উত্তেজনার নতুন কেন্দ্র গোলান মালভূমি কী, কার নিয়ন্ত্রণে
ইসরায়েল অধিকৃত গোলান মালভূমির দ্রুজ ভাষাভাষী সংখ্যাগরিষ্ঠ মাজদাল শামস শহরে রকেট হামলায় অন্তত ১২ জন নিহত হওয়ার ঘটনায় দেশটির সঙ্গে লেবাননের হিজবুল্লাহ গোষ্ঠীর উত্তেজনা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছে বেশ কয়েকটি শিশু। হামলায় আহত হয়েছেন ৩০ জন।
শনিবার ওই শহরের এক ফুটবল মাঠে এ হামলার জন্য হিজবুল্লাহকে দায়ী করেছে ইসরায়েলের সামরিক বাহিনী। যদিও সশস্ত্র সংগঠনটি এ অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে। ওই ঘটনার পর লেবাননে ধারাবাহিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। ইতিমধ্যে, দুই দেশের মধ্যে পুরোদমে যুদ্ধ বেধে যাওয়ার আশঙ্কায় সংযম প্রদর্শনের জন্য উভয়পক্ষের প্রতি ক্রমেই বেশি আহ্বান জানিয়ে আসছে আন্তর্জাতিক মহল।
ইসরায়েল–লেবাননের মধ্যকার সাম্প্রতিকতম এ উত্তেজনার কেন্দ্রে রয়েছে ১,৮০০ বর্গকিলোমিটার আয়তনের ভূখণ্ড—গোলান মালভূমি। এটি আসলে কী, কার নিয়ন্ত্রণে—জানা যাক সে সম্পর্কে:
গোলান মালভূমি কী
দক্ষিণ–পশ্চিম সিরিয়ার পাথুরে ভূমি ‘গোলান মালভূমি’ দেশটির রাজধানী দামেস্ক থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত। এর দক্ষিণ সীমান্তে ইয়ারমুক নদী ও পশ্চিমে গ্যালিলি সাগর।
গোলান মালভূমিজুড়ে রয়েছে অমসৃণ ব্যাসল্ট শিলা। তবে এ পাহাড়ি ভূমি উর্বর। এখানকার আগ্নেয়শিলাযুক্ত মাটিতে আপেল, চেরি ও আঙুরের ফলন হয়। জর্ডান নদী ও হাসবানি নদীর পানিপ্রবাহের গুরুত্বপূর্ণ উৎস এ অঞ্চল।
গোলান কার, নিয়ন্ত্রণ করে কে
গোলান মালভূমিকে সিরিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে থাকে জাতিসংঘ। সে যাহোক, ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের আরব–ইসরায়েল যুদ্ধে এটি ইসরায়েল দখল করে নেয়। বর্তমানে এটির পশ্চিমাংশের ১,২০০ বর্গকিলোমিটার (৪৬৩ বর্গমাইল) এলাকার নিয়ন্ত্রণ দেশটির হাতে।
গোলান মালভূমিকে সিরিয়ার অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে থাকে জাতিসংঘ। সে যাহোক, ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে এটি ইসরায়েল দখল করে নেয়। বর্তমানে এটির পশ্চিমাংশের ১,২০০ বর্গকিলোমিটার (৪৬৩ বর্গমাইল) এলাকার নিয়ন্ত্রণ দেশটির হাতে।
ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী গোলান মালভূমি দখল করে নেওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে গড়ে ওঠা শুরু করে অবৈধ বসতি। এখন সেখানকার ৩০টির বেশি বসতিতে বাস করছেন ২৫ হাজারের বেশি ইসরায়েলি ইহুদি।
জাতিসংঘের পর্যবেক্ষণাধীন বাফার জোন (নিরপেক্ষ অঞ্চল) এ মালভূমির ইসরায়েল অধিকৃত এলাকা ও এখনো সিরিয়ার নিয়ন্ত্রণে থাকা বাকি ভূখণ্ডকে আলাদা করে রেখেছে।
শনিবার হামলা হওয়া মাজদাল শামস শহর গোলান মালভূমির ইসরায়েল অধিকৃত অংশের উত্তর–পূর্বাঞ্চলে অবস্থিত।
দ্রুজ কারা
