গাজা ও লেবানন থেকে সম্পদ লুটে বিক্রি করছেন ইসরায়েলি সেনারা

গাজায় বিধ্বস্ত একটি বাড়িতে অভিযান চালাচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। জুলাই ২০২৪ সাল-ছবি: এএফপি

ফিলিস্তিনের গাজা ও লেবানন থেকে লুটপাট করে নেওয়া মালামাল বিক্রি করছেন ইসরায়েলি সেনারা। নতুন এক অনুসন্ধানে ইসরায়েলি সেনাদের বেআইনি এ কর্মকাণ্ডের বিষয়টি উঠে এসেছে।

হামাকম হাচি হাম বাগেহেনম (দ্য হটেস্ট প্লেস ইন হেল) ইসরায়েলি সেনাদের লুটপাট ও চুরির অসংখ্য ঘটনা একসঙ্গে জড়ো করেছে। ইসরায়েলি সেনাদের এই দুই অঞ্চল থেকে লুটপাট ও চুরি করা মালামালের মধ্যে রয়েছে—নগদ অর্থ, স্বর্ণালংকার, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি ও গাড়ি।

ইসরায়েলি সেনারা এসব সম্পদ লুটপাট করার পর টেলিগ্রাম চ্যানেল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের মার্কেটপ্লেস অথবা বাজারে নিয়ে বিক্রি করছেন।

ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর একটি শাখা নাহাল ব্রিগেড। এই ব্রিগেডের এইতান (ছদ্মনাম) নামের এক কমান্ডার ব্যাখ্যা করে বলেন, প্রথম দিকে ইসরায়েলি সেনারা গাজা ও লেবাননে বিভিন্ন বাড়ি থেকে স্মারক হিসেবে কিছু জিনিসপত্র নেন। এরপরই তাঁদের মধ্যে লুটপাট ও চুরির প্রবণতা বেড়ে যায়।

সৈন্যদের ব্যাগ তল্লাশির সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। কারণ, তাঁদের পুরো ব্যাটালিয়ন একসঙ্গে থাকে। ফলে তাঁরা ছিলেন নির্ভয়। এ সুযোগে ইসরায়েলি সেনারা সর্বত্র লুটপাটের কাজ করছিলেন এবং সব জায়গায় তাঁরা নানাভাবে জিনিসপত্র লুকিয়েছিলেন।

বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে তখনই, যখন দেখা যায়, কেবল তরুণ ও নিম্নপদের সেনারা লুটপাট-চুরি করছেন না, বরং সার্জেন্ট পদবির কর্মকর্তারাও একই অপকর্মে নেমে পড়েছেন।

এইতান বলেন, ‘একজন ইসরায়েলি জ্যেষ্ঠ কমান্ডার গাজায় ঘরবাড়ি থেকে ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতিসহ নানা জিনিসপত্র নিয়ে গেছেন। বিষয়টি সার্জেন্ট ও কোম্পানি কমান্ডার জানতেন। আমি তখন আমার সার্জেন্টের কাছে গিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাই। তিনি আমাকে বলেন, এটা সত্যিই খারাপ। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে তাঁর কিছু করার নেই।’

তদন্তে জানা যায়, এভাবে লুটপাট আর চুরি করে নেওয়া মালামাল বিক্রি করা সাধারণত অপরাধ। ফলে এসব জিনিসপত্র স্বাভাবিকভাবে ব্যবহার করা যায় না।

এসব লুটের মালামালের মধ্যে আরব শিলালিপি অঙ্কিত অলঙ্কার, গোলাবারুদ ও অস্ত্র রয়েছে। ফলে এসব জিনিস প্রকাশ্যে বিক্রি করা হলে সন্দেহের উদ্রেক করবে।

আরেক ইসরায়েলি সৈন্য ওমার বলেন, ‘অন্যান্য মালামালের চেয়ে নগদ অর্থ নেওয়া অনেক সহজ। কারণ, এ টাকা সহজেই খরচ করা যায়। লাখ লাখ শেকেল (ইসরায়েলি মুদ্রা) যে লুট করা হয়েছে, আমি সে সম্পর্কে শুনেছি।’

ওই সেনাসদস্য বলেন, ‘কিছু জিনিসপত্র নেওয়া হলে তা বিক্রির জন্য নেওয়া হয়েছে—এমনটা ভাবার কারণ নেই। তবে আমি এটাও জানি, অনেকে অতিমাত্রায় মালামাল চুরি করে নিয়ে গেছে। ফলে তাঁরা সেসব জিনিস গোপন করে রেখেছেন। যাঁরা এসব জিনিসপত্র বিক্রি করবেন, তাঁরা এগুলো নিয়ে এখনই বন্ধুদের সঙ্গে কোনো কথা বলবেন বলে মনে হয় না।’

ওমার আরও বলেন, ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে যাঁরা কর্তৃপক্ষের অবস্থানে ছিলেন, তাঁরাও এসব সমস্যা ঠিকমতো দেখেননি বা ব্যবস্থা নেননি। ওই সৈন্য ব্যাখ্যা করে বলেন, ‘ঊর্ধ্বতন পর্যায়ের কর্মকর্তারা একচোখা নীত গ্রহণ করেছেন। সৈন্যদের এই লুটপাটের বিষয়ে তাঁরা মোটেই উদ্বিগ্ন ছিলেন না।’

ইসরায়েলি সেনাদের অনেকে বিশ্বাস করেন, কমান্ডারদের অনেকেও গাজা ও লেবাননে লুটপাটে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তাঁরা আরও মূল্যবান জিনিসপত্র লুটপাট করেছেন।

