ফিলিস্তিনিদের কি রক্ত ঝরার শেষ নেই
উপুড় হয়ে পড়ে আছেন একজন নারী। নিথর শরীর। পরনে জ্যাকেট। তাতে লেখা ‘প্রেস’। বলছি আল-জাজিরার সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহের কথা। গত মে মাসে ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সেনাদের গুলি শরীরে লাগার পর এভাবেই পড়ে ছিলেন তিনি। তাঁকে আর বাঁচানো যায়নি।
শুধু শিরিন আকলেহই নন। দশকের পর দশক ধরে ইসরায়েলি দখলদারদের শিকার হচ্ছেন আপামর ফিলিস্তিনি নারী–পুরুষ। মাস ফুরায়, বছর গড়ায়, তবু বদল আসে না তাঁদের জীবনে। ২০২২ সালটাও ফিলিস্তিনিদের জন্য আলাদা ছিল না। ইসরায়েলের দখলদারি, অভিযান আর নৃশংসতায় এ বছরটিও ছিল তাঁদের কাছে দুঃস্বপ্নের মতো।
২০০৬ সালের পর বিদায় নিতে যাওয়া বছরটিই পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের জন্য সবচেয়ে ভয়াবহ ও দুঃস্বপ্নের ছিল বলে উল্লেখ করেছে জাতিসংঘ। কেন বছরটিকে ভয়াবহ বলা হচ্ছে, কী ঘটেছে বছরজুড়ে চলুন দেখে নেওয়া যাক একনজরে।
গত মার্চে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ফিলিস্তিন থেকে বেশ কয়েকটি ছোট হামলা চালানো হয়। ওই হামলায় কয়েকজন ইসরায়েলি নিহত হন। এই সুযোগে পশ্চিম তীরে ‘ব্রেক দ্য ওয়েভ’ নামে একটি সামরিক অভিযান শুরু করে ইসরায়েল। অভিযানে প্রায় প্রতিদিনই পশ্চিম তীর, বিশেষ করে জেনিন ও নাবলুসে হানা দেন ইসরায়েলি সেনারা।
আবার রক্তাক্ত গাজা
আগস্ট মাস। মাত্র ১৫ মাস আগে দফায় দফায় বোমা ফেলে গাজা উপত্যকা তছনছ করে দেওয়ার স্মৃতি তখনো ভোলেননি ফিলিস্তিনিরা। এরই মধ্যে আগস্টে আবার উপত্যকাটিতে বোমা হামলা শুরু করে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানগুলো। ওই হামলায় অন্তত ৪৯ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন। তাদের মধ্যে ছিল ১৭ শিশু।
গাজায় ওই হামলার সূত্রপাত ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র গোষ্ঠী প্যালেস্টাইন ইসলামিক জিহাদের (পিআইজে) এক নেতাকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে। পশ্চিম তীর থেকে এই নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা। মনে হচ্ছিল, এই বুঝি বেধে যাবে ইসরায়েল–পিআইজের সংঘাত। এমন পরিস্থিতিতে গাজা সীমান্তে সামরিক শক্তি জোরদার করে ইসরায়েল।
পরে ৫ আগস্ট গাজায় একের পর এক বোমা হামলা চালায় ইসরায়েলের যুদ্ধবিমান। সাধারণ ফিলিস্তিনিদের পাশাপাশি নিহত হন পিআইজের কয়েকজন নেতা। পাল্টা জবাবে পিআইজে ইসরায়েলে রকেট ছোড়ে। ধারণা করা হচ্ছিল, এই লড়াই দীর্ঘ সময় ধরে চলবে। তবে মিসরের মধ্যস্থতায় অস্ত্রবিরতিতে রাজি হয় দুই পক্ষ। শেষ পর্যন্ত তিন দিন পর থামে সংঘাত।
আগস্ট মাস। মাত্র ১৫ মাস আগে দফায় দফায় বোমা ফেলে গাজা উপত্যকা তছনছ করে দেওয়ার স্মৃতি তখনো ভোলেননি ফিলিস্তিনিরা। এরই মধ্যে আগস্টে আবার উপত্যকাটিতে বোমা হামলা শুরু করে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানগুলো। ওই হামলায় অন্তত ৪৯ জন ফিলিস্তিনি নিহত হন। তাদের মধ্যে ছিল ১৭ শিশু।
লড়াই থামার আরেকটি কারণ ছিল ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক দল হামাস। ১৫ বছর ধরে তারা গাজা শাসন করছে। তবে পিআইজে ও ইসরায়েলের লড়াইয়ে নিজেদের জড়ায়নি সংগঠনটি; যদিও পিআইজের চেয়ে অনেক সংগঠিত তারা। সামরিক শক্তিও তাদের বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, ইসরায়েলের সঙ্গে পিআইজের লড়াইয়ে হামাস নাম লেখালে সংঘাত চলত বহুদিন ধরে।
তবে আগস্টের সংঘাত যত দ্রুতই শেষ হোক না কেন, গাজার ক্ষয়ক্ষতি কম হয়নি। কারণ, আগের বছর ইসরায়েলের ১১ দিনের হামলার ক্ষত তখনো শুকায়নি এ উপত্যকার বাসিন্দাদের। সঙ্গে ছিল, তাঁদের ওপর মানসিক চাপ। এই মানুষগুলো এখন সব সময় দুশ্চিন্তায় থাকেন, কখন আবার ভেসে আসে বোমার বিকট শব্দ, তা ভেবে।
