আল-জাজিরার বিশ্লেষণ
আইসিসি কি নেতানিয়াহু ও হামাস নেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করবেন
কয়েক মাস ধরে তথ্যপ্রমাণ সংগ্রহের পর আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রধান কৌঁসুলি করিম খান ইসরায়েল ও হামাসের শীর্ষ নেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন করেছেন।
গত সোমবার আবেদনটি করেন করিম খান। এদিনই একটি বিবৃতি দিয়ে তিনি তাঁর এই পদক্ষেপের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। বলেছেন, গাজায় ইসরায়েলের যুদ্ধের শুরু থেকে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট উপত্যকাটিতে যুদ্ধাপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের জন্য দায়ী বলে বিশ্বাস করার যুক্তিসংগত কারণ তাঁর কাছে রয়েছে।
গাজায় নির্বিচার হামলা চালিয়ে প্রায় ৩৬ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েল।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে গাজায় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের একটি পদ্ধতি হিসেবে ক্ষুধাকে ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে। পাশাপাশি গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃতভাবে আক্রমণ পরিচালনা, ফিলিস্তিনিদের নির্মূল বা হত্যাকাণ্ড তদারকির অভিযোগ রয়েছে।
করিম খান হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার, মোহাম্মদ দেইফ ও ইসমাইল হানিয়াকে গত ৭ অক্টোবর ইসরায়েলিদের বিরুদ্ধে অপরাধ তদারকির জন্য অভিযুক্ত করেছেন। ৭ অক্টোবর দক্ষিণ ইসরায়েলে হামাসের হামলায় ১ হাজার ১৩৯ জন নিহত হন। তারা ২৫০ জনকে আটক করে নিয়ে যায়।
হামাসের নেতাদের যেসব অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করা হতে পারে, তার মধ্যে আছে হত্যা, নির্মূল, জিম্মি করা, নির্যাতন ও অন্যান্য অমানবিক কাজের তত্ত্বাবধান করা।
নেতানিয়াহু ও গ্যালান্টকে নিশানা করে করিম খান যে ঘোষণাটি দিয়েছেন, তা সম্ভবত সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ, প্রথমবারের মতো আইসিসির প্রধান কৌঁসুলি যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র ইসরায়েলের নেতাদের অভিযুক্ত করার চেষ্টা করছেন।
আইসিসি কি করিম খানের আবেদন গ্রহণ করবেন
আগামী কয়েক মাস নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত আইসিসির প্রাক্-বিচার চেম্বারের বিচারকদের একটি প্যানেল এই গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির বিষয়ে করিম খানের করা আবেদন পর্যালোচনা করবেন।
কিংস কলেজ লন্ডনের আন্তর্জাতিক আইনের বিশেষজ্ঞ আলোনসো গুরমেন্ডি আল-জাজিরাকে বলেন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন গ্রহণ না করার অতীত নজির আছে। তবে তা বিরল। কিন্তু তিনি আশা করেন, ইসরায়েল ও হামাস নেতাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনুমোদন পাবে।
গুরমেন্ডি ব্যাখ্যা করে বলেন, প্রাক্-বিচার চেম্বারে এই বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হতে হবে যে উল্লিখিত ব্যক্তিরা আইসিসির এখতিয়ারভুক্ত অপরাধ করেছেন বলে যুক্তিসংগত কারণ রয়েছে।
অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে সংঘটিত সব অপরাধের বিচারের ব্যাপারে আইসিসিকে ২০১৫ সালে এখতিয়ার দেওয়া হয়েছিল।
গুরমেন্ডি আল-জাজিরাকে বলেন, গাজায় যা ঘটছে, তা দৃশ্যমান অপরাধমূলক কাজ। করিম খান যা বর্ণনা করেছেন, তা সবাই দেখছে। তিনি অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আচরণ ও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদনের মধ্যে কোনো অসংগতি দেখতে পাচ্ছেন না।
গুরমেন্ডি আরও বলেন, এই বিষয়ে আশঙ্কা আছে, ইসরায়েলের মিত্ররা ইসরায়েলি নেতাদের ব্যাপারে করিম খানের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির অনুরোধ প্রত্যাখ্যানে বিচারকদের ওপর চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করতে পারে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচের আন্তর্জাতিক বিচার কার্যক্রমের সহযোগী পরিচালক বাল্কিস জারাহ একই রকম উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।