সেনাদের নীতিমালায় বলা আছে, কোনো নগদ অর্থ বা গোলাবারুদ পাওয়া গেলে সৈন্যদের বিষয়টি তাঁদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানাতে হবে। পরে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বিষয়টি সেনাবাহিনীর টেকনোলজিক্যাল অ্যান্ড লজিস্টিক ডিরেকটোরেটের বুটি ক্লিয়ারেন্স ইউনিটকে (ইয়াহপাশ) জানাবে।

গাজায় এক মাস যুদ্ধের পর ইসরায়েলের ওই ইউনিট জানিয়েছিল, উপত্যকা থেকে ৫০ লাখ শেকেল (১৩ লাখ ডলার) জব্দ করা হয়েছে এবং এই অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী গাজা ও লেবাননে ১০ কোটি শেকেল (২ কোটি ৭৬ লাখ ডলার) নগদ জব্দ করা হয়েছে।

গত সপ্তাহে ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান ওয়াইনেট নিউজ সিরিয়া, লেবানন ও গাজা থেকে ইসরায়েলি বাহিনীর লুটপাট ও চুরি করে নেওয়ার বিপুল পরিমাণ মূল্যবান সম্পদের একটি হিসাব দিয়েছিল। এতে দেখা যায়, এসব সম্পদের মধ্যে প্রায় ২ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলারের নগদ অর্থ, সোনার বার, দামি স্বর্ণালংকার এবং ১ লাখ ৮৩ হাজার অস্ত্র ও যন্ত্রপাতি রয়েছে।

চুরি যে ব্যাপকভাবে হয়েছে, সেটা সেনাদের নিজেদের মধ্যকার ঠাট্টাতামাশায় ফুটে উঠেছে। তাঁরা হাসি-তামাশা করে নিজেদের মধ্যে বলাবলি করছেন, চুরির মালামাল বহন করতে গিয়ে তাদের ‘পিঠের মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে’।

ইসরায়েলের বিশেষ সেনাবাহিনীর ইউনিটের নেতৃত্বে সবচেয়ে বেশি লুটপাট চালানো হয়েছে। গাজা ও লেবানন অঞ্চল থেকে ‘শত্রুদের’ সম্পদ জব্দ করার দায়িত্ব এই ইউনিটকে দেওয়া হয়েছে। তবে ওই ইউনিটের বাইরেও ইসরায়েলি সেনারা ব্যাপকভাবে লুটপাট চালিয়েছেন।

ওয়াইনেট নিউজের অথ্য অনুযায়ী, সিরিয়া, লেবানন ও গাজায় চলমান অভিযানের সময় ইসরায়েলি বাহিনী এত পরিমাণ অস্ত্র জব্দ করেছে যে সেগুলো দিয়ে একটি ছোটখাটো সেনাবাহিনী বানানো যেতে পারে।

গাজায় বিধ্বস্ত একটি বাড়ির ভেতরে ইসরায়েলি সেনা। ফেব্রুয়ারি ২০২৪-
ছবি: এপি

যুদ্ধাপরাধ ও মানবাধিকার লঙ্ঘন

আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী, সেনাবাহিনীর জন্য লুটপাট ও চুরি সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। এমন কিছু করা হলে তা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। ঝুঁকিপূর্ণ সম্প্রদায় ও বেসামরিক মানুষের সম্পদ লুটপাট করাকে অবৈধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

এ ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘনকে ইসরায়েলের মানুষ স্বাভাবিক হিসেবে দেখে থাকে। সর্বশেষ ফিলিস্তিনের অধিকৃত পশ্চিম তীরেও ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর অভিযানের সময় ব্যাপক চুরি ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে।

সম্প্রতি ফাঁস হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, পশ্চিম তীরের জেনিনে ইসরায়েলি সেনারা ঠেলাগাড়ি নিয়ে বিভিন্ন বাড়িতে ঢুকছেন আর বাক্স ভর্তি করে মালামাল লুট করে নিয়ে যাচ্ছেন।

গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইসরায়েলের সাবেক সেনাপ্রধান হারজি হালেভি গাজায় লুটপাটের ব্যাপারে সেনাদের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছিলেন। তখনো গাজায় লুটপাট, চুরি ও ভাঙচুরের বেশ কিছু ভিডিও প্রকাশ পেয়েছিল।

ইসরায়েলের ওয়াইনেট নিউজ ওয়েবসাইটের প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, হালেভি কমান্ডার ও সেনাসদস্যদের চুরি, দেয়ালে অপ্রয়োজনীয় গ্রাফিতি তৈরি এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন।

ওই সময় হালেভি বেশ কিছু ভিডিও তুলে ধরেছিলেন যাতে দেখা যায়, হামাসকে ধ্বংস করার নামে ইসরায়েলি সেনারা সহিংসতা সৃষ্টি ও উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন।

একটি ভিডিওতে দেখা যায়, এক সেনা গর্ব করে বলছেন, তিনি গাজা থেকে চুরি করা রুপালি রঙের একটি নেকলেস তাঁর মেয়েবান্ধবীর জন্য নিয়ে যাচ্ছেন।

আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, একজন সেনাসদস্য ফিলিস্তিনের একটি বাড়ি থেকে কম্বল চুরি করছেন। অন্য আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, ফিলিস্তিনি একটি ঘর থেকে এক সৈন্য ঐতিহ্যবাহী একটি আয়না চুরি করে নিয়ে যাচ্ছেন।

আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, এক ইসরায়েলি সেনা কর্মকর্তা গৃহসজ্জার কিছু জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে যাচ্ছেন। এ সময় একজন সৈন্য ওই বাড়ির খাবার ও পানি সরবরাহ লাইনে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছেন।