‘আমি নিতান্তই কোনো সংখ্যা হতে চাই না, আমি গাজার এক বাস্তব গল্প’

গাজায় কাটানো দুর্বিষহ জীবন নিয়ে লিখেছেন সেখানকার বাসিন্দা রুওয়াইদা আমির। ক্রমাগত ইসরায়েলি বোমা হামলার আতঙ্ক আর ভবিষ্যতে কী হবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তার মধ্যে কাটানো জীবনের কথা উঠে এসেছে তাঁর লেখায়। আল–জাজিরায় প্রকাশিত তাঁর লেখাটি ভাষান্তর করে প্রথম আলোর পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো।

রুওয়াইদা আমির গাজায় ১০ বছর শিক্ষকতা করেছেন।ছবি: আল–জাজিরার এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে নেওয়া

মৃত্যুকে এত কাছ থেকে দেখতে পাব, তা আমার ধারণায় ছিল না। আমি ভাবতাম, মৃত্যু হুট করেই আসে, আমরা এটা অনুভব করতে পারি না। তবে এ যুদ্ধ চলাকালে তারা ধীরে ধীরে আমাদের সব পরিস্থিতিরই মুখোমুখি করেছে।

ঘটনা ঘটার আগেই আমরা ভুগছি। যেমন বাড়িতে বোমা হামলার আশঙ্কা আমাদের আষ্টেপৃষ্ঠে রেখেছে।

শুরু হওয়া সে যুদ্ধ এখনো আছে, কিন্তু ভয়ের সেই অনুভূতি ভেতরে চাপা থেকে গেছে। এই ভয় আমার হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছে। এমনকি আমার মনে হচ্ছে, এটা আর কোনো ধকল নিতে পারবে না।

যুদ্ধ শুরুর পর থেকে আমাদের অনেক কাছাকাছি চলে আসা ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে সামলাতে আমি হিমশিম খাচ্ছি। আমার মনে আছে, যখন নেতজারিম এলাকা থেকে ট্যাংকগুলো ঢুকছিল, তখন আমি স্তম্ভিত হয়ে আমার সব বন্ধুর কাছে একটি বার্তা পাঠিয়েছিলাম: ‘তারা গাজায় কীভাবে ঢুকল? আমি কি স্বপ্ন দেখছি?!’

তারা কবে গাজা থেকে সরবে, এটি আবার কবে মুক্ত হবে, সে অপেক্ষায় আছি আমি।

এখন আমি যেখানে থাকি, সেই আল–ফুখারি এলাকার খুব কাছে চলে এসেছে ইসরায়েলি সেনারা। খান ইউনিসের পূর্বে এবং রাফার উত্তরে এর অবস্থান। এটি এমন একটি জায়গা, যেখানে খান ইউনিস এলাকার শেষ এবং রাফার শুরু।

তারা এতটাই কাছে চলে এসেছে যে আমরা প্রতিনিয়ত ভয়াবহ বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে বাধ্য হচ্ছি, আমাদের অবিরাম সেসব শব্দ শুনতে হচ্ছে।

এ যুদ্ধ ভিন্ন ধরনের। আমার আগের অভিজ্ঞতার চেয়ে এটা অনেকটাই আলাদা।

আমি নিতান্তই একটা সংখ্যা হতে চাই না।

মৃতদের ‘অজ্ঞাত ব্যক্তি’ হিসেবে উল্লেখ করা বা গণকবরে শুইয়ে দিতে দেখার পর থেকে আমার মাথায় বিষয়টা গেঁথে আছে। এর মধ্যে কিছু কিছু অঙ্গপ্রত্যঙ্গও আছে, যা শনাক্তই করা যায়নি।

এটা কি সম্ভব যে আমার কাফনের ওপর শুধু ‘কালো/নীল ব্লাউজ পরা তরুণী’ লেখা থাকবে?

