গাজার দুই-তৃতীয়াংশ এলাকায় ফিলিস্তিনিদের চলাচলে ইসরায়েলের বাধা

ইসরায়েলের হামলায় বিধ্বস্ত হয়েছে দার আল-আরকাম বিদ্যালয়। ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে আছে অসহায় এক শিশু। এই বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছেন গাজার বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা। শুক্রবার গাজা নগরীতেছবি: রয়টার্স

গাজা উপত্যকায় একের পর এক এলাকা থেকে বাসিন্দাদের তাড়িয়ে দিচ্ছে ইসরায়েলি বাহিনী। প্রাণ বাঁচাতে উপত্যকাটির এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছেন অসহায় ফিলিস্তিনিরা। জাতিসংঘের হিসাবে, গাজার দুই–তৃতীয়াংশ এলাকায় ফিলিস্তিনিদের চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে অথবা সেখান থেকে জোরপূর্বক তাঁদের বের করে দেওয়া হচ্ছে।

জাতিসংঘের ত্রাণ ও মানবিক সহায়তাসংক্রান্ত সংস্থা (ওসিএইচএ) শুক্রবার জানায়, নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়া এলাকাগুলোর মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ গাজার রাফার বড় একটি অংশ। গত ৩১ মার্চ সেখান থেকে ফিলিস্তিনিদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয় ইসরায়েল। উত্তরে গাজা নগরীর বিভিন্ন অংশেও এই নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। গতকাল সেখানে নতুন করে স্থল অভিযান শুরু করেছে ইসরায়েলি বাহিনী।

ঘরবাড়ি ছেড়ে দিতে ইসরায়েলি বাহিনীর হুমকির পর গাজাবাসী প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে পালিয়ে যাচ্ছেন। ৩ এপ্রিল, শেজায়া এলাকা
ছবি: রয়টার্স

১৮ মার্চ যুদ্ধবিরতি ভাঙার পর থেকেই গাজায় নৃশংসতা বাড়িয়েছে ইসরায়েল। তখন থেকে গাজার বিভিন্ন অঞ্চলের বাসিন্দাদের বিতাড়িত করতে জোর তৎপরতা শুরু করেছে তারা। বুধবারও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, তাঁদের সামরিক বাহিনী গাজার বড় অংশ দখল করবে। ওই এলাকাগুলো নিরাপত্তা অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত করা হবে।

নেতানিয়াহুর ভাষ্যমতে, তাঁরা এখন গাজা উপত্যকা বিভক্ত করার কাজ করছেন। ধাপে ধাপে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী গোষ্ঠী হামাসের ওপর চাপ বৃদ্ধি করা হবে, যেন তারা বাকি জিম্মিদের মুক্তি দেয়। বুধবারেই গাজার বড় অংশ দখলের জন্য স্থল অভিযান বৃদ্ধির ঘোষণা দেন ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ। তবে কী পরিমাণ এলাকা তাঁরা দখল করবেন, সে বিষয়টি স্পষ্ট করেননি তিনি।

২০২৩ সালের অক্টোবরে গাজায় নির্বিচার হামলা শুরু করে ইসরায়েল। তখন থেকে গত ১৯ জানুয়ারি যুদ্ধবিরতি শুরুর আগপর্যন্ত উপত্যকাটির ২৪ লাখ বাসিন্দার বেশির ভাগই বাস্তুচ্যুত হন। এরপর যুদ্ধবিরতি ভেঙে নতুন করে হামলা শুরু এবং এলাকা ছাড়তে ইসরায়েলের নির্দেশের পর আবার প্রাণ বাঁচাতে ঘরবাড়ি ছাড়তে শুরু করেছেন ফিলিস্তিনিরা।

