আশ্রয়শিবিরেও নিরাপদ থাকতে পারছেন না ফিলিস্তিনিরা
স্থানীয় সময় সোমবার দুপুর। তীব্র বোমাবর্ষণ চলছে। এরই মধ্যে ইসরায়েলের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রগুলো আছড়ে পড়ে গাজা শহরের ঠিক উত্তরে অবস্থিত জাবালিয়া আশ্রয়শিবিরে। মুহূর্তে আশ্রয়শিবির পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে।
জাবালিয়া আশ্রয়শিবিরে থাকেন তরুণ লেখক আসমা তাইয়েহ। গত শনিবার থেকে আশপাশের এলাকা থেকে ভেসে আসা মুহুর্মুহু ক্ষেপণাস্ত্রের শব্দ শুনতে শুনতে অনেকটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন তিনি। কারণ, ওই দিন থেকে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলন হামাসের সঙ্গে ইসরায়েলের সংঘাত চলছে।
কিন্তু আসমা কখনো ভাবতে পারেননি, তিনি যে স্থানটিকে ‘বাড়ি’ বলে মানেন, সেই আশ্রয়শিবির আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হতে পারে। জাবালিয়ায় যখন বোমা পড়তে শুরু করে, তখন ‘নিজেকে শান্ত রাখতে পারছিলেন না’, আল-জাজিরাকে বলেছিলেন আসমা। হামলার ধাক্কা তখনো কাটিয়ে উঠতে পারেননি তিনি, তাঁর কণ্ঠ কাঁপছিল।
আসমা বলছিলেন, ‘ওই সময় আসলে আমাদের বাড়ির সবচেয়ে কাছের কোনো জায়গা থেকে সবচেয়ে জোরে বোমা বিস্ফোরণে আওয়াজ আসে। মুহূর্তের জন্য মনে হয়েছিল, আমাদের পাশের বাড়িটিতে বুঝি হামলা হয়েছে।’
বোমা হামলার সহিংসতায় পুরো শিবিরকে কাঁপিয়ে দেয়। হামলাটি আসমাদের বাড়ির কতটা কাছে হয়েছে, এতে তাঁদের বাড়ির কোনো ক্ষতি হলো কি না, তা দেখতে আসমা জানালার দিকে ছুটে গিয়েছিলেন।
আসমা বললেন, ‘আমি তখন বিছানায় শুয়েছিলাম। বাইরের এক বন্ধু আমার খোঁজখবর জানতে খুদে বার্তা পাঠিয়েছিলেন, আমি সেটির উত্তর দিচ্ছিলাম।’ তিনি বলেন, ‘ভয়াবহ ওই হামলার পর আমি তাঁকে যা বলতে পারতাম, তা হলো: সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ, আমি এখনো বেঁচে আছি।’
আসমা ও তাঁর প্রতিবেশীরা দ্রুতই জানতে পারেন, জাবালিয়ার জনবহুল স্থানে হামলা হয়েছে, সেটি আসলে একটি বাজার। আসমা বলেন, ‘আমরা জানতে পারলাম, হামলায় কয়েক ডজন মানুষের মৃত্যু হয়েছে।’
বোমা বিস্ফোরণের পরিপ্রেক্ষিতে অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার সার্ভিসের জরুরি যান দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে আসে। সাইরেনের হাহাকার ছড়ানো শব্দ চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।
আসমা বলেন, ‘পুরো এলাকায় তখন অ্যাম্বুলেন্স ও গাড়ির শব্দ। কিন্তু এর চেয়েও বেশি তীক্ষ্ণভাবে শোনা যাচ্ছিল মানুষের আর্তচিৎকার। তাঁরা চিৎকার করতে করতে বোমা হামলার স্থানের দিকে ছুটে আসছিলেন।’
এ রকম একটি ছোট এলাকায়, যেখানে সবাই অন্য সবাইকে চেনে, সেখানে যেকোনো প্রাণহানির ঘটনা সবার জন্যই বেদনা বয়ে আনে। কিন্তু আসমা শোক করার সুযোগ পাননি, হামলার পর তিনিও মাঠে নামতে বাধ্য হন।
আসমা এর ব্যাখ্যায় বলছিলেন, ‘আমি আমার ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিচ্ছিলাম, এমন প্রস্তুতি আমাদের নিতেই হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘মৃত্যু খুব কাছাকাছি বলে মনে হলেও আমাদের কিছুই করার নেই, যেভাবে কয়েক মিনিট আগে যাঁদের হত্যা করা হলো, তাঁদেরও কিছু করার ছিল না।’
আশ্রয়শিবিরটি অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ। সেখানে ফিলিস্তিন শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের ত্রাণ ও কর্ম সংস্থা (ইউএনআরইউএ) পরিচালিত তিনটি স্কুলকেও আশ্রয়শিবিরে রূপান্তরিত করা হয়েছে। সেখানে শত শত বাস্তুচ্যুত পরিবার আশ্রয় নিয়েছে।
আশ্রয়শিবিরটি ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় বিমান বোমা হামলার মৃতের সংখ্যা বেড়েছে।
যদিও আসমা ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা হামলা থেকে রক্ষা পেয়েছেন, তবে আশ্রয়শিবিরের নিরাপত্তা নিয়ে তাঁদের ভাবনায় বড় ধাক্কা লেগেছে।
আসমা হামলাসংক্রান্ত খবর বারবার ঘাঁটাঘাঁটি করছিলেন। বারবার খতিয়ে দেখছিলেন তাঁর বন্ধুবান্ধব বা স্বজনদের কারও নাম হতাহতের তালিকায় আছে কি না।
আসমা আল-জাজিরাকে বলছিলেন, ‘সৌভাগ্যক্রমে আমরা এখনো ভালো আছি এবং আমরা বাড়িতেই আছি, কিন্তু গাজার অন্য সবার মতো আমরা মোটেও নিরাপদ বোধ করছি না।’
এই অনিরাপত্তা বোধ চলমান সংঘাতের পরও থাকবে বলে মনে করেন আসমা। তিনি আরও বলেন, ‘আমার মনে হয়, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরও আমরা কখনো নিরাপদ হতে পারব না।
প্রকৃতপক্ষে, যতক্ষণ পর্যন্ত ফিলিস্তিন দখলমুক্ত হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত ফিলিস্তিনিদের আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটানোর অবসান না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি নিজেকে স্বাধীন মনে করতে পারব না।’
আসমার এই উপলব্ধি অগণিত ফিলিস্তিনিরও উপলব্ধি, যারা কয়েক দশক ধরে সংঘাত ও দখলদারত্ব সহ্য করে আসছে। চলমান ধ্বংসের ছায়াতলেও তারা স্থিতিশীল ও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় ধরে রেখেছেন, নিজেদের পিতৃভূমিতে শান্তিতে বসবাসের অধিকার বহালের অটল বিশ্বাসে এতটুকু চিড় ধরতে দেননি।
যদিও এখনো স্পষ্ট কোনো সমাধান দৃশ্যমান নয়।