২২টি স্কুল ফিরিয়ে দিয়েছিল, তাই সন্তানের জন্য নিজেই গড়লেন বিশেষ স্কুল
অটিস্টিক সন্তানকে ভর্তি করাতে এই স্কুল থেকে সেই স্কুলে ঘুরেছেন এক নারী। কিন্তু কোথাও কেউ তাঁকে আশার বাণী শোনায়নি। এক এক করে ২২টি স্কুল তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে। সেই নারী আজ নিজেই বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য একটি স্কুল গড়ে তুলেছেন, যাতে তাঁর সন্তানের মতো অন্যদের এমন অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে না হয়।
সিরিয়ার এই নারীর নাম রানা আক্কাদ। তিনি দুবাইয়ে বসবাস করেন। গালফ নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, আমার ছেলে জাদ আতাসিকে ২২টি স্কুল থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে। আমি সস্তা, নামীদামি, নিম্নমানের সব ধরনের স্কুলে চেষ্টা করেছি। এমনকি আমি তাকে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য তৈরি সেন্টারেও রাখতে চেয়েছি। কিন্তু সেখানে সে শারীরিকভাবে অনেক পিছিয়ে পড়ছিল। তার কথা বলা ও আচরণগত কিছু সমস্যা ছিল, কিন্তু শারীরিক কোনো অক্ষমতা ছিল না।’
২২ বছর আগে দুবাইয়ে আসা রানা বলেন, তিনি খেয়াল করলেন, জাদের যখন দেড় বছর বয়স, তখন সে কারও সঙ্গে মেশে না, চোখের দিকে তাকায় না। সে মা-বাবা, বল ও হ্যালো বলতে পারত, পুতুল ধরতে পারত, কিন্তু হঠাৎ করে সেগুলো নাই হয়ে গেল। ছেলের চোখে আনন্দের সেই ঝলকানি তিনি আবার দেখেছিলেন যখন তিনি তাঁর সন্তানের মতো বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য সেন্টার খোলেন, তখন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে দুই বছর পর জাদ হঠাৎ মারা যায়। তখন তার বয়স ছিল ১১ বছর।
নিজের প্রয়োজনে ঘুরে দাঁড়ানো
ছেলের মৃত্যুর পর আগেকার ঘটনা বলতে গিয়ে রানা বলেন, নিজেরা বুঝতে পারলেও একসময় ক্লিনিক্যালি বলা হলো, জাদ অটিজমে আক্রান্ত। ধীরে ধীরে পরিবার এ পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নেয়। কিন্তু তাকে স্কুলে ভর্তি করাটা ছিল কঠিন যুদ্ধ। রানা বলেন, ২২ বার প্রত্যাখ্যাত হওয়ার পর সর্বশেষ সে স্কুলে ভর্তির সুযোগ পেলেও এর পরের সংগ্রামও কম কঠিন ছিল না।
যে স্কুলে জাদ ভর্তি হয়েছিল, সেটি কয়েক বছর পর কর্তৃপক্ষ বন্ধ করে দিয়েছিল। রানা বলেন, তিনি সব সময় স্কুলটি নিয়ে নিজের অভিজ্ঞতা অন্যদের সঙ্গে শেয়ার করতেন। প্রথম কয়েকটি বছরের সুন্দর সময়ের কথা স্মরণ করেন রানা। বলেন, ‘জাদ তার শ্যাডো শিক্ষকদের সঙ্গে ক্লাসে যাওয়ায় অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। বাচ্চারা সব সময় তাকে সঙ্গে রাখত। তাদের কাছে জাদের পরিচয় ছিল, এই ছেলেটি ইংরেজি বলতে পারে, কী নিষ্পাপ শিশুদের চিন্তাভাবনা। কিন্তু কিছুদিন পর দেখা গেল, তারা আর জাদের সঙ্গে মিশছে না। আমি তাকে নিয়ে একদিন স্কুল থেকে ফিরছিলাম। হেঁটে আসার সময় দেখলাম, কিছুটা আসার পর সে দাঁড়িয়ে গেছে। ডাকলেও তাকাচ্ছিল না। অন্যদিকে তাকিয়ে ছিল। তার দৃষ্টিকে অনুসরণ করে দেখলাম, তার সব বন্ধু একটি গাড়িতে করে তাদের আরেক বন্ধুর বাড়িতে যাচ্ছে। আমার ছেলের চোখে সেদিন যে কষ্ট আমি দেখেছিলাম, তা দেখে আমি মরে যাচ্ছিলাম।’
এটি ছিল সেই মুহূর্ত, যখন রানা ঠিক করেছিলেন, তাঁকে জাদ ও জাদের মতো অন্য শিশুদের জন্য কিছু করতে হবে।
নিরাপদ জায়গা গড়ে তোলা
রানা বলেন, ‘আমি বুঝতে পারলাম, মূলধারার স্কুলে ভর্তি করানোর এই লড়াই আসলে জাদের জন্য নয়; বরং আমি নিজের আত্মসম্মান রক্ষার জন্য করছি। আমি শিখলাম, একজন মা তার সন্তানের জন্য আকাশ-পাতাল সব এক করে দিতে পারে, কিন্তু নিজের সন্তানের বন্ধু হওয়ার জন্য অন্য শিশুদের ঘুষ দিতে বা বাধ্য করতে পারে না। আমি উপলব্ধি করলাম, আমার এ লড়াই আদতে ভুল। তখনই আমি মনস্থির করলাম, ছেলের জন্য একটি নিরাপদ জায়গা গড়ে তুলতে হবে।’
চার বছরের শিক্ষা, পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির পর ২০১৬ সালের অক্টোবরে রানা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের জন্য ‘মডার্ন অলটারনেটিভ এডুকেশন’ সেন্টার চালু করেন। ছেলেসহ মোট ১১ শিক্ষার্থী ছিল সেখানে। কিন্তু জাদ তখন বিষণ্নতার চরম পর্যায়ে। নতুন এ পরিবেশ তার মুখে হাসি ফুটিয়েছিল। তার মতো অন্যদের সে ওখানে বন্ধু হিসেবে পেল।
মনোবল বাড়িয়ে দিয়েছিল
দুঃখজনকভাবে দুই বছর পর জাদ হঠাৎ মারা যায়। তখন তার বয়স ছিল ১১ বছর। রানা বলেন, জাদের মৃত্যুর সঙ্গে অটিজমের কোনো সম্পর্ক নেই। অন্য দিনের মতো সে সেদিন স্বাভাবিকভাবে ঘুমিয়েছিল, কিন্তু আর জেগে ওঠেনি। এটি ছিল সাডেন ইনফ্যান্ট ডেথ, কিশোর বয়সে যা বিরল। কিন্তু ছেলের এই মৃত্যুশোককে রানা শক্তিতে পরিণত করেছেন। সেন্টারটিকে নতুন উদ্যমে চালু করেন। আগের নাম পাল্টে নতুন নাম দেন জাদ’স ইনক্লুশন। (Jad’s Inclusion.)
