যে ভূখণ্ডের নারী–শিশুসহ নিরপরাধ মানুষ হত্যার খবর বিশ্ববাসীর অনেকটা ‘গা-সওয়া’ হয়ে গেছে, সেটির নাম গাজা। বলা চলে, ভূখণ্ডটির বাসিন্দাদের লক্ষ৵ করে গুলি চালিয়ে হাত মকশো করেন ইসরায়েলি সেনারা, অবকাঠামোর দিকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে নিশানা পরখ করেন, বোমা ফাটিয়ে ধ্বংসযজ্ঞের বিস্তৃতি মাপতে শেখেন। কার্যত দুনিয়ার বৃহত্তম ছাদহীন এই জিন্দানখানায় ইসরায়েলি বাহিনীর ‘মারণ-মহড়া’র বিরাম নেই। হতাহতের খবরও তাই প্রায় প্রতিদিনের। সাড়ে সাত দশক ধরে ইহুদিবাদীদের গোলাগুলি, বোমা, রাসায়নিক অস্ত্রে বেঘোরে মরছেন ফিলিস্তিনিরা। উচ্ছেদ হচ্ছেন তাঁরা নিজভূমি থেকে। ফিলিস্তিনিদের আরেক আবাসস্থল পশ্চিম তীরও ইসরায়েলি খুনে বাহিনীর ‘মহড়াক্ষেত্র’।
মাত্র ৩৬৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের একচিলতে জায়গায় গুলি-গোলা-ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ফাঁক গলে কোনোমতে টিকে থাকা লাখ পনেরো গাজাবাসীর ওপর পর্বতসম চেপে আছে জায়নবাদী ইসরায়েলের সর্বাত্মক অবরোধ। তাদের লাগাতার হামলায় গাজার ৭০ শতাংশের বেশি মানুষ আজ বাস্তুচ্যুত। কংক্রিটের দানবাকৃতি দেয়াল দিয়ে ঘেরা গাজার চতুর্দিকেই হাজারো ইহুদি সেনার চৌপ্রহর সশস্ত্র প্রহরা। এর আসমানটি খোলা বটে, তবে সেখানে চন্দ্র–সূর্য–তারার চেয়ে ইসরায়েলের জঙ্গিবিমান, ক্ষেপণাস্ত্র, বোমার ঝাঁকের দেখাই বেশি পাওয়া যায়! অবরুদ্ধ জনপদটির বাতাসও ভরে গেছে রাসায়নিক হামলার মারণ-বিষে। সেই বিষ দেহে ধারণ করে জন্মাচ্ছে বিকলাঙ্গ–পঙ্গু শিশু। ‘ফিলিস্তিনি’— শুধু এই পরিচয়ের জন্য আর ১০ জনের মতো সেই শিশুদেরও স্বাভাবিক মৃত্যুর ভাগ্য নেই! এই মৃত্যু যখন-তখন; দিন–রাতের ভেদ তো নেই-ই, ধর্মীয় উৎসবের দিন, এমনকি প্রার্থনার সময়ও ট্রিগার টিপতে এতটুকু হাত কাঁপে না ইসরায়েলি যুদ্ধবাজ সেনাদের। তাই পবিত্র ঈদের দিনও প্রাণ হারান নিরীহ ফিলিস্তিনি, উৎসবরত শিশুর বেঘোর মৃত্যুর সাক্ষী হয় ‘বিবেকি’ বিশ্ব।
সাড়ে সাত দশকে আরবদের সঙ্গে চারবার যুদ্ধ জড়িয়েছে ইসরায়েল। এসব যুদ্ধে প্রাণ গেছে চার হাজারের বেশি মানুষের। সর্বশেষ গত বছর গাজায় ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায় ইসরায়েলি বাহিনী। জাতিসংঘের হিসাবে, ওই বছরের ১০ মে থেকে ২১ মে পর্যন্ত ইসরায়েলের সর্বাত্মক হামলায় প্রাণ গেছে ৬৭ শিশুসহ ২৪১ জনের। আহত প্রায় আড়াই হাজার। কিন্তু এই হিসাব ‘দাপ্তরিক’, বাস্তবে তা আরও অনেক বেশি। এ ছাড়া প্রায় প্রতিদিনই নানা ছুতোয় ফিলিস্তিনিদের ওপর চড়াও হন, প্রাণ কেড়ে নেন ইসরায়েলি সেনারা।
গুলিতে ঝাঁঝরা, বোমায় ছিন্নভিন্ন, আগুনে দগ্ধ, কংক্রিটের ধ্বংসস্তূপের চাপায় পিষে-থেঁতলে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের লাশের মিছিল তাই থামে না। বধ্যভূমি, মৃত্যুপুরী, জল্লাদের মঞ্চ—কোনো বিশেষণেই ফিলিস্তিনিদের ওপর চলমান গণহত্যা, নৃশংসতা–নিপীড়ন স্পষ্ট হয় না; কিছুতেই পাওয়া যায় না তাঁদের দুঃখ-দরিয়ার কিনারা!