সশস্ত্র সংগঠনের আত্মপ্রকাশ
ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে ২০২২ সালে বড় একটি পরিবর্তন এসেছে। সেটি হলো জেনিন ও নাবলুস শহরে ছোট বিভিন্ন সশস্ত্র স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠীর আত্মপ্রকাশ।
গোষ্ঠীগুলো অবশ্য ২০২১ সালেই জেগে উঠতে শুরু করেছিল। সে বছরের জুনে জেনিন শহরের শরণার্থীশিবিরে জামিল আল–আমোরি নামের এক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করে ইসরায়েল। এর জের ধরে সে বছরের সেপ্টেম্বরে আত্মপ্রকাশ করে সশস্ত্র গোষ্ঠী জেনিন ব্রিগেডস। জামিল গোষ্ঠীটির একজন যোদ্ধা ছিলেন।
পরে ২০২২ সালে এসে নাবলুস ব্রিগেডস, লায়ন্স ডেন, দ্য বালাতা ব্রিগেডস, দ্য তুবাস ব্রিগেডস ও ইয়াবাদ ব্রিগেড নামে আরও কয়েকটি সশস্ত্র গোষ্ঠী সামনে আসে।
গোষ্ঠীগুলো ফিলিস্তিনের নির্দিষ্ট কোনো দল বা আন্দোলনের সঙ্গে নিজেদের জড়ায়নি। তাদের মূল লক্ষ্য, ইসরায়েলি সেনাদের ওপর ছোটখাটো হামলা পরিচালনা। ইসরায়েলি বাহিনীর বিভিন্ন তল্লাশিচৌকিতেও হামলা চালিয়েছে তারা। এসব হামলায় কখনো কখনো ইসরায়েলি সেনারা নিহত হয়েছেন। গোষ্ঠীগুলো তার দায়ও নিয়েছে।
২০০০ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত ফিলিস্তিনের দ্বিতীয় ইন্তিফাদার (গণ-অভ্যুত্থান) পর প্রথমবারের মতো এ গোষ্ঠীগুলো আত্মপ্রকাশ করল। দ্বিতীয় ইন্তিফাদা চলাকালে একই ধরনের সশস্ত্র গোষ্ঠী পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সেনাদের বিরুদ্ধে লড়েছিল। ওই ইন্তিফাদা শেষে তাদের বেশির ভাগ অস্ত্র ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) অধীনে চলে যায়।
প্রতিদিন হানা, প্রতিদিন হত্যা
গত মার্চে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ফিলিস্তিন থেকে বেশ কয়েকটি ছোট হামলা চালানো হয়। ওই হামলায় কয়েকজন ইসরায়েলি নিহত হন। এই সুযোগে পশ্চিম তীরে ‘ব্রেক দ্য ওয়েভ’ নামে একটি সামরিক অভিযান শুরু করে ইসরায়েল। অভিযানে প্রায় প্রতিদিনই পশ্চিম তীর, বিশেষ করে জেনিন ও নাবলুসে হানা দেন ইসরায়েলি সেনারা। গ্রেপ্তার করা হয় গণহারে ফিলিস্তিনিদের। ঘটেছে সেনাদের হাতে হত্যার ঘটনাও।
ইসরায়েলের এই অভিযানের শিকার হয়েছেন ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের পাশাপাশি বেসামরিক লোকজন। ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া হিসাব বলছে, ২০২২ সালে পশ্চিম তীর ও দখল করা পূর্ব জেরুজালেমে অন্তত ১৭০ ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েল বাহিনী। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৩০টির বেশি ছিল শিশু। আর এ সময়ে ইসরায়েলের হামলায় আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৯ হাজার ফিলিস্তিনি।
একের পর এক হত্যাকাণ্ডে এখন চরম ক্ষুব্ধ ফিলিস্তিনিরা। ১২ ডিসেম্বরেই এমন একটি হত্যাকাণ্ড ঘটে। সেদিন জেনিনে একটি ভবনের ছাদ থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর অভিযান দেখছিল ১৬ বছর বয়সী এক কিশোর। তাকে গুলি করে হত্যা করেন সেনারা। এর আগে ২ ডিসেম্বর ২৩ বছর বয়সী এক ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ইন্টারনেটে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল।
বিদায়ী বছরে পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর কর্মকাণ্ডে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন অনেক পর্যবেক্ষক, কূটনীতিক ও মানবাধিকার সংস্থা। ইসরায়েলের সেনাদের নিয়ে এর আগেও কথা তুলেছিল জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিএইচআর। তাদের অভিযোগ, ইসরায়েলের সেনারা নিছক সন্দেহের বশে বা সতর্কতার জন্য ফিলিস্তিনিদের ওপর আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করেন। এটা আন্তর্জাতিক নীতিমালার লঙ্ঘন।