এমনই একজন গাজা নগরীর পূর্বাঞ্চলের বাসিন্দা আবু হাজেম খালেফ। তিনি বলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে বড় সংগ্রামটা হলো ঘরবাড়ি ছেড়ে যাওয়া। কীভাবে এই পরিস্থিতি সামাল দেব, তা আমরা জানি না। এখন গাজা নগরীর পশ্চিম দিকে যাচ্ছি। সেখানে গিয়ে কোনো একটি সড়ক খুঁজব, যেন একটি তাঁবু খাটিয়ে থাকতে পারি।’

গাজায় বড় অংশ ফিলিস্তিনিদের চলাচলে নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি ২ মার্চ থেকে উপত্যকাটিতে ত্রাণ প্রবেশের সব পথ বন্ধ করে দিয়েছে ইসরায়েল। এতে করে উপত্যকাটিতে খাবার, পানি, জ্বালানি তেল ও ওষুধের মতো জরুরি পণ্য প্রবেশ করতে পারছে না। ফলে মানবিক সহায়তা কার্যক্রমে বাধা আসছে বলে জানিয়েছে ওসিএইচএ। এমন পরিস্থিতিতে শুক্রবার গাজায় নিজেদের কার্যক্রম বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে জাতিসংঘের সংস্থা বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি।

গাজাবাসীর সমর্থনে শুক্রবার জুমার নামাজের পর জর্ডানের রাজধানী আম্মানে বিক্ষোভ সমাবেশ করা হয়
ছবি: রয়টার্স

চলছে ইসরায়েলের হত্যাযজ্ঞ

গাজা দখলের পাশাপাশি প্রতিদিনই সেখানে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল বাহিনী। স্থানীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের শুক্রবারের হিসাবে, ১৭ মাসের বেশি সময় ধরে চলা ইসরায়েলের হামলায় অন্তত ৫০ হাজার ৫২৩ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত ১ লাখ ১৪ হাজার ৬৩৮ জন। আর গাজার জনসংযোগ কার্যালয়ের হিসাবে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ৬১ হাজার ৭০০। তাঁদের মধ্যে নিখোঁজ ফিলিস্তিনিরাও রয়েছেন।

শুক্রবারও গাজাজুড়ে ব্যাপক হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। দক্ষিণের রাফা ও খান ইউনিস থেকে শুরু করে উত্তরের গাজা নগরী সর্বত্রই আঘাত হেনেছে বোমা ও কামানের গোলা। স্থানীয় হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত উপত্যকাটিতে অন্তত ৩৫ জন নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে হামাসের ‘নুখবা ফোর্সের’ একজন নেতা রয়েছেন বলে দাবি করেছে ইসরায়েল। আর আগের ২৪ ঘণ্টায় গাজায় ইসরায়েলের হামলায় ১১২ জন নিহত হন। তাঁদের মধ্যে তিনটি স্কুলে হামলায় নিহত ৩৩ জন রয়েছেন।

গাজায় যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের পর দুই সপ্তাহের বেশি সময়ে ১ হাজার ২৪৯ জনকে হত্যা করেছে ইসরায়েলি বাহিনী। জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস এ হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন তাঁর মুখপাত্র স্টিফেন দুজারিক। তিনি বলেছেন, সব পক্ষকে সব সময় আন্তর্জাতিক আইন পুরোপুরি মেনে চলতে হবে। বেসামরিক লোকজনকে অবশ্যই সুরক্ষা দিতে হবে এবং তাঁদের প্রতি সম্মান জানাতে হবে।

এদিকে গাজার ফিলিস্তিনের সমর্থনে শুক্রবার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সমাবেশ হয়েছে। গাজাবাসীর জন্য ইরাকের রাজধানী বাগদাদে সম্মিলিতভাবে জুমার নামাজ আদায় করা হয়। এর পরপরই সেখান থেকে বের করা হয় একটি বিক্ষোভ সমাবেশ। এ ছাড়া ইয়েমেন, আলজেরিয়া, মরক্কোয় গাজাবাসীর সমর্থনে সমাবেশ ও মিছিল হয়েছে।