বিক্ষোভের মুখে পিছু হটলেন নেতানিয়াহু, সংকট কোথায়

বিচার বিভাগের সংস্কারে সরকার গৃহীত প্রস্তাবের প্রতিবাদে ইসরায়েলে চলছে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ
ছবি: রয়টার্স

ইসরায়েলের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীণ সংকটগুলোর একটি তৈরি হয়েছে। হাজার হাজার মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে চলছে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ। বিচার বিভাগের সংস্কার করার যে পরিকল্পনা সরকার করেছে, তার বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়েছে মানুষ। বিক্ষোভের মুখে সোমবার এ সংস্কার বিল পার্লামেন্টের আগামী অধিবেশন পর্যন্ত স্থগিত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। ইসরায়েলের চলমান এ সংকট নিয়ে সংক্ষেপে কিছু বিষয় এখানে তুলে ধরা হলো।

ইসরায়েলে কী চলছে

বিচার বিভাগের সংস্কার আনার যে পরিকল্পনা সরকার নিয়েছে, এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে এ বছরের শুরু থেকে প্রতি সপ্তাহে বড় বড় বিক্ষোভ শুরু করেন দেশটির জনগণ। ধীরে ধীরে বিক্ষোভের মাত্রা বাড়তে থাকে। বিক্ষোভ বড় বড় শহর থেকে ছোট শহরগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে। সবচেয়ে বড় বিক্ষোভগুলো হয় তেল আবিবে।

বিচার বিভাগে সংস্কার প্রস্তাবের নেপথ্য কারণ হিসেবে অনেকে দুর্নীতির অভিযোগে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিচার ঠেকানোর কথা বলছেন
ছবি: এএফপি

বিক্ষোভকারীদের প্রধান দাবি দুটি। একটি, বিচার বিভাগে সংস্কারের পরিকল্পনা থেকে সরে আসা। দ্বিতীয়টি, প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর পদত্যাগ। বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিচ্ছেন নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক বিরোধীরা। তবে নেতানিয়াহুর পক্ষের অনেকেও এতে তাঁর বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন।

সবচেয়ে উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, ইসরায়েলের সশস্ত্র বাহিনীর মেরুদণ্ড যাদের বলা হয়, সামরিক বাহিনীর সেই রিজার্ভ সেনারাও কাজে যোগদান না করে সরকারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। প্রতিনিয়ত এ সংখ্যা বাড়ছে। আর এতে করে ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিয়ে হুমকি তৈরির একটি ঝুঁকি দেখা দিয়েছে।

ইসরায়েলিরা এত ক্ষুব্ধ কেন

প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিরোধীরা বলছেন, বিচার বিভাগের সংস্কার আনার যে পরিকল্পনা সরকার করছে, এতে করে বিচারব্যবস্থা দুর্বল ও সরকারের মুখাপেক্ষী হয়ে পড়বে। হুমকিতে পড়বে দেশের গণতন্ত্র। অথচ সরকারের ক্ষমতা ব্যবহারের লাগাম টানতে ঐতিহাসিকভাবে বিচার বিভাগ অপরিসীম ভূমিকা রেখে এসেছে।

নেতানিয়াহুকে ইসরায়েলের সবচেয়ে কট্টর ডানপন্থী নেতাদের একজন বলা হয়। তাঁর নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকারকেও ইসরায়েলের ইতিহাসের সবচেয়ে ডানপন্থী সরকার বলা হচ্ছে। এ ছাড়া মনে করা হচ্ছে, ইসরায়েলের বর্তমান সরকার ও নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে এটাই সবচেয়ে প্রবল বিরোধিতার ঘটনা।

দুর্নীতির অভিযোগে ইসরায়েলের আদালতে প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর বিচার চলছে। তবে তিনি এ অভিযোগ অস্বীকার করে আসছেন। সরকার সমালোচকেরা বলছেন, বিচার বিভাগের সংস্কার নেতানিয়াহুকে বিচারের হাত থেকে বাঁচাতে সাহায্য করবে এবং এতে করে কোনো বাধা ছাড়া সরকার আইন পাস করতে পারবে।  

বিচার বিভাগের সংস্কার পরিকল্পনায় কী আছে

নেতানিয়াহু সরকার বিচার বিভাগে সংস্কার আনার যে পরিকল্পনা হাজির করেছে, তাতে করে যেকোনো আইন পর্যালোচনা ও বাতিল করার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা দুর্বল হয়ে যাবে। দেশের পার্লামেন্টে (নেসেট) মাত্র একজন আইনপ্রণেতার সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার আদালতের যেকোনো সিদ্ধান্ত পাল্টে দেওয়ার ক্ষমতা পাবে।  