আল-জাজিরার কাছে পাঠানো এক বিবৃতিতে জারাহ বলেন, আইসিসির সদস্যদেশগুলোকে এই আদালতের স্বাধীনতা রক্ষায় দৃঢ়ভাবে প্রস্তুত হওয়া উচিত। কারণ, আইসিসির বিচারকেরা যখন করিম খানের আবেদন বিবেচনা করবেন, তখন তাঁদের ওপর বৈরী চাপ বাড়তে পারে।
হামাস ও ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া
হামাসের নেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির বিষয়ে করিম খানের আবেদন বাতিলের আহ্বান জানিয়েছে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস। এক বিবৃতিতে সংগঠনটি বলেছে, আইসিসির প্রধান কৌঁসুলি জল্লাদদের সঙ্গে ফিলিস্তিনি ভুক্তভোগীদের সমান বলে গণ্য করছেন।
নেতানিয়াহুসহ ইসরায়েলি রাজনীতিবিদেরাও করিম খানের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন। নেতানিয়াহু বলেছেন, গণতান্ত্রিক ইসরায়েল ও হামাসের গণহত্যাকারীদের মধ্যে আইসিসির প্রধান কৌঁসুলির তুলনা তিনি ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছেন।
ইসরায়েলের যুদ্ধকালীন মন্ত্রিসভার সদস্য বেনি গ্যান্টজ, অতি ডানপন্থী মন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ ও ইতামার বেন-গভিরও করিম খানকে আক্রমণ করেছেন। তাঁর বিরুদ্ধে ইহুদি বিরোধিতার অভিযোগ এনেছেন বেজালেল ও ইতামার। তবে এই অভিযোগকে ফাঁপা বলে অভিহিত করেন গুরমেন্ডি।
গুরমেন্ডি আল-জাজিরাকে বলেন, আইসিসি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে। আর তা হচ্ছে ইসরায়েল ও হামাস উভয় পক্ষের নেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আবেদন জমা দেওয়া। এই উদ্যোগ করিম খান বা আইসিসি ইহুদিবিরোধী ও হামাসপন্থী বলে ইসরায়েলের তোলা অভিযোগকে নাকচ করে দেয়।
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির অনুরোধ প্রত্যাখ্যানের বিষয়ে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। অন্যদিকে দক্ষিণ আফ্রিকা করিম খানের পদক্ষেপকে সমর্থন করেছে।
করিম খানের আবেদনের পরিণতি কী
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে তা অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জন্য বাস্তবিক ও প্রতীকী পরিণতির কারণ হতে পারে। সে ক্ষেত্রে তাঁরা যদি আইসিসির সদস্যদেশগুলোতে যান, তাহলে গ্রেপ্তার হতে পারেন।
তবে হামাস বা ইসরায়েলি নেতারা আদালতের হেফাজতে না থাকলে তাঁরা বিচারের মুখোমুখি হবেন না। তা ছাড়া আইসিসির অধীন এমন কোনো বাহিনীও নেই, যারা যে কাউকে গ্রেপ্তার করার ক্ষমতা রাখে।
সিনওয়ার ও দেইফ গাজায় লুকিয়ে আছেন। হানিয়া থাকেন কাতারে। কাতার আইসিসির সদস্য নয়।
অতীতে আন্তর্জাতিক আইনি সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করার নজির আছে ইসরায়েলের।
যেমন ২০০৪ সালে জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসের পরামর্শমূলক মতামতে ইসরায়েলের বিভাজক প্রাচীরকে বেআইনি বলে উল্লেখ করা হয়েছিল।
এই ঘটনার দুই দশক পর গত জানুয়ারিতে আইসিজের জারি করা অস্থায়ী ব্যবস্থাকেও তোয়াক্কা করেনি ইসরায়েল। আইসিজে গাজার বেসামরিক লোকদের জন্য সাহায্য বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন।
গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হলে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া যেমনই হোক না কেন, নেতানিয়াহু-গ্যালান্টরা ইসরায়েলের বাইরে ব্যাপক পরিসরে ভ্রমণ করতে পারবেন না।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রে গেলে গ্রেপ্তারের ঝুঁকির মুখে না-ও পড়তে পারেন। কারণ, দেশটি রোম সংবিধির পক্ষভুক্ত নয়। এই চুক্তিটির ভিত্তিতেই আইসিসি প্রতিষ্ঠিত হয়।
কিছু পর্যবেক্ষক আশঙ্কা করছেন, আইসিসির যেসব সদস্য ইসরায়েলের মিত্র, যেমন জার্মানি, যুক্তরাজ্য, তারাও রোম সংবিধির বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করতে পারে। তারাও নেতানিয়াহু বা গ্যালান্টকে গ্রেপ্তার না-ও করতে পারে।
গুরমেন্ডি বলেন, এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি মুহূর্ত। আন্তর্জাতিক অপরাধমূলক বিচার প্রকল্পের জন্য এটি একটি অগ্নিপরীক্ষা।
গুরমেন্ডি বলেন, গাজায় ইসরায়েল যা করছে, তাকে সমর্থন দিতে গিয়ে পশ্চিমা দেশগুলো ভণ্ডামির কোন স্তরে তলিয়ে যেতে ইচ্ছুক? পশ্চিম বিশ্বকে সত্যিই একটা দিক বেছে নিতে হবে। তারা কি আন্তর্জাতিক ফৌজদারি বিচারকে সমুন্নত রাখতে চায়, নাকি স্বার্থের রাজনীতি করতে চায়?