ইউক্রেন যুদ্ধের যে কৌশল ব্যবহার করে ইসরায়েলকে চমকে দিল হামাস
ইসরায়েলে গত শনিবার এযাবৎকালের সবচেয়ে বড় হামলা চালায় ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। এ হামলায় ছোট ও তুলনামূলক সস্তা ড্রোন ব্যবহার করে তারা। এর মধ্য দিয়ে লাখ লাখ কোটি ডলার ব্যয়ে অত্যাধুনিক সমরাস্ত্র প্রযুক্তি ব্যবহার করা ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে হামাস।
হামাস তাদের এই হামলায় ব্যবহার করে ইসরায়েলের তৈরি ‘স্কাইলার্ক’ ড্রোনের মতো অতি ক্ষুদ্রাকৃতির আকাশযান। এ ছাড়া হামাস যোদ্ধারা প্যারাসুটে মোটর লাগিয়ে বিশেষ কৌশলে সীমানা বেড়া টপকে যান। এই কৌশলে ইসরায়েলের অত্যাধুনিক প্রতিরক্ষাব্যবস্থাকে ফাঁকি দিয়ে তাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে চমকে দিয়েছে হামাস।
হামাসের প্রকাশ করা একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, গাজা সীমান্তে নজরদারির জন্য ইসরায়েলের তৈরি একটি প্রতিরক্ষা টাওয়ারের ওপর ড্রোন থেকে বিস্ফোরক ফেলা হচ্ছে। ড্রোন থেকে বিস্ফোরক ফেলার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে একটি বিস্ফোরণ ঘটে। এর মাধ্যমে ইসরায়েলের এ নজরদারির ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়ে। সীমান্তে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা দেখা দিলে দূরে থাকা নিয়ন্ত্রণকক্ষের মাধ্যমে এই টাওয়ার থেকে শত্রুপক্ষের লক্ষ্যবস্তুকে গুলি করে থাকেন ইসরায়েলি সেনারা।
আরেকটি ভিডিওতে দেখা যায়, একটি ড্রোন কাছাকাছি দূরত্ব থেকে ইসরায়েলের একটি সামরিক ঘাঁটিতে কিছু একটা ফেলছে। এটা হতে পারে হাতবোমা অথবা বিস্ফোরক। আরও কিছু ভিডিওতে দেখা যায়, গাজা সীমান্তে ইসরায়েলের সামরিক স্থাপনা লক্ষ্য করে একই কায়দায় হামলা করা হচ্ছে।
হামাসের ছোট ছোট এই ড্রোন ব্যবহারের সবচেয়ে বড় সাফল্য বলা যেতে পারে কমপক্ষে একটি মারকাভা মার্ক–৪ ট্যাংক ধ্বংস করা। মারকাভাকে বলা হয়ে থাকে বিশ্বের অন্যতম অত্যাধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন ও ভারী অস্ত্রে সজ্জিত ট্যাংক। ভিডিওতে দেখা যায়, হামলার সময় এই যুদ্ধযানের স্বয়ংক্রিয় প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কাজ করেনি। এই রহস্যের কারণ হলো, এই যুদ্ধযানটির স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে ট্যাংকবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রের হামলা ঠেকানোর জন্য, ড্রোন দিয়ে নিক্ষেপ করা বিস্ফোরকের জন্য নয়।
‘এসব ড্রোনের প্রযুক্তি এত সহজ যে একটি শিশুও এটি ব্যবহার করে নির্দিষ্ট লক্ষ্যে হামলা চালাতে পারবে। আমরা ইউক্রেনে যা দেখেছি, এখন এখানেও (ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাত) তা দেখতে পাব।’লিরান আনতেবি, ইসরায়েলি নিরাপত্তা বিশ্লেষক
২০০০ সাল থেকে জিপিএস প্রযুক্তি–চালিত ড্রোন জনপ্রিয় হতে থাকে। এতে সংশ্লিষ্ট কয়েকটি পক্ষ থেকে আগেই উদ্বেগ জানানো হয়েছিল যে এ ধরনের ড্রোনের ব্যবহার সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করতে পারে। বিষয়টা এ রকম যে এ ধরনের ড্রোন হলো ‘গরিবের বিমানবাহিনী’। দিন যতই যাচ্ছে, এ ধরনের ড্রোনের ব্যবহার ততই জনপ্রিয় হচ্ছে।
