১২ দিনে কীভাবে আসাদের মসনদ টলে গেল, কী ছিল বিদ্রোহীদের কৌশল
মাত্র ১২ দিনে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে গেলেন বিদ্রোহীরা, দামেস্কে পতন হলো বাশার আল–আসাদের। এত কম সময়ে এই পতন নিয়ে ওই অঞ্চলে নজরদারি করা বিভিন্ন সংস্থা এবং আঞ্চলিক প্রভাবশালীরাও হিসাব মেলাতে পারেনি।
গত ২৭ নভেম্বর নতুন করে আক্রমণ শুরু করার পর সিরিয়ার বিদ্রোহীরা এগিয়েছেন অপ্রতিরোধ্য গতিতে। অভিযান শুরু করার মাত্র চার দিনের মাথায় তাঁরা দেশটির দ্বিতীয় বৃহৎ নগরী আলেপ্পোর দখল নিয়ে নেন। সেখান থেকে তাঁরা রওনা দেন আরেক বড় শহর হামার দিকে। আলেপ্পো দখলের সময় বিদ্রোহীদের তেমন কোনো প্রতিরোধের মুখে পড়তে হয়নি বলে জানিয়েছিল সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংস্থাটি সিরিয়ার গৃহযুদ্ধের ওপর নজর রাখে।
সিরিয়ার সরকারের মূল সমর্থক ছিল মস্কো। গৃহযুদ্ধ চলাকালে মস্কোর অস্ত্র এবং সামরিক সমর্থনের জোয়ারে সবকিছু প্রেসিডেন্ট আসাদের পক্ষে চলে গিয়েছিল। কিন্তু রাশিয়া এখন নিজেই ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। তবে মিত্রের হাত একেবারে ছেড়ে দেয়নি, তেহরানও নয়। কয়েক দশক ধরে সিরিয়ায় আসাদ পরিবারকে সমর্থন দিয়ে গেছে ইরান।
হামা দখলের পথে বিভিন্ন সড়কে আসাদ বাহিনীর সঙ্গে বিদ্রোহীদের লড়াই হয়েছিল। কিন্তু আসাদ বাহিনী সেখানেও খুব একটা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি। বিদ্রোহীরা কয়েক দিক থেকে হামা শহরে হামলা চালান বলে জানায় সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস।
সিরিয়ায় এবারের আসাদবিরোধী অভিযানে বিদ্রোহীদের নেতৃত্ব দিয়েছে হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস)। তাদের এবং তাদের মিত্র গোষ্ঠীগুলোর যোদ্ধারা মূলত পিকআপ ভ্যান ও মোটরবাইকে করে সামনে অগ্রসর হয়েছেন। এটিও তাঁদের দ্রুতগতিতে এগিয়ে যাওয়ার একটি কারণ।
হামা দখলের পর বিদ্রোহীরা রওনা হন হোমসের পথে। রাজধানী দামেস্কে পৌঁছাতে কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ শহর হোমস। হোমস থেকে সিরিয়ার রাজধানী দামেস্কের দূরত্ব মাত্র ১০০ মাইল (১৬০ কিলোমিটার)। ৬ ডিসেম্বর বিদ্রোহীরা প্রায় বিনা বাধায় হোমসের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যান। তখনই মনে হচ্ছিল, আসাদ সরকারের পতন হয়তো আসন্ন।
‘বিদ্রোহীরা এবার শিয়া মুসলিমদের গ্রামগুলোতে প্রবেশের সময় আক্রমণ নয় বরং আলোচনা করে একটি সমঝোতায় এসেছেন।’এইচ এ হেলিয়ের, রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিস ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ সহযোগী ফেলো।
এত কম সময়ে বিদ্রোহীদের দামেস্ক দখলের কারণ ব্যাখ্যা করেছে সিএনএন। তাদের প্রতিবেদন বলেছে, এইচটিএসের হামলার বিরুদ্ধে আসাদ বাহিনী তেমন কোনো প্রতিরোধই গড়ে তুলতে পারেনি। সিরিয়ার পুলিশ বাহিনী খুব একটা প্রশিক্ষিত নয়, তাই যা হওয়ার, তা–ই হয়েছে। তারা বিদ্রোহীদের সামনে দাঁড়াতেই পারেনি।
বিদ্রোহী যোদ্ধারা যখন হামা শহরের কাছে পৌঁছান, তখন সিরিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় সেনাবাহিনীকে তাদের প্রতিরক্ষা লাইন ‘অপ্রতিরোধ্য’ করতে বলেছিল। পরে সিরিয়ার সেনাবাহিনী থেকে বলা হয়, ‘বেসামরিক নাগরিকদের প্রাণ রক্ষার্থে’ তারা তাদের সেনা প্রত্যাহার করে নিয়েছে।
এমন দাবি মেনে নেওয়া বোকামি। বিশেষ করে আসাদ সরকারের পক্ষ থেকে যখন এ ধরনের দাবি করা হয়। সিরিয়ায় ১৩ বছরের বেশি সময় ধরে গৃহযুদ্ধ চলছে। যুদ্ধে হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন। বিশ্লেষকেরা বলছেন, মনোবলের অভাব, দলত্যাগ ও দুর্নীতির কারণে আসাদ বাহিনীর ভেতরটা ‘ফাঁপা’ হয়ে গেছে।
