বিশ্বে রেকর্ড ১২ কোটি মানুষ জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত: জাতিসংঘ
যুদ্ধ, সহিংসতা ও নিপীড়নের কারণে বিশ্বের ১২ কোটি মানুষ জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। আজ বৃহস্পতিবার জাতিসংঘ এই তথ্য জানিয়েছে। ক্রমবর্ধমান এই সংখ্যাকে ‘ভয়ানক’ হিসেবে বর্ণনা করেছে বিশ্ব সংস্থাটি।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর বলেছে, বিশ্বব্যাপী জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির ঘটনা আবার রেকর্ড ভেঙেছে। ফিলিস্তিনের গাজা, সুদান ও মিয়ানমারের মতো জায়গার সংঘাত আরও বেশি মানুষকে নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে বাধ্য করেছে।
ইউএনএইচসিআর এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে, বিশ্বব্যাপী বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা এখন জাপানের জনসংখ্যার সমান।
জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার প্রধান ফিলিপ্পো গ্র্যান্ডি সাংবাদিকদের বলেন, ‘সংঘাত এখনো ব্যাপক বাস্তুচ্যুতির একটি খুব বড় কারণ।’
ইউএনএইচসিআরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, গত বছরের শেষ নাগাদ ১১ কোটি ৭৩ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
আর চলতি বছরের এপ্রিলের শেষ নাগাদ সংখ্যাটি আরও বেড়েছে। আনুমানিক হিসাবে এখন বিশ্বের ১২ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত অবস্থায় বসবাস করছে।
ইউএনএইচসিআর বলছে, সংখ্যাটি ১ বছর আগের ১১ কোটির চেয়ে বেশি। আর টানা ১২ বছর ধরে সংখ্যাটি বাড়ছে। নতুন ও পরিবর্তনশীল সংকটের সংমিশ্রণসহ দীর্ঘস্থায়ী সমস্যাগুলোর সমাধানে ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে ২০১২ সালের তুলনায় বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা প্রায় তিন গুণ বেড়েছে।
গ্র্যান্ডি বার্তা সংস্থা এএফপিকে বলেন, আট বছর আগে তিনি যখন জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সংস্থার প্রধানের দায়িত্ব নিয়েছিলেন, তখনই উচ্চ বাস্তুচ্যুতির পরিসংখ্যান দেখে মর্মাহত হয়েছিলেন।
গ্র্যান্ডি বলেন, তারপর সংখ্যাটি দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। তিনি একে বিশ্বের জন্য একটি ভয়ংকর পরিস্থিতি হিসেবে বর্ণনা করেন।
সংখ্যা বাড়তে থাকবে
সংকট আরও তীব্র হওয়ার প্রতি ইঙ্গিত করেন গ্র্যান্ডি। জলবায়ু পরিবর্তন কীভাবে মানুষের স্থানান্তরকে প্রভাবিত এবং সংঘাতের দিকে ধাবিত করছে, তা–ও তুলে ধরেন তিনি।
ইউএনএইচসিআর গত বছর বিশ্বের ২৯টি দেশে মোট ৪৩ বার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করে। গ্র্যান্ডি সাংবাদিকদের বলেন, মাত্র কয়েক বছর আগের তুলনায় এই সংখ্যা চার গুণেরও বেশি।
বিশেষ করে আন্তর্জাতিক আইন সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে যেভাবে সংঘাত হচ্ছে, সে কথা উল্লেখ করে গ্র্যান্ডি বলেন, এটি প্রায়ই মানুষকে আতঙ্কিত করার উদ্দেশ্য নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে।
গ্র্যান্ডি বলেন, ‘এই বিষয় অবশ্যই আরও বাস্তুচ্যুতির ক্ষেত্রে একটি বড় ভূমিকা রাখছে।’
গ্র্যান্ডি স্বীকার করেন, বর্তমান প্রবণতা কমানোর আশা কম বলে মনে হচ্ছে।
গ্র্যান্ডি বলেন, ‘আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিতে পরিবর্তন না হলে, দুর্ভাগ্যবশত আমি যা দেখতে পাচ্ছি, তা হলো, সংখ্যাটি ক্রমাগত বাড়তে থাকবে।’
আজ বৃহস্পতিবার প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ যে ১১ কোটি ৭৩ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, তাদের মধ্যে ৬ কোটি ৮৩ লাখ নিজ দেশে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, শরণার্থীসহ অন্য যাদের আন্তর্জাতিক সুরক্ষার প্রয়োজন, তাদের সংখ্যা ইতিমধ্যে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ কোটি ৩৪ লাখ।
শরণার্থী ও অন্যান্য অভিবাসনপ্রত্যাশীরা ধনী দেশগুলোতে চলে যায় বলে যে ধারণা, তার প্রতি একমত পোষণ করেনি ইউএনএইচসিআর।
সংস্থাটি বলেছে, অধিকাংশ শরণার্থীকে তাদের প্রতিবেশী দেশগুলোতে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। ৭৫ শতাংশ শরণার্থী নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে বসবাস করছে।
বিয়োগান্ত ঘটনা
বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধির একটি বড় কারণ সুদানের গৃহযুদ্ধ। ২০২৩ সালের এপ্রিলে সুদানে দুই জেনারেলের ক্ষমতার লড়াইয়ে যুদ্ধ শুরু হয়। পরে তা গৃহযুদ্ধে রূপ নেয়। ইউএনএইচসিআর বলছে, এই গৃহযুদ্ধে ৯০ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ দেশটির প্রায় ১ কোটি ১০ লাখ মানুষ উৎপাটিত হয়েছে। এই সংখ্যা এখনো বাড়ছে।
গ্র্যান্ডি উল্লেখ করেন, এখনো অনেকে সুদান থেকে পালিয়ে প্রতিবেশী দেশ চাদে যাচ্ছে। দেশটিতে গত ১৪ মাসে প্রায় ৬ লাখ সুদানি গেছে।
গ্র্যান্ডি এএফপিকে বলেন, ‘একটি বিধ্বস্ত দেশ থেকে প্রতিদিন শত শত মানুষ বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র একটি দেশে যাচ্ছে।’
গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গো ও মিয়ানমারে ভয়ংকর লড়াইয়ে গত বছর লাখো মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলে হামলা চালায় হামাস। এর জেরে গাজায় আট মাস ধরে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। জাতিসংঘের হিসাবমতে, এই যুদ্ধের কারণে গাজা উপত্যকার মোট জনসংখ্যার ৭৫ শতাংশ (১৭ লাখ) বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেনে পূর্ণমাত্রায় আগ্রাসন শুরু করে রাশিয়া। ইউক্রেন যুদ্ধ এখনো চলছে।
জাতিসংঘের হিসাবমতে, গত বছর ইউক্রেনের অভ্যন্তরে প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজার মানুষ নতুনভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে। ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ দেশটির মোট ৩৭ লাখ মানুষ অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
ইউএনএইচসিআর বলছে, ইউক্রেনীয় শরণার্থী ও আশ্রয়প্রার্থীদের সংখ্যা ২ লাখ ৭৫ হাজারের বেশি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬০ লাখ।
ইউএনএইচসিআর বলেছে, বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাস্তুচ্যুতি-সংকটের কেন্দ্রে এখনো রয়ে গেছে সিরিয়া। দেশটির ভেতরে-বাইরে ১ কোটি ৩৮ লাখ মানুষ জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়েছে।