গাজায় রক্তপাত বন্ধে মুসলিম দেশগুলো কে কী করছে
ইসরায়েল–ফিলিস্তিন সংঘাত চলছে প্রায় ৭৫ বছর ধরে। সেই ধারাবাহিকতায় গাজা আবারও রক্তাক্ত। সেখানে ইসরায়েলি বাহিনীর নির্বিচার হামলায় প্রতিদিন প্রাণ হারাচ্ছে শত শত মানুষ। ইসরায়েলের এই নৃশংস আক্রমণ থেকে ফিলিস্তিনিদের রক্ষায় মুসলিম দেশগুলো কি যথাযথ ভূমিকা রাখতে পেরেছে, সেই প্রশ্ন উঠেছে। অনেকের মতে, শুধুই নিন্দা জ্ঞাপন ও ইসরায়েলিদের গালমন্দের মধ্যেই দৃশ্যত মুসলিম দেশগুলোর ভূমিকা সীমাবদ্ধ।
আরবের তেল ও গ্যাস উৎপাদনকারী দেশগুলো ১৯৭৩ সালে ইয়ম কিপুর যুদ্ধের সময় ইসরায়েলকে সহায়তা করা দেশগুলোতে জ্বালানি বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। তারা এবার অন্তত তেলের উৎপাদন কমিয়ে দিতে পারত, যাতে বেড়ে যেত তেলের দাম। কিন্তু এর কোনোটিই তারা করেনি।
এই প্রথম আঞ্চলিক কোনো যুদ্ধের পর তেলের দাম না বেড়ে উল্টো কমেছে। গত ২০ ডিসেম্বরের হিসেব অনুযায়ী ব্যারেল প্রতি অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম ৮২ ডলার থেকে কমে ৭৪ ডলার হয়েছে।
আরব দেশগুলোর এই ভূমিকা নিয়ে ফিলিস্তিনিদের হতাশার প্রকাশ ঘটেছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে। আল–জাজিরার রাজনৈতিক বিশ্লেষক মারওয়ান বিশারা ফিলিস্তিন সংকট নিয়ে আরব দেশগুলোর ভূমিকাকে দুর্বল হিসেবে বর্ণনা করেছেন। ফিলিস্তিনি সাংবাদিক খালেদ আবু তোয়ামেহ আরবদের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে প্রতারণা করার অভিযোগ করেছেন। আর ফিলিস্তিনি গবেষক মোহসেন মুহাম্মদ এবার আরব দেশগুলোর অবস্থানকে সবচেয়ে দুর্বল হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। ফিলিস্তিনি বুদ্ধিজীবী বড় অংশই আরব দেশগুলোর কাছে ইসরায়েল ও পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট পদক্ষেপ আশা করেন।
গত ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় চলমান ইসরায়েলি হামলায় প্রাণ গেছে ২১ হাজারের বেশি মানুষের। এঁদের মধ্যে ৯ হাজারের বেশি শিশু। তাদের রক্তাক্ত ছবি ও সন্তানহারা মা–বাবার কান্না বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছে।
উপসাগরীয় দেশগুলোর সহযোগিতা সংস্থার গালফ কোঅপারেশন কাউন্সিল–জিসিসিভুক্ত দেশগুলো ফিলিস্তিনের প্রতিবেশী। কিন্তু ইসরায়েলের হামলার পর শুধু সম্মেলন আর নিন্দা জানানো ছাড়া কোনো শক্ত পদক্ষেপ নেয়নি তারা। এই জোটের সদস্য সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন ও ওমান।
জিসিসিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে কুয়েতের সঙ্গে ইসরায়েলের কোনো সম্পর্ক নেই। এই জোটের প্রভাবশালী দেশ কাতারও ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার। ৭ অক্টোবরের ঘটনায় ইসরায়েলকেই দায়ী করেছে দেশটি। তারা ফিলিস্তিনের জন্য পূর্ব জেরুজালেমকে রাজধানী করে ১৯৬৭ সালের আগের ভূখণ্ডকে সমর্থন করে।
গাজায় ইসরায়েলের হামলার পর যুদ্ধ বন্ধে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছে কাতার। দেশটির মধ্যস্থতায় হামাসের হাতে জিম্মি কয়েকজনকে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। তাঁদের মধ্যে ইসরায়েল ও বিদেশি নাগরিক রয়েছেন। অপর দিকে ইসরায়েলের কারাগারে থাকা ফিলিস্তিনি বন্দীদের মুক্তি দেয় ইসরায়েল। চুক্তির শর্ত মেনে পাঁচ দিন গাজায় বোমাবর্ষণ বন্ধ রাখে ইসরায়েল। সাময়িক এই যুদ্ধবিরতির পরে আবারও টানা বোমাবর্ষণ করে যাচ্ছে ইসরায়েল। মানবিক সংকটের মুখে গাজায় আবারও যুদ্ধবিরতি কার্যকরের চেষ্টা করছে দেশটি। এ জন্য যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েল ও হামাসের সঙ্গে যোগাযোগ করছে কাতার।
সৌদি আরব এবং ওমানের সঙ্গে ইসরায়েলের আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক নেই। শুধু বাহরাইন ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক রয়েছে ইসরায়েলের।
গাজায় ইসরায়েলের হামলার পরিপ্রেক্ষিতে গত ১১ নভেম্বর আরব–ইসলামিক সম্মেলনের আয়োজন করে সৌদি আরব। এতে আরব লিগের ২২টি দেশ ও ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) ৫৭টি দেশ অংশ নেয়।
গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলের নিষ্ঠুর হামলার নিন্দা জানান আরব ও মুসলিম দেশগুলোর নেতারা। একই সঙ্গে তাঁরা গাজায় দ্রুত যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানান। কিন্তু ইসরায়েলের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক কোনো অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি তাঁরা।
