরুতর অপরাধের ঘটনায় ভুক্তভোগী বা তাঁর পরিবারের সদস্যদের অভিযুক্তদের ক্ষমা করে দেওয়ার অধিকার রয়েছে। এর জন্য তাদের আদালতে হাজির হয়ে বলতে হয় ‘ আল্লাহর নামে’ তারা আসামিদের ক্ষমা করলেন।

আইনি পর্যবেক্ষকেরা বলেন, বাস্তবতা হলো, এই ‘ক্ষমাশীলতার’পেছনের প্রাথমিক কারণ থাকে আর্থিক। আর ভুক্তভোগীকে অর্থ দেওয়া অবৈধ নয়।

জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক তহবিলের (ইউনিসেফ) তথ্যমতে, পাকিস্তানে প্রায় ৩৩ লাখ শিশু শিশুশ্রমে যুক্ত। আর আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) অনুসারে, পাকিস্তানের ৮৫ লাখ গৃহকর্মীর বেশির ভাগই নারী ও কম বয়সী মেয়েরা।