শিরিন আবু আকলেহকে হত্যা
গত ১১ মে জেনিনের শরণার্থীশিবিরে ইসরায়েলি সেনাদের অভিযানের খবর সংগ্রহ করছিলেন আল–জাজিরার সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহ। সেদিন তিনি ইসরায়েলি বাহিনীর গুলিতে নিহত হন। ৫১ বছর বয়সী শিরিন আকলেহ ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের দখলদারি নিয়ে খবর সংগ্রহ করেছেন। তাঁর মৃত্যু আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়।
শিরিন আকলেহকে সম্মান জানাতে তাঁর মরদেহবাহী কফিন নিয়ে জেনিন থেকে জেরুজালেমে শবযাত্রার আয়োজন করা হয়। তিন দিনব্যাপী ওই শবযাত্রা পূর্ব জেরুজালেমে পৌঁছালে সেখানে হামলা চালায় ইসরায়েলি বাহিনী। তবে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের নানা অপচেষ্টার পরও জেরুজালেমে শিরিনের শেষকৃত্যে অংশ নেন হাজার হাজার ফিলিস্তিনি।
শিরিন আকলেহকে যে ইসরায়েলি সেনারাই হত্যা করেছেন, সেটি একাধিক তদন্তে বেরিয়ে এসেছে। এমনকি গত সেপ্টেম্বরে ইসরায়েল স্বীকার করেছে, তাদের সেনাদের কেউ এই সাংবাদিককে গুলি করেছিলেন—এমন ‘সম্ভাবনা ব্যাপক’। তবে মুখে তারা যা–ই বলুক, ইসরায়েল সরকার আবু আকলেহকে হত্যায় কোনো তদন্ত শুরু করতে রাজি হয়নি।
ইসরায়েলে উগ্র ডানপন্থীদের উত্থান
২০২২ সালে, চার বছরেরও কম সময়ের মধ্যে ইসরায়েলে অনুষ্ঠিত হয়েছে পঞ্চম পার্লামেন্ট নির্বাচন। যে ফলাফল আসে তাতে দৃশ্যত মনে হয়, দেশটিতে একটি স্থিতিশীল সরকার প্রতিষ্ঠার দীর্ঘদিনের অক্ষমতার আপাত অবসান ঘটেছে। সেই সঙ্গে গঠিত হয়েছে দেশটির ৭৪ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে উগ্র ডানপন্থী সরকারের।
নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং তাঁর লিকুদ পার্টি কয়েকটি ইহুদিবাদী ও আল্ট্রাঅর্থোডক্স দলের সঙ্গে জোট করে। ১২০ জন সদস্যের পার্লামেন্ট নেসেটে তারা জেতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ৬৪টি আসন।
নির্বাচনী ফলাফলে তৃতীয় বড় জোট হিসেবে উত্থান ঘটেছে বেজালেল স্মটরিচের নেতৃত্বাধীন রিলিজাস জায়োনিস্ট পার্টি ও ইতামার বেন–গিভিরের নেতৃত্বাধীন জিউয়িস পাওয়ার পার্টির। এ দুই বিতর্কিত নেতা ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় অব্যাহতভাবে উসকানি দেওয়ার জন্য বেশ পরিচিত। পশ্চিম তীরে ইসরায়েলের অবৈধ ইহুদি বসতি আরও জোরেশোরে চালিয়ে নেওয়ার অভিপ্রায়ের কথা প্রকাশ্যে ঘোষণা করেছেন তাঁরা।
গত বছর স্মটরিচ বলেছিলেন, ‘ইসরায়েলে যেসব ফিলিস্তিনি রয়েছেন, তাঁরা ভুলক্রমে রয়ে গেছেন। কেননা, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেন গুরিয়ন (তাঁদের নির্মূল করার) কাজটি শেষ করতে পারেননি।’
ইতিমধ্যে, বেন–গিভির, আগে যিনি ‘ইসরায়েলের প্রতি অনুগত নন’ এমন ফিলিস্তিনিদের দেশটি থেকে বের করে দেওয়ার ডাক দিয়েছিলেন, তিনি অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের বন্দুক নিয়ে চলাফেরা করতে বলেছেন।
এ অবস্থায় রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, ইসরায়েলের নতুন সরকার ফিলিস্তিন নিয়ে চলমান উত্তেজনার আগুনে সামনের দিনগুলোতে ঘি ঢালতে পারে। সেই সঙ্গে অসহায় ফিলিস্তিনিদের ওপর দখলদার ইসরায়েলের জুলুম–নির্যাতন বাড়ার পাশাপাশি স্বামী হারানো নারী, বাবা–ভাই হারানো শিশুদের কান্না ভারি করতে তুলতে পারে ফিলিস্তিনের বাতাসকে।
আল–জাজিরা ও রয়টার্স অবলম্বনে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন মো. আবু হুরাইরাহ্ ও শেখ নিয়ামত উল্লাহ