বার্তা সংস্থা এএফপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কূটনৈতিক সূত্রমতে, ওই বৈঠকে ইরান, সিরিয়া, লেবানন, আলজেরিয়াসহ কয়েকটি দেশ ইসরায়েল ও তার মিত্রদেশগুলোতে তেল রপ্তানি বন্ধ করার প্রস্তাব করেছিল। এ ছাড়া আরব লিগভুক্ত দেশগুলোকে ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার প্রস্তাব দেয় তারা।
শুধু লিবিয়া এই আহ্বানে সাড়া দেয়। দেশটির কাউন্সিল অব স্টেট ইসরায়েল ও তার মিত্রদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেয়। পাশাপাশি এসব দেশে তেল সরবরাহ না করার হুমকিও দেয় লিবিয়া।
কিন্তু সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইন এই প্রস্তাব নাকচ করে দেয়। ২০২০ সাল থেকে ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক বহাল রেখেছে দেশ দুটি। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম প্রভাবশালী দেশ সৌদি আরবও ইসরায়েলের বিপক্ষে কঠোর কোনো বার্তা দেয়নি।
২০২২ সালে হুতিরা আরব আমিরাতে হামলা চালায়। এ ঘটনা তদন্তে আমিরাতকে সহায়তা করে ইসরায়েল। এর পর থেকে দুই দেশের বন্ধুত্ব আরও গাঢ় হয়। ফলে ইসরায়েলের বিপক্ষে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি তারা।
কয়েক মাস ধরে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য সৌদি আরবকে চাপ দিয়ে আসছিল যুক্তরাষ্ট্র। এ ক্ষেত্রে দুই পক্ষের কূটনৈতিক পর্যায়ের আলোচনায় বেশ কিছু অগ্রগতিও হয়েছিল। তবে ৭ অক্টোবরের পর সৌদি আরব এই অবস্থান থেকে পিছিয়ে এসেছে।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান গাজায় বর্বরোচিত হামলার জন্য ইসরায়েলকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র আখ্যা দেন। গাজায় ইসরায়েলের হামলাকে সমর্থন করায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের পশ্চিমা মিত্রদের সমালোচনা করেছেন তিনি।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও নাৎসি একনায়ক অ্যাডলফ হিটলারের মধ্যে ‘কোনো ফারাক নেই’ বলে মন্তব্য করেন এরদোয়ান। সম্প্রতি তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় এক অনুষ্ঠানে তিনি এ মন্তব্য করেন।
গাজায় হামলার কারণে ইসরায়েল থেকে নিজেদের রাষ্ট্রদূত প্রত্যাহার করেছে জর্ডান। কিন্তু মিসরসহ অন্যান্য আরব দেশ আগের মতোই ইসরায়েলের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে।
গত ২৩ নভেম্বর আরব লিগের অন্যতম সদস্যদেশ মরক্কোকে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার আহ্বান জানান হামাস নেতা খালেদ মেশাল। তিনি বলেন, ইসরায়েল ও তাঁর মিত্রদের ওপর চাপ প্রয়োগ করলে সেটি ফিলিস্তিনির উপকারে আসবে। তবে তাঁর এই আহ্বানে উল্টো ফল হয়েছে। মরক্কো এটিকে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখেছে।
অপর দিকে ইসরায়েলের হামলার কঠোর নিন্দা জানিয়ে আসছে ইরান। ইরানের সমর্থনপুষ্ট লেবাননভিত্তিক সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা ফিলিস্তিনিদের ‘হত্যার বদলা নিতে’ বিভিন্নভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
ইসরায়েলের উত্তরাঞ্চলের সীমান্তবর্তী শহর ও গ্রামে গত আড়াই মাসে বেশ কিছু রকেট ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে হিজবুল্লাহ। অপর দিকে লোহিত সাগর ও বাবেল আল–মান্দেব প্রণালিতে ইসরায়েল–সংশ্লিষ্ট বেশ কয়েকটি জাহাজে হামলা করেছে হুতিরা। যা সমুদ্রপথে নৌবাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ওআইসি বা আরব লিগের অনেক দেশ ইসরায়েল ইস্যুতে চুপ। অপর দিকে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া সোচ্চার হওয়ার মতো প্রভাবই নেই। গত নভেম্বর ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার পরিস্থিতি তদন্তে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) আবেদন করেছে বাংলাদেশসহ পাঁচটি দেশ। বাংলাদেশ ছাড়াও রয়েছে দক্ষিণ আফ্রিকা, বলিভিয়া, কমোরস ও জিবুতি। এসব দেশের মধ্যে শুধু বাংলাদেশ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ।
ফিলিস্তিন পরিস্থিতি নিয়ে ইতিমধ্যেই আইসিসিতে একটি তদন্ত চলমান রয়েছে। ২০১৪ সালে ১৩ জুন থেকে ওঠা যুদ্ধাপরাধের বিভিন্ন অভিযোগের ভিত্তিতে ওই তদন্ত করা হচ্ছে। কিন্তু এই মামলায় যে খুব একটা লাভ হবে তা মনে হচ্ছে না। কারণ, ইসরায়েল আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সদস্য নয়। এই আদালতের বিচারিক ক্ষমতাকেও স্বীকৃতি দেয় না দেশটি।
তথ্যসূত্র: এএফপি, রয়টার্স, আল-জাজিরা, জেরুজালেম পোস্ট, আরব সেন্টার