‘পাকিস্তানের এক-তৃতীয়াংশ পানির নিচে’
ভয়াবহ বন্যায় বিপর্যস্ত পাকিস্তান। দেশটিতে ঐতিহাসিক বন্যায় এক-তৃতীয়াংশ এলাকা পানিতে সম্পূর্ণ তলিয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন দেশটির জলবায়ু মন্ত্রী। বিধ্বংসী আকস্মিক এ বন্যায় ভেসে গেছে রাস্তা, বাড়িঘর ও ফসল। ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে দেশটির বেলুচিস্তান, সিন্ধু, পাঞ্জাব (দক্ষিণ) ও খাইবার প্রদেশের বন্যাকবলিত লাখ লাখ মানুষ। এলাকার বাসিন্দারা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে বসতবাড়ি ছেড়ে যাচ্ছেন। এ বিপর্যয় সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে দেশটির সরকার। এ পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক সহায়তার জন্য হাত বাড়িয়েছে পাকিস্তান।
জলবায়ু মন্ত্রী শেরি রেহমান বলেন, এটি একটি বিশাল সমুদ্র। পানি সেচে ফেরার জন্য কোনো শুকনো জমি নেই। তিনি একে অকল্পনীয় সংকট বলে উল্লেখ করেছেন।
এ বছরের জুন মাসে পাকিস্তানে বর্ষা মৌসুম শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত এক হাজার ১৩৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। গত এক দশকের মধ্যে দেশটিতে এত ভারী বর্ষণ আর হয়নি। এ বিপর্যয়ের জন্য জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করছে দেশটির সরকার।
বার্তা সংস্থা এএফপিকে শেরি রেহমান বলেন, ‘আক্ষরিক অর্থে পাকিস্তানের এক-তৃতীয়াংশ এই মুহূর্তে পানির নিচে। অতীতের প্রতিটি সীমা, প্রতিটি রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে। আমরা এর আগে কখনো এ পরিস্থিতি দেখিনি।’
আমরা বছরের পর বছর কঠোর পরিশ্রম করে যে বাড়ি বানিয়েছি, তা আমাদের চোখের সামনে ডুবে যাচ্ছে। আমরা রাস্তার ধারে বসে আছি আর আমাদের স্বপ্ন ডুবে যেতে দেখছি।
গতকাল সোমবার পাকিস্তানের কর্মকর্তারা বলেন, বন্যার কারণে গত ২৪ ঘণ্টায় ৭৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। মৃত্যুর ঘটনা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো-জারদারি বলেছেন, ‘নিহতদের এক-তৃতীয়াংশ শিশু বলে ধারণা করা হচ্ছে। আমরা এখনো ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয়ে চেষ্টা করছি।’
কর্মকর্তারা ধারণা করছে, তিন কোটি ৩০ লাখের বেশি পাকিস্তানি নাগরিক ঐতিহাসিক এ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। দেশটির উত্তরাঞ্চলে সোয়াত উপত্যকায় বন্যায় ব্রিজ ও রাস্তা ভেসে গেছে। পুরো গ্রামগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। পাহাড়ি এলাকায় বসবাসকারী হাজার হাজার মানুষকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে হেলিকপ্টারের সাহায্য নিয়েও কর্তৃপক্ষ এখনো আটকে পড়া লোকজনের কাছে পৌঁছাতে হিমশিম খাচ্ছে।
গত রোববার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ বলেন, গ্রামের পর গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। লাখো ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়েছে। অনেকে অস্থায়ী আশ্রয়শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন। দেশটিতে ৩ কোটি ৩০ লাখ মানুষ বন্যাকবলিত। দেশের মোট জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ বন্যাকবলিত। ২০১০-১১ সালের বন্যার সঙ্গে এ বন্যার তুলনা করা যায়।
সিন্ধু এবং বেলুচিস্তানের মতো প্রদেশগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে খাইবার পাখতুনখাওয়া পার্বত্য অঞ্চলগুলোর অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। সরকারি কর্মকর্তারা বন্যার জন্য জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করলেও অনেকেই বন্যায় এত ক্ষয়ক্ষতির কারণ হিসেবে স্থানীয় প্রশাসনের অব্যবস্থাপনাকেও দায়ী করছেন।
অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যয়ের মুখে থাকা পাকিস্তানের জন্য এ বন্যার ক্ষতি থেকে বেরিয়ে আসা নিয়েও উদ্বেগ বাড়ছে। ইতিমধ্যে দেশটির সরকারের পক্ষ থেকে সাহায্য সংস্থা, বন্ধুত্বপূর্ণ দেশ এবং আন্তর্জাতিক দাতাদের কাছ থেকে আর্থিক সাহায্যের জন্য আবেদন করা হয়েছে। দেশটির সরকারি কর্মকর্তারা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও অন্য দেশগুলো সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে। তবে আরও তহবিল প্রয়োজন।
পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা সালমান সুফি বলেন, ‘পাকিস্তানের জন ৵ আন্তর্জাতিক সহায়তা জরুরি হয়ে পড়েছে। পাকিস্তান অর্থনৈতিক সমস্যার মুখে রয়েছে। কিন্তু যখন আমরা তা কাটিয়ে উঠতে যাচ্ছিলাম, তখন মৌসুমি বিপর্যয় আঘাত হেনেছে।’
সুফি আরও বলেন, সরকারের অনেক উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থায়ন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের দেওয়া হচ্ছে। পাকিস্তানের ডন পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ খাইবার পাখতুনখাওয়া অঞ্চলের বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য ১০ বিলিয়ন রুপি সহায়তার ঘোষণা দিয়েছেন। এ ঘোষণা অনুযায়ী, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি পরিবার ২৫ হাজার রুপি পাবে। এক সপ্তাহের মধ্যে এ সহায়তা দেওয়া হবে।
খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের কাগান ভ্যালির বাসিন্দা মুহাম্মদ ফরিদের মেয়ে বন্যায় ভেসে গেছে। তিনি বলেন, ‘মেয়েটি আমাকে বলে গেল ছাগলের জন্য ঘাস আনতে যাচ্ছে। কুনহার নদীর তীরে যাওয়ামাত্রই বন্যার পানির তোড়ে ভেসে গেল সে।’
জুনায়েদ খান (২৩) বলেন, ‘আমরা বছরের পর বছর কঠোর পরিশ্রম করে যে বাড়ি বানিয়েছি, তা আমাদের চোখের সামনে ডুবে যাচ্ছে। আমরা রাস্তার ধারে বসে আছি আর আমাদের স্বপ্ন ডুবে যেতে দেখছি।’ সিন্ধু প্রদেশও বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেখানে কয়েক হাজার মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা সুফি বিবিসিকে বলেন, পাকিস্তানে জরুরি ভিত্তিতে আন্তর্জাতিক সহায়তা প্রয়োজন। তিনি বলেন, পাকিস্তান এমনিতেই অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত। কিন্তু দেশটি যখন অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠছে, তখনই প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়েছে।
পাকিস্তানের জিও নিউজ জানায়, পাকিস্তানের প্রতি সহমর্মিতা জানিয়েছে অনেক দেশ। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো গত রোববার টুইটারে পাকিস্তানে ভয়াবহ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। পোপ ফ্রান্সিস আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পাকিস্তানকে সাহায্য করার আহ্বান জানিয়েছেন।