ফিলিস্তিনিদের ভূমি–ভিটা জবরদখল, তাঁদের অন্যায্য বিতাড়ন আর অবৈধ ইহুদি বসতি স্থাপনের আনুপাতিক হারে ফিলিস্তিনির সংখ্যা কমানোর সব ইন্তেজাম পাকা ইসরায়েলের। ইঙ্গ-মার্কিন মহব্বত–মদতে ইসরায়েলের একতরফা আগ্রাসনক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে গাজা, পশ্চিম তীর তথা গোটা ফিলিস্তিন ভূমি। ফিলিস্তিনিদের বুকের পাঁজর গুঁড়িয়ে ইহুদিদের এই দখলবাজি চলছে বছরের পর বছর, দশকের পর দশক। তবু ‘সভ্যতার কাণ্ডারি’দের মুখে রা নেই; অবস্থাদৃষ্টে যে কারও মনে হতে পারে, চোখে বুঝি তাঁদের ঠুলি পরা, কান ঢাকা শব্দরোধী মাফলারে!
শুধু ফিলিস্তিনিদের দিকে বন্দুক তাক করেই নেই ইসরায়েলি সেনারা, ফিলিস্তিনের পক্ষ হয়ে ‘কথা বলা’ যে কাউকে হত্যা করতেও তাঁরা দ্বিতীয়বার ভাবেন না। দায়িত্ব পালনের সময় গত ১১ মে পশ্চিম তীরের জেনিন শহরে হত্যা করা হলো আল-জাজিরার সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহকে। ফিলিস্তিনের তথ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব বলছে, ২০০০ সাল থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে কমপক্ষে ৪৫ জন সাংবাদিকের প্রাণ গেছে। আর ফিলিস্তিনি সাংবাদিক ইউনিয়নের তথ্য অনুসারে, নিহত ব্যক্তির সংখ্যা আরও বেশি, ৫৫। বলা নিষ্প্রয়োজন, এর একটি ঘটনারও বিচার দেখেনি বিশ্ব।
ইসরায়েল এরই মধ্যে সদম্ভে জানিয়ে দিয়েছে, শিরিন হত্যার তদন্ত তারা করবে না।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের তদন্তে ইসরায়েলি বাহিনীর বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের ভূমি ও সম্পত্তি দখল, হত্যা, বেআইনিভাবে আটকে রেখে নির্যাতন, অবরোধ আরোপ, বাধ্যতামূলক স্থানান্তরের হাজারো প্রমাণ উঠে এসেছে। শিশু ও নারীসহ প্রায় সাড়ে চার হাজার ফিলিস্তিনিকে আটক করে রাখা হয়েছে ইসরায়েলের বিভিন্ন কারাগারে।
আন্তর্জাতিক আইনের তোয়াক্কা না করে অধিকৃত পশ্চিম তীরের ৭৯ শতাংশ স্থাপনা নিজেদের দখলে নিয়েছে ইসরায়েল। পূর্ব জেরুজালেমের ২০ শতাংশ স্থাপনা তাদের কবজায়। জাতিসংঘের মানবিক সহায়তা সমন্বয়বিষয়ক কার্যালয়ের (ওসিএইচএ) তথ্য অনুযায়ী, ২০০৯ সাল থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় ফিলিস্তিনি মালিকানাধীন অন্তত ৮ হাজার ৪১৩টি স্থাপনা ধ্বংস হয়েছে। এতে সর্বস্ব খুইয়ে পথে বসেছেন প্রায় সাড়ে ১২ হাজার ফিলিস্তিনি। বিপরীতে অধিকৃত পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেমে এ পর্যন্ত সাড়ে সাত লাখ ইহুদিকে বসতি গড়ে দিয়েছে ইসরায়েল সরকার।