আমি কি ‘অজ্ঞাত ব্যক্তি’ হিসেবে মারা যাব, শুধুই একটি সংখ্যা হিসেবে?

আমি চাই, আমার আশপাশে থাকা প্রত্যেকে আমার গল্প মনে রাখুক। আমি কোনো সংখ্যা নই।

আমি সেই মেয়ে যে কিনা গাজায় কঠোর অবরোধ চলাকালে অন্য রকম পরিস্থিতিতে হাইস্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে বাবাকে সহযোগিতা করার জন্য সব জায়গায় কাজ খুঁজছিলাম। কারণ, অবরোধের কবলে পড়ে আমার বাবা সর্বস্বান্ত হয়ে পড়েছিলেন এবং বেশ কয়েকবার চাকরি হারিয়েছেন।

আমি আমার পরিবারের বড় মেয়ে এবং আমি আমার বাবাকে সহযোগিতা করতে চাই। আমি চাই আমাদের থাকার জন্য একটি ভালো বাড়ি থাকুক।

অপেক্ষা করুন...আমি কিছুই ভুলতে চাই না।

আমি একজন শরণার্থী। আমার দাদা-দাদি শরণার্থী ছিলেন। ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলি দখলদারির কারণে তাঁদের নিজের জমি ছেড়ে চলে যেতে হয়েছিল।

আমার দাদা-দাদি গাজা উপত্যকায় যান এবং শহরের পশ্চিমে খান ইউনিসে শরণার্থীশিবিরে থাকতেন।

ওই শিবিরে আমার জন্ম, তবে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আমাকে সেখানে জীবন কাটাতে দেয়নি।

২০০০ সালে ইসরায়েলি বাহিনী আমাদের বাড়ি গুঁড়িয়ে দিয়েছে। দুই বছর আমাদের আশ্রয়হীন থাকতে হয়েছে। আমরা বসবাসের অযোগ্য একটি বাড়ি থেকে আরেকটিতে স্থানান্তরিত হতে থাকলাম। ২০০৩ সালে আইএনআরডব্লিউএ আল–ফুখারিতে আমাদের আরেকটি বাড়ি না দেওয়া পর্যন্ত এমন অবস্থাই চলতে থাকল।

কৃষিজমিতে ভরা এই এলাকা দারুণ। আমরা সেখানে জীবন গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। যেখানটায় আমরা থাকতাম, তার নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ইউরোপিয়ান হাউজিং’। সেখানে অবস্থিত ইউরোপিয়ান হাসপাতালের নামানুসারে এর নামকরণ করা হয়।

বাড়িটি ছোট ছিল। মা-বাবাসহ পাঁচজনের পরিবারের জন্য তা যথেষ্ট ছিল না। বাড়িতে বাড়তি রুমের প্রয়োজন ছিল, একটি লিভিং রুমের প্রয়োজন ছিল। রান্নাঘরে সংস্কার করানোর দরকার ছিল।

যা–ই হোক, প্রায় ১২ বছর আমরা সেখানে ছিলাম। যতটা তাড়াতাড়ি সম্ভব, ২০১৫ সালের দিকে আমি বাবাকে সহযোগিতা করার জন্য কাজ শুরু করলাম। আরাম করে থাকার মতো একটি বাড়ি বানাতে আমি তাঁকে সাহায্য করলাম। হ্যাঁ, আমরা সেটা করতে পেরেছিলাম। তবে তা খুব কষ্টসাধ্য ছিল। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামলা শুরুর মাত্র তিন মাস আগে আমাদের বাড়ি তৈরির কাজ শেষ হয়।

হ্যাঁ, আমাদের আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী প্রায় ১০ বছর ধরে তিলে তিলে আমরা বাড়িটি পুনর্নির্মাণ করেছি। যুদ্ধ শুরু হওয়ার ঠিক আগে আমরা বাড়ির কাজ শেষ করি।