রানা বলেন, ‘এই সেন্টারের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। জাদকে হারানোর পরও আমি এটি চালিয়ে যেতে পেরেছি। আমি আমাকে বোঝাতে থাকি, জাদ ছিল দেবদূত, সে শুধু তার মতো শিশুদের জন্য একটি জায়গা তৈরি করে দিতে এসেছিল। আর এটা হয়ে যাওয়ার পর সে বিদায় নিয়েছে। আর এ কারণে এই সেন্টার বন্ধ করে দেওয়ার মতো কোনো চিন্তা আমার মাথায় আসেনি। আমি তার ১২তম জন্মদিনে ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি সেন্টারের নাম মডার্ন অলটারনেটিভ এডুকেশন থেকে “জাদ’স ইনক্লুশন” রাখি এবং সেদিন আমি তার স্মরণে ক্যাম্পাসে একটি জলপাইগাছ রোপণ করি।’
সেন্টারে কী আছে
রানা বলেন, সেপ্টেম্বর থেকে জুলাই পর্যন্ত প্রতি সোম থেকে শুক্রবার সকাল সাড়ে আটটা থেকে বেলা আড়াইটা পর্যন্ত সেন্টারটি খোলা থাকে। দুপুর ১২টা পর্যন্ত তাদের গণিত, ইংরেজি ও বিজ্ঞান—এই মৌলিক বিষয়গুলো পড়ানো হয়। এরপর তাদের কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দক্ষতা এবং পেশাগত প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
এখানে একসঙ্গে সর্বোচ্চ ৪০ শিক্ষার্থী রাখার সুযোগ আছে। সেন্টারের লক্ষ্য শিক্ষার্থীদের দীর্ঘদিন এখানে ধরে রাখা নয়; বরং তাদের মূলধারার স্কুল বা চাকরিতে অন্তর্ভুক্ত করা। আর এটি হয়ে থাকে এএসডিএএন এবং ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রামের মাধ্যমে।
এ সেন্টারের বিশেষত্ব হচ্ছে, এর ছোট ক্লাসরুম এবং শিক্ষার্থীদের তুলনায় শিক্ষকের অনুপাত। প্রতিটি ক্লাসে ছয়-আটজন শিক্ষার্থী থাকে এবং তাদের সাথে তিন-চারজন স্টাফ সদস্য থাকে। সেখানে একজন বিশেষ এডুকেশনাল নিড শিক্ষক, একজন সহকারী শিক্ষক এবং অন্তত একজন বা দুজন শ্যাডো শিক্ষক থাকে। বর্তমানে ২৫ শিশুর বিপরীতে ২০ জন স্টাফ সদস্য আছেন।
এখানে ভর্তির যোগ্যতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে রানা বলেন, প্রচলিত ব্যবস্থায় যেসব শিশুকে মানিয়ে নিতে লড়াই করতে হচ্ছে, তাদের জন্য এ সেন্টার। তিনি বলেন, ‘আমরা বিনা মূল্যে শিশুদের মূল্যায়ন করি। এরপর তাদের মা–বাবাকে শিশুদের মূলধারার শিক্ষাব্যবস্থায় রাখার পরামর্শ দিই, যতক্ষণ না শিশু সেখানে মানসিক আঘাত না পায়।’
জাদের মা বলেন, ‘আমরা অনেক শিশুকে অন্যান্য সেন্টারেও পাঠানোর পরামর্শ দিয়ে থাকি, যেগুলো একাডেমিক দিক থেকে আমাদের তুলনায় কম চ্যালেঞ্জিং। বিশেষ চাহিদার ক্ষেত্রটি বিস্তৃত। আর এখানে সবকিছু সবার জন্য জুতসই নয়, এটা নিশ্চিত।’
রানা বলেন, জাদকে যে স্কুলে মানানসই মনে করা হয়নি, তার মানে এই নয় যে স্কুলটি খারাপ ছিল। তারা জাদের দক্ষতার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেনি। জাদ’স ইনক্লুশন সেন্টার এমন শিশুদের নিয়ে কাজ করে, যাদের প্রতিবন্ধকতাও এতটা গুরুতর নয় যে তাদের বিশেষ সেন্টারের প্রয়োজন। সেন্টার সেই জিনিসগুলো নিয়ে কাজ করতে চায়, যা মূলধারার স্কুলে নেই।