বিদ্রোহীরা যখন হোমসের দ্বারপ্রান্তে, তখন লন্ডনের চ্যাথাম হাউসের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা প্রকল্পের পরিচালক সানাম ভাকিল গত শনিবার বলেছিলেন, ‘এখন প্রশ্ন হচ্ছে তাঁরা এই গতিতে দামেস্কে পৌঁছাতে পারবেন কি না। দেখে মনে হচ্ছে, যা ঘটছে, তার পেছনে বিশাল সমর্থন আছে এবং এটা আসাদ সরকারের দুর্বলতা প্রকাশ করছে।’ তাঁর এই কথা সত্য প্রমাণিত হতে খুব বেশি সময় লাগেনি।
একসময় আল-কায়দার শাখা ছিল এইচটিএস। তারা তাদের সাম্প্রদায়িক ভাবমূর্তি থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে এবং খুব সম্ভবত নিজেদের মতাদর্শেও কিছুটা নরম হয়েছে বলে মনে করেন রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিস ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ সহযোগী ফেলো এইচ এ হেলিয়ের। তিনি বলেছিলেন, গত সপ্তাহে সিরিয়ার সুন্নি বিদ্রোহীদের সাফল্যের একটি বড় কারণ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে তাদের যত্নশীল হওয়া। যেমন বিদ্রোহীরা শিয়া মুসলিমদের গ্রামগুলোতে প্রবেশের সময় আক্রমণ নয় বরং আলোচনা করে একটি সমঝোতায় এসেছেন।
হেলিয়ের আরও বলেছিলেন, যদি বিদ্রোহীরা আলাওতি সম্প্রদায়ের সঙ্গেও একই ধরনের আচরণ করেন, তবেই কেল্লাফতে।
শিয়া মুসলিমদের মধ্যে একটি সংখ্যালঘু অংশ আলাওতি। বাশার আল-আসাদ আলাওতি সম্প্রদায়ের এবং তাঁর আস্থাশীল সমর্থকদের একটি বড় অংশ এসেছে এই সম্প্রদায় থেকে।
বিদ্রোহী বাহিনীর মধ্যে গভীর সমন্বয়ের প্রমাণও পাওয়া গেছে। এইচটিএসের যখন বাড়তি শক্তির প্রয়োজন ছিল, তখন তুরস্কসমর্থিত সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মি তাদের সমর্থনে একদল যোদ্ধা পাঠিয়েছে। এ ঘটনা হয়তো বিদ্রোহীদের মধ্যে ঐক্য নিয়ে উদ্বেগ দূর করতে সক্ষম হয়েছে।
সিরিয়ার বিদ্রোহীদের অভিযান নিয়ে লন্ডনের কিংস কলেজের সহযোগী ফেলো ব্রুডেরিক ম্যাকডোনাল্ড বলেছিলেন, তাদের (আসাদ বাহিনী) মধ্যে হতাশার মাত্রা স্পষ্ট এবং তারা শক্ত ঘাঁটির চারপাশে প্রতিরোধ কেন্দ্রীভূত করছে। এখন বড় প্রশ্ন হলো, ইরান ও রাশিয়া কী করতে চলেছে।
গৃহযুদ্ধ চলাকালে মস্কোর অস্ত্র ও সামরিক সমর্থনের জোয়ারে সবকিছু প্রেসিডেন্ট আসাদের পক্ষে চলে গিয়েছিল। কিন্তু এবার রাশিয়া নিজেই ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। তবে মিত্রের হাত একেবারে ছেড়ে দেয়নি মস্কো, তেহরানও নয়। যদিও ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে তেহরানেরও অনেক শক্তিক্ষয় হয়ে গেছে। কয়েক দশক ধরে সিরিয়ায় আসাদ পরিবারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে ইরান।
ইরানসমর্থিত লেবাননের সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ গৃহযুদ্ধের সময় আসাদ বাহিনীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করেছিল। সম্প্রতি ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়ে হিজবুল্লাহর নেতৃত্ব ধ্বংস হয়ে গেছে, শক্তিও ক্ষয় হয়ে গেছে অনেকটা।
২০১১ সালে গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এমন অনেক পরিস্থিতি আসাদের জয়ের পক্ষে জোরালো ভূমিকা রেখেছিল। কিন্তু এবার বাইরের মিত্রদের থেকে আসাদ সেই সমর্থন পাননি।
মিত্রদের সমর্থন ছাড়া আসাদ যে কতটা দুর্বল, তা প্রমাণিত হয়ে গেছে। এখন উপসাগরীয় দেশগুলো কার পক্ষ নেয়, সেটাই দেখার বিষয়।
উপসাগরীয় দেশগুলো বেশির ভাগ সময় তাদের অচেনা কারও চেয়ে বরং চেনা শয়তানকে সমর্থন দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। তার ওপর এইচটিএসের গায়ে চরমপন্থী ট্যাগ আছে। তারা একসময় সন্ত্রাসী সংগঠন আল-কায়দার অংশ ছিল।
এ সপ্তাহান্তে বাহরাইন ও কাতারে ওই অঞ্চলের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের দুটি সম্মেলন রয়েছে। সেখানে সিরিয়ার উদ্ভূত পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হতে পারে।