যত দিস্তা দিস্তা কাগজে সভ্যতার বয়ান লেখা হয়েছে ফিলিস্তিনিদের নিরন্তর বঞ্চনা, করুণ মৃত্যু, তাঁদের ওপর জারি রাখা নিপীড়নের রক্তাক্ত ইতিকথা কি তার চেয়ে কম কাগজে কুলাবে? তেমনি ‘অশেষ’ তাঁদের ইন্তিফাদার দুর্ধর্ষ ইতিবৃত্তও। মরবে তবু পিছু হটবে না, এমন অদম্য জেদ ফিলিস্তিনি তরুণদের রক্তে মিশে আছে! ইহুদি সেনার উঁচিয়ে ধরা বন্দুকের সামনে তাই সটান দাঁড়িয়ে যান তাঁরা, কামানের গতি রুখে দিতে চান স্রেফ পাথরখণ্ড ছুড়ে। এই অনমনীয় প্রতিবাদ–প্রতিরোধ যত না শক্তি-সামর্থ্যের, তার শত-সহস্র গুণ বেশি আত্মিক-হার্দিক। হিস্যা বুঝে নেওয়ার, মর্যাদা প্রতিষ্ঠার, অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার, মাতৃভূমি রক্ষার লড়াইয়ে তাঁদের জান কোরবান!
ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা কি শুধু ফিলিস্তিনিদের আত্মিক, ন্যায্য ও আইনসংগত দাবির মধ্যেই সীমাবদ্ধ, নাকি তা আজ বিশ্বজনীন মানবমুক্তির প্রাণভোমরাও? পঙ্গু শিশুর বেড়ে ওঠার অধিকারও যখন ছিনিয়ে নেওয়া হয়, পাখি শিকারের উল্লাসে খুন করা হয় নিরস্ত্র–নিরীহ মানুষকে, তখন মুখ বুজে থাকলে বিবেকও কি নীরব থাকে? মানবতা তো কিতাবে ছাপা ধারণামাত্র নয়, ন্যায়ের পক্ষে না দাঁড়ালে মনুষত্ব বিলুপ্ত হতে বাধ্য হয়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন হলোকাস্টের নির্মমতাও যেন ছাপিয়ে গেছে ইসরায়েলের বর্বর কর্মকাণ্ডে; নাৎসিদের থেকেও অধিক জিঘাংসু হয়ে উঠেছে জায়নবাদীরা। তাদের একপেশে নির্বিচার হামলা, সর্বাত্মক অবরোধ–আগ্রাসনে অকাল আর অপঘাত মৃত্যু যেন ফিলিস্তিনিদের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৪৮ সালের ১৪ মে যে ‘নাকবা’ নেমে এসেছে ফিলিস্তিনি ভূমিতে, তার তাণ্ডবশক্তির নিচে মানবিকতার পদদলন আর কত দিন? আর কত দিনই বা তা ‘চুপচাপ’ চেয়ে চেয়ে দেখবে বাকি বিশ্ব? আর কত রক্তমূল্য পরিশোধে মানবমুক্তির পয়গাম পৌঁছাবে ফিলিস্তিনি ভূমিতে?