সুপ্রিম কোর্টসহ বিভিন্ন আদালতের কে বিচারক হবেন, সে ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা সরকারের হাতে চলে যাবে। সরকারকে বিচারক নিয়োগকারী কমিটির ওপর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বিচারক নিয়োগের কমিটিতে এত দিন সরকারের যে প্রতিনিধিত্ব ছিল, সেই সংখ্যাটা আরও বাড়ানো হবে।

চলতি বছরের শুরু থেকে তেল আবিবসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে বিক্ষোভ করছেন ইসরায়েলিরা
ছবি: রয়টার্স

ইসরায়েলের বর্তমান আইন অনুযায়ী মন্ত্রীরা তাঁদের আইন উপদেষ্টার উপদেশ মানতে বাধ্য। আর এসব আইন উপদেষ্টাদের দিকনির্দেশনা দেওয়ার কাজটি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল। তবে সংস্কার প্রস্তাবে আইন উপদেষ্টার উপদেশ মানার বাধ্যবাধকতা তুলে দেওয়া এবং মন্ত্রীদের ব্যক্তিগত উপদেষ্টা নিয়োগের ক্ষমতার কথা বলা হয়েছে।

বিচার বিভাগে সংস্কারের যেসব প্রস্তাব নেতানিয়াহু সরকার দিয়েছিল, এর মধ্যে একটি ইতিমধ্যে আইনে পরিণত হয়েছে। নতুন আইনে ক্ষমতাসীন প্রধানমন্ত্রীকে অযোগ্য ঘোষণা করার যে ক্ষমতা অ্যাটর্নি জেনারেলের ছিল, তা তুলে দেওয়া হয়েছে। গুঞ্জন ছিল, নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে এমন পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিলেন ইসরায়েলের অ্যাটর্নি জেনারেল। নেতানিয়াহুর বিচার এবং সংস্কারের প্রস্তাব নিয়ে স্বার্থের দ্বন্দ্বের কারণে তিনি এমন পদক্ষেপ নিতে চেয়েছিলেন।  

এখন কী করবে নেতানিয়াহু সরকার

কয়েক মাস ধরে চলা বিক্ষোভ এবং দেশজুড়ে প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এখনো বিচার বিভাগ নিয়ে তাঁর সরকার গৃহীত সংস্কার পরিকল্পনা থেকে সরে না আসার বিষয়ে অবিচল রয়েছেন। অপরদিকে, চলমান এ বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সরকার উৎখাতের ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনেছেন তিনি।

তবে প্রবল বিরোধিতার মুখে নেতানিয়াহু সরকার সংস্কার প্রস্তাবের কিছু কিছু বাতিল করার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু বিরোধীরা সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বলেছেন, বিচার বিভাগে সংস্কার আনার পুরো পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে হবে। এ ছাড়া প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে সরকারকে দেওয়া ‘ছাড়ের প্রস্তাবও’ প্রত্যাখ্যাত হয়েছে।

সরকারের যুক্তি, বিচার বিভাগে সংস্কার আনার এবং আদালতের অগণতান্ত্রিক ক্ষমতা প্রয়োগ থেকে বিরত রাখার প্রতিশ্রুতির মধ্য দিয়েই দেশের জনগণ তাদের নির্বাচিত করেছে। সরকার চায় বিচার বিভাগ হবে আরও উদার। এ ছাড়া সরকারের দাবি, নতুন বিচারক নিয়োগের প্রক্রিয়ায় খোদ সরকারের প্রতিনিধিত্বই কম।

সংস্কার পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে নেতানিয়াহু সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বরখাস্ত হয়েছেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট
ছবি: এএফপি

তবে এত যুক্তি দেওয়ার পরও সরকারের ওপর চাপ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বিচার বিভাগে সংস্কার আনার জন্য সরকার যে উদ্যোগ নিয়েছে, সেখান থেকে সরে আসার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী। এ কারণে প্রতিরক্ষামন্ত্রীকে বরখাস্ত করেছেন নেতানিয়াহু। এ কারণে মানুষের মধ্যে ক্ষোভ আরও বেড়েছে। সোমবার জেরুজালেমে ইসরায়েলের পার্লামেন্টের সামনে বিক্ষোভে লাখো মানুষ সমবেত হন। বন্ধ হয়ে যায় অনেক সেবা খাত। সেনাসদস্যদের অনেকেও কাজে যোগ দেননি। অনেকটা অচলাবস্থার মধ্যে নেতানিয়াহু ঘোষণা দেন, বৃহত্তর ঐকমত্য তৈরি না হওয়া পর্যন্ত বিচার বিভাগের সংস্কার প্রস্তাব পার্লামেন্টে তোলা থেকে বিরত থাকছেন তিনি। তবে এ সময় কতটা হতে পারে, সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু তিনি বলেননি।