যুদ্ধ শুরুর আগেই গাজায় অবরুদ্ধ অবস্থা ও দুর্বিষহ জীবন নিয়ে আমি হিমশিম খাচ্ছিলাম। এরপর যুদ্ধ আমাকে পুরোপুরি নিঃশেষ করে দিল, আমার হৃদয়কে দুমড়ে–মুচড়ে দিল এবং আমি আমার মনোযোগের কেন্দ্র হারিয়ে ফেললাম।

যুদ্ধ শুরুর পর থেকে আমরা কিছুর জন্য লড়াই চালাচ্ছি। টিকে থাকার জন্য লড়ছি, ক্ষুধা বা তৃষ্ণায় যেন মারা না যাই, তার জন্য লড়ছি। যেসব ভয়াবহতা আমরা দেখছি, তার জন্য যেন মনোবল না হারিয়ে ফেলি, সেটা নিশ্চিত করার জন্য সংগ্রাম করছি।

আমরা যেকোনো উপায়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা করি। আমরা বারবার বাস্তুচ্যুত হয়েছি। আমার জীবনে আমি চারটি বাড়িতে থেকেছি এবং কাছাকাছি জায়গায় ইসরায়েলি বোমা হামলার ঘটনায় প্রতিটি বাড়িই ধ্বংস হয়েছে।

আমাদের থাকার কোনো নিরাপদ জায়গা নেই। যুদ্ধবিরতির আগে আমরা ৫০০ দিন আতঙ্কে কাটিয়েছি।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে যুদ্ধের সময় আমি যা করিনি, তা হলো কান্না। আমি শক্ত থাকার চেষ্টা করেছি এবং আমার দুঃখ ও রাগ ভেতরে চেপে রেখেছি। এতে আমার হৃৎপিণ্ডের ওপর চাপ পড়েছে, এটি আরও দুর্বল হয়ে গেছে।

আমি আমার চারপাশে যাঁরা ছিলেন, তাঁদের সবার প্রতি ইতিবাচক ছিলাম এবং সমর্থন দিয়েছিলাম। হ্যাঁ, উত্তরের মানুষেরা ফিরে আসবে। হ্যাঁ, সেনাবাহিনী নেতজারিম থেকে সরে যাবে। আমি সবাইকে সাহস জোগাতে চেয়েছিলাম, যদিও আমার ভেতরে একটা বিরাট দুর্বলতা ছিল, যা আমি দেখাতে চাইনি।

আমার মনে হয়েছিল, যদি এটি দেখিয়ে ফেলি, তাহলে আমি এই ভয়াবহ যুদ্ধে শেষ হয়ে যাব।

যুদ্ধবিরতি ছিল আমার বেঁচে থাকার বড় আশা। আমার মনে হয়েছিল, আমি টিকে গেছি। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে।

২০২২ সালে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে রুওয়াইদা আমির
ছবি: আল–জাজিরার এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে নেওয়া

যখন লোকেরা ভাবছিল, যুদ্ধ কি আবার ফিরে আসবে? আমি তখন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উত্তর দিয়েছিলাম, ‘না, আমার মনে হয় না, এটি আবার ফিরবে। যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে।’

যুদ্ধ ফিরে এসেছে এবং আগের চেয়ে বেশি আমার কাছাকাছি চলে এসেছে। অবিরাম গোলাবর্ষণের কারণে ক্রমাগত ভয় নিয়ে বেঁচে আছি। তারা আমাদের বিরুদ্ধে সব ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করেছে—রকেট, বিমান ও ট্যাংকের গোলা। ট্যাংক থেকে অবিরাম গোলাবর্ষণ হয়, নজরদারি ড্রোন উড়তে থাকে, সবকিছুই ভয়ংকর।

আমি এক সপ্তাহের বেশি সময় ধরে সত্যিই ঘুমাইনি। তন্দ্রার ভাব হলেই বিস্ফোরণের শব্দে জেগে উঠি এবং দৌড়াতে থাকি। কোথায় যেতে চাইছি তা জানা থাকে না, কিন্তু আমি ঘরের ভেতর দৌড়াতে থাকি।

