পাকিস্তানের কয়েকটি স্থান লক্ষ্য করে হামলা করেছে তালেবান বাহিনী। আফগানিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় গতকাল শনিবার এ কথা জানিয়েছে। আফগানিস্তানে পাকিস্তানের বিমান হামলার কয়েক দিন পরেই আফগানিস্তানের পক্ষ থেকে এ হামলার ঘটনা ঘটেছে।
আফগানিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় অবশ্য পাকিস্তানের নাম উল্লেখ করেনি। তবে আফগানিস্তানে সমন্বিত হামলা চালানো ও সমন্বয়কারীদের বিরুদ্ধে অনুমানিক লাইনের বাইরে বেশ কয়েকটি স্থানে হামলা চালানোর কথা উল্লেখ করেছে।
এর আগে গত বুধবার আফগান কর্তৃপক্ষ সতর্ক করে বলেছিল, তারা পাকিস্তানের বোমা হামলার জবাব দেবে।
বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, আফগানিস্তানের বাহিনীর সঙ্গে সীমান্তে গুলি বিনিময়ে পাকিস্তানের আধা সামরিক বাহিনীর এক সদস্য নিহত এবং সাতজন আহত হয়েছেন। গতকাল শনিবার একটি নিরাপত্তা সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
দুই দেশের কর্মকর্তারা বলেছেন, পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশ ও আফগানিস্তানের খোস্ত প্রদেশে সীমান্তরক্ষীদের মধ্যে শুক্রবার দিবাগত রাতভর লড়াই হয়েছে। এ সময় বিভিন্ন স্থানে ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
আফগানিস্তানের শাসকগোষ্ঠী তালেবান কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করেছে, পাকিস্তান গত সপ্তাহে যে বিমান হামলা চালিয়েছে, তাতে ৪৬ জন নিহত হয়েছে, যার অধিকাংশ নারী ও শিশু।
পাকিস্তানের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, সন্ত্রাসীদের গোপন আস্তানা লক্ষ্য করে ওই হামলা চালানো হয়। অবশ্য ইসলামাবাদের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আফগানিস্তানে বিমান হামলা চালানোর বিষয়টি স্বীকার করা হয়নি।
পাকিস্তান সীমান্তের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, ‘একজন সেনা নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আরও সাতজন নিহত হয়েছেন।’ তিনি আরও বলেন, পাকিস্তানের কুররম সীমান্ত জেলার দুটি স্থানে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
আফগানিস্তানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে জানিয়েছে, পাকিস্তানের সঙ্গে সীমান্তে কয়েকটি স্থানে লড়াই হয়েছে। এসব স্থানে সংগঠিত হামলা করা হয়েছিল। এর পাল্টা জবাব দেওয়া হয়েছে।
খোস্তের এক প্রাদেশিক কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, গতকাল শনিবার ভোরে সংঘর্ষ শুরু হলে ওই এলাকা থেকে অনেক বাসিন্দা পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এ সংঘর্ষে আফগানিস্তানের সেনাদের কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।
২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ন্যাটো জোটের সেনারা আফগানিস্তান ছাড়লে রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে তালেবান। এর পর থেকে দুই প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে সম্পর্কে টানাপোড়েন বেড়েছে। তালেবানের একটি অংশ পাকিস্তানেও তৎপর। সশস্ত্র এ গোষ্ঠীর নাম তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)। পাকিস্তানের অভিযোগ, টিটিপিকে আফগানিস্তানে আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিচ্ছে তালেবান। গতকালের এ সংঘর্ষ দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা বেড়ে যাওয়ার সর্বশেষ ঘটনা।
ইসলামাবাদের পক্ষ থেকে কাবুল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে জঙ্গিদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ আনা হচ্ছে। পাকিস্তানের অভিযোগ, আফগানিস্তানের তালেবান কর্তৃপক্ষ জঙ্গিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে। জঙ্গিদের পাকিস্তানের ভূখণ্ডে হামলা চালানোর সুযোগ দিচ্ছে। তবে ইসলামাবাদের এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে কাবুলেন তালেবান সরকার।
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী গত মার্চ মাসে আফগানিস্তানের সীমান্ত অঞ্চলে মারাত্মক বিমান হামলা চালানোর পর সীমান্তে সংঘর্ষ বাড়তে থাকে। তালেবান কর্তৃপক্ষ দাবি করে, ওই হামলায় অন্তত আটজন নিহত হন।
এর আগেও পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আফগানিস্তানে হামলার ঘটনা ঘটেছে। তবে বিষয়টি এত দিন কোনো জ্যেষ্ঠ পাকিস্তানি কর্মকর্তা স্বীকার করেননি। গত মার্চে শুধু পাকিস্তানি কর্মকর্তারা আফগানিস্তানে একটি হামলার কথা স্বীকার করেন। আফগানিস্তানে এসব হামলার ঘটনার তীব্র নিন্দা ও সমালোচনা করে আসছে তালেবান সরকার। আফগান কর্মকর্তারা এসব হামলাকে দেশটির সার্বভৌমত্বের চরম লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছিলেন।
আফগানিস্তানে জাতিসংঘের সহযোগিতা মিশন (ইউএনএএমএ) পাকিস্তানের হামলায় বেসামরিক লোকজন নিহত হওয়ার ঘটনা তদন্তের দাবি করেছে। জাতিসংঘের শিশু সংস্থা ইউনিসেফ বলেছে, শিশুদের কখনোই লক্ষ্যবস্তু করা ঠিক নয়। ইউনিসেফের আঞ্চলিক পরিচালক এক্সে ওয়াজিসেকারা বলেন, ‘আফগানিস্তানের পূর্ব সীমান্তে হামলায় কমপক্ষে ২০ শিশু নিহত হওয়ার ঘটনা শুনে ইউনিসেফ অত্যন্ত মর্মাহত।’
এর আগে ২০ ডিসেম্বর পাকিস্তানের আফগান সীমান্তবর্তী একটি তল্লাশিচৌকিতে সশস্ত্র ব্যক্তিদের হামলায় পাকিস্তানের ১৬ সেনাসদস্য নিহত হন। এ ঘটনায় গুরুতর আহত হন আরও পাঁচজন। খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের মাকিন এলাকার একটি সেনা তল্লাশিচৌকিতে ওই হামলায় ৩০ জনের বেশি অংশ নেন। এ হামলা চালায় তেহরিক–ই–তালেবান (টিটিপি) নামের একটি জঙ্গিগোষ্ঠী। এ গোষ্ঠীর সঙ্গে আফগানিস্তানের টিটিপির আদর্শগত মিল রয়েছে।
গত শুক্রবার পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বলেন, ‘আমরা কাবুলের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক রাখতে চাই। কিন্তু টিটিপিকে আমাদের নিরপরাধ মানুষজনকে হত্যা করা ঠেকাতে হবে। এটাই আমাদের চূড়ান্ত সীমা।’
আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকে দেশটির পশ্চিম সীমান্তে জঙ্গি সহিংসতা বেড়ে গেছে। এ বছরেই বিভিন্ন সংঘাতে পাকিস্তানের ৩৮৩ সেনা ও ৯২৫ জঙ্গি নিহত হয়েছে।