ইসরায়েল যখন গোলানের দখল নেওয়া শুরু করে, তখন সেখানকার বসবাসরত অনেক সিরীয় পালাতে থাকে। এখনো এ মালভূমিতে প্রায় ২০ হাজার দ্রুজ ভাষাভাষী মানুষের বসবাস।
দ্রুজরা আরব ও আরবি ভাষাভাষী জাতিগত সম্প্রদায়ের লোকজন। সিরিয়া, লেবানন, ইসরায়েল ও জর্ডানে বসবাস করে এ সম্প্রদায়ের মানুষেরা।
শনিবারের হামলার পর ইসরায়েল দ্রুতই ঘোষণা করে, যারা হতাহত হয়েছে, তারা ইসরায়েলি। কিন্তু হামলার শিকার হয়েছেন দ্রুজ জনগোষ্ঠীর অনেকে। তাদের ইসরায়েলের নাগরিকত্ব নেই এবং তারা সিরীয় নাগরিক।
অধিকৃত এলাকায় দ্রুজ জনগোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গেও সংঘর্ষে জড়িয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। গত বছরের জুনে এ সম্প্রদায়ের লোকজন গোলানে বায়ুকল নির্মাণের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেন। তাঁদের ওপর ব্যবহার করা হয় কাঁদানে গ্যাসের শেল, বুলেট ও জলকামান।
ইসরায়েলি আইনের অধীন, দ্রুজ ইসরায়েলিদের সামরিক বাহিনীতে অংশগ্রহণ করতে হয়।
সিরিয়া কি গোলান নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করেছে
এ প্রশ্নের জবাব হলো, হ্যাঁ। তবে সিরিয়ার সেই চেষ্টা সফল হয়নি। ১৯৭৩ সালে আরব–ইসরায়েল যুদ্ধের সময় সিরিয়া এ মালভূমির নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়ার চেষ্টা চালায়।
পরে ইসরায়েল ও সিরিয়া যুদ্ধবিরতি চুক্তি সই করলে ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ এ সংঘাতে পক্ষভুক্ত হয়। গোলান মালভূমির ইসরায়েল ও সিরিয়ানিয়ন্ত্রিত অংশের মাঝে বাফার জোনে শান্তিরক্ষী মোতায়েন করে সংস্থাটি।
ইসরায়েল-সিরিয়া যুদ্ধবিরতি টিকিয়ে রাখা ও ওই এলাকায় ‘যুদ্ধবিরতি বাফার জোন’ প্রতিষ্ঠার চেষ্টায় একই বছর জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ‘ইউএন ডিজএনগেজমেন্ট অবজারভার ফোর্স (ইউএনডিওএফ)’ গঠন করে। গত এপ্রিল পর্যন্ত গোলানে মোতায়েন ছিলেন জাতিসংঘের ১ হাজার ২৭৪ জন কর্মী।
১৯৮১ সালে অধিকৃত গোলান মালভূমিকে নিজের এলাকা হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করে ইসরায়েল।
গোলান নিয়ে বিশ্বসম্প্রদায়ের অবস্থান
জাতিসংঘ ছাড়াও বিশ্বের কোনো দেশই গোলানে ইসরায়েলের দখলদারির স্বীকৃতি দেয়নি। সব দেশ মনে করে, এ ভূখণ্ড সিরিয়ার।
১৯৮১ সালে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ সর্বসম্মতভাবে এক প্রস্তাব পাস করে। প্রস্তাবে গোলানে ইসরায়েলের দখলদারি প্রত্যাখ্যান করা হয়। এ মালভূমিতে ইসরায়েলি আইন প্রয়োগ বন্ধ করারও আহ্বান জানানো হয় প্রস্তাবে। এ ছাড়াও, প্রস্তাব গোলানে ইসরায়েলের শাসনকে অবৈধ ঘোষণা করে।
তবে ২০১৯ সালে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনামলে গোলান মালভূমির ওপর ইসরায়েলের সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এটি বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সময়ও বহাল আছে।