একনাগাড়ে আতঙ্কিত হতে হতে আমি আমার বুকের ওপর হাত দিয়ে ভাবি, এই হৃৎপিণ্ড আর বেশি সইতে পারবে কি না।

এ জন্য আমি আমার সব বন্ধুকে একটি বার্তা পাঠিয়েছি। আমি তাদের বলেছি, আমার গল্পটি নিয়ে কথা বলতে যেন আমি নেহাতই একটি সংখ্যা না হয়ে যাই।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আমার আশপাশের এলাকা ধ্বংস করে দেওয়ায় আমরা অসহনীয় দিন কাটাচ্ছি। এখানে এখনো অনেক পরিবার বাস করছে। তারা চলে যেতে চায় না, কারণ বাস্তুচ্যুত হওয়ার বিষয়টি মানুষকে শারীরিক, আর্থিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত করে দেয়।

আমার মনে আছে, প্রথম বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঘটনাটি ছিল ২০০০ সালে। তখন আমার বয়স ছিল প্রায় আট বছর।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর বুলডোজার খান ইউনিস আশ্রয়শিবিরে এসে আমার চাচার ও দাদার বাড়ি ধ্বংস করে দেয়। তারপর কোনো কারণে এগুলো আমাদের বাড়িতে এসে থেমে যায়। আমরা চলে গেলাম। ওই সময় পবিত্র রমজান মাস ছিল এবং আমার মা–বাবা ভেবেছিলেন যে আমরা পরে ফিরে আসতে পারব। আমাদের সাময়িকভাবে আশ্রয়ের জন্য তাঁরা একটি জরাজীর্ণ ঘরের সন্ধান পান।

আমরা যে আমাদের বাড়ি হারিয়েছি, এটা আমি মেনে নিতে পারিনি। তাই আমি সেই বাড়িতে ফিরে যেতাম যেখানে আমার দাদা-দাদির সঙ্গে কাটানো সুন্দর স্মৃতিগুলো ছিল। আমি কিছু জিনিসপত্র নিয়ে মাকে দিয়েছিলাম।

ঈদের আগের রাতে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আমাদের বাড়ি গুঁড়িয়ে দিল। ঈদুল ফিতরের প্রথম দিনে আমি ও আমার পরিবার সেখানে গেলাম। নতুন জামাকাপড় পরে ধ্বংসস্তূপে ঈদ উদ্‌যাপনের কথা আমার মনে পড়ে।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী আমাদের কিছুই রাখতে দিচ্ছে না। তারা সবকিছু ধ্বংস করে দিচ্ছে। আমাদের মনে যন্ত্রণা ছাড়া আর কিছুই তারা অবশিষ্ট রাখছে না। ভয়াবহ এই সেনাবাহিনীর হাত থেকে বিশ্ব যদি আমাদের না বাঁচায়, তাহলে ভবিষ্যতে কী হবে, আমার জানা নেই। জানি না, আমার হৃৎপিণ্ড অবিরত চলা এসব শব্দ আর বেশি নিতে পারবে কি না।

আমাকে কখনো ভুলে যাবেন না। আমি আমার জীবনের জন্য কঠিন লড়াই লড়েছি। সাংবাদিক ও শিক্ষক হিসেবে ১০ বছর আমি কঠোর পরিশ্রম করেছি, নিজেকে নিবেদিত করেছি।

আমার শিক্ষার্থীদের আমি ভালোবাসি। সহকর্মীদের সঙ্গে আমার সুন্দর স্মৃতি আছে।

গাজায় জীবনযাপন কখনোই সহজ নয়। তবে আমরা এটাকে ভালোবাসি। অন্য কোনো বাসভূমিকে আমরা ভালোবাসতে পারি না।