ড্রোনের মাধ্যমে বিস্ফোরক ফেলে হামলা চালানোর এ কৌশল ব্যপকভাবে ব্যবহার করেছে জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)। এতে ইরাক ও সিরিয়ায় দেশি–বিদেশি যেসব বাহিনী আইএসের বিরুদ্ধে লড়াই করছিল, তারা পড়েছিল বিপাকে। ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর রুশ ও ইউক্রেনীয় বাহিনীও স্থানীয়ভাবে বিমানবাহিনীর বিকল্প হিসেবে এসব ড্রোন ব্যবহার করে আসছে। হামলার সঙ্গে সঙ্গে এসব ড্রোনের ব্যবহার করা হচ্ছে নজরদারির কাজেও। এসব ড্রোনের দাম কয়েক লাখ ডলার। এসব ড্রোন দিয়ে যেমন নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করা যায় তেমনি সামরিক যান ধ্বংসের বিশেষভাবে তৈরি গ্রেনেড ও বিস্ফোরক রাখা যায়। একই সঙ্গে ভারী অস্ত্রেও সজ্জিত করা যায় এসব ড্রোন।
ইসরায়েলের তেল আবিবভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর ন্যাশনাল সিকিউরিটি স্টাডিজের (আইএনএনএস) একজন জ্যেষ্ঠ গবেষক লিরান আনতেবি। তিনি বলেন, ‘আকাশপথে হুমকির ক্ষেত্রে বিগত দশকে একটা বড় পরিবর্তন দেখেছি আমরা। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এই প্রবণতা শুরু হয়েছে। এরপর ইউক্রেন হয়ে এখন গাজাতেও তা দেখা যাচ্ছে।’
গোয়েন্দা নজরদারির মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ এবং জনবহুল এলাকায় হামলা চালানোর জন্য ক্ষুদ্রাকৃতির ড্রোন ব্যবহার করে থাকে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী। কিন্তু এখন বিশেষ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়াও হামাস ও ইসালিমক জিহাদের মতো সশস্ত্র সংগঠনগুলোও এসব ড্রোন ব্যবহার করছে।
২০২১ সালের ঘটনা। ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকা থেকে ইসরায়েলে পাঠানো হামাসের একটি ড্রোন ভূপাতিত করা হয়। এ বছর গাজা থেকে ইসরায়েলে আসা অন্তত ১০টি ড্রোন ভূপাতিত নয়তো জব্দ করে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী।
লেবাননের হিজবুল্লাহও ইসরায়েলে একাধিক ড্রোন পাঠিয়েছে বলে জানা যায়। এক বছর আগে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী হিজবুল্লাহর তিনটি ড্রোন ভূপাতিত করে। এগুলো ছিল হিজবুল্লাহর ব্যবহার করা অত্যাধুনিক ড্রোন। গত শনিবারের হামলায় হামাস যেসব ড্রোন ব্যবহার করেছে ঠিক একই ধরনের ড্রোন হিজবুল্লাহও ব্যবহার করেছে। গত বছর এ নিয়ে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়। নজরদারির মাধ্যমে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ ছাড়াও হামলার জন্য এসব ড্রোন ব্যবহার করে থাকে হিজবুল্লাহ।
আইএনএনএসের অ্যাডভানসড্ টেকনোলজিস অ্যান্ড ন্যানশাল সিকিউরিটি প্রোগ্রামের পরিচালক লিরান আনতেবি বলেন, ‘এসব ড্রোনের প্রযুক্তি এত সহজ যে একটি শিশুও এটি ব্যবহার করে একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্যে হামলা চালাতে পারবে। আমরা ইউক্রেনে যা দেখেছি এখন এখানেও (ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সংঘাত) তা দেখতে পাব। এর প্রযুক্তি খুবই সহজ। ড্রোন তৈরির জন্য যা দরকার তা হলো একটি সফটওয়্যার ব্যবস্থা যা ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করা যায়, একটি বিস্ফোরক ও কালো ইলেকট্রিক্যাল টেপ।’