হিজবুল্লাহকে হারাতে না পেরে ইসরায়েলের যুদ্ধবিরতি, কার কত লাভ–ক্ষতি

ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর লেবাননের টায়ার নগরে নিজেদের বাড়িঘরে ফিরতে শুরু করেছেন স্থানীয় বাসিন্দারা
ফাইল ছবি: রয়টার্স

‘(যুদ্ধ থামিয়ে) নিজের জায়গায় ফিরে আসো, এটা তোমার উপস্থিতিকেই শুধু আরও মহৎ ও শক্তিশালী করবে। ফিরে আসো, শহীদের রক্তেভেজা মাটি স্পর্শ করো। এখানকার ডুমুর ও জলপাই বরণ করো’—হিজবুল্লাহর প্রতি এ আহ্বান ছিল লেবাননের পার্লামেন্টের স্পিকার নাবিহ বেরির। তিনি যেদিন এই আহ্বান জানান, সেই ২৬ নভেম্বরই লেবাননের সশস্ত্র সংগঠনটির সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি সই করেছে আগ্রাসী দখলবাজ ইসরায়েল।

তবে এ যুদ্ধবিরতির আগে টানা ১৪ মাস ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে গেছে হিজবুল্লাহ। ইসরায়েলের হামলায় জীবন দিতে হয়েছে সংগঠনটির প্রধান হাসান নাসরুল্লাহসহ শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতাকে। ইসরায়েলি বাহিনীর নৃশংসতায় প্রাণ গেছে আরও অন্তত ৩ হাজার ৮০০ জনের, আহত প্রায় ১৬ হাজার। বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয়, ১২ লাখ। লড়াইয়ে এক লাখের কাছাকাছি বাড়িঘর ও অন্যান্য স্থাপনা গুঁড়িয়ে দিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী।

ইসরায়েলি হামলায় দুর্বল হওয়া হিজবুল্লাহকে লেবাননের সশস্ত্র সংগঠনগুলো ভবিষ্যতে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে; যা আগে কখনো দেখা যায়নি। লেবাননবিষয়ক কিছু বিশেষজ্ঞের এমনও আশঙ্কা, হিজবুল্লাহ দুর্বল হওয়ায় যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা পূরণে দেশটির অভ্যন্তরে ক্ষমতার লড়াই শুরু হতে পারে। এতে বিভক্তির মুখে পড়তে পারে দেশটি।

হিজবুল্লাহও বসে থাকেনি। তাদের একের পর এক হামলায় কেঁপেছে ইসরায়েলের মাটি। ভয়–আতঙ্কে উত্তর ইসরায়েল থেকে বাড়িঘর ছেড়ে পালিয়েছে ৬০ হাজার ইসরায়েলি।

এত রক্তপাত–ক্ষয়ক্ষতির পর দুই পক্ষের মধ্যে যে যুদ্ধবিরতি হলো, লেবানন ও ইসরায়েলের ওপর তার প্রভাব কী; ইরানসহ গোটা মধ্যপ্রাচ্যের জন্যই–বা এটি কতটা স্বস্তির, উঠে এসেছে এমন নানা প্রশ্ন। আসুন, উত্তর খুঁজে দেখা যাক বিশেষজ্ঞদের চোখে—

ইসরায়েলের নেতানিয়াহু সরকার এবং হিজবুল্লাহ ও এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক ইরানের স্বার্থের মধ্যে একধরনের অভিন্নতা তৈরি হওয়ার ফলাফল হলো এ যুদ্ধবিরতি; যদিও তাদের সবার ক্ষেত্রেই কারণটা ভিন্ন।
অ্যাশের কাফম্যান, লেবানন ও মধ্যপ্রাচ্যের সীমান্ত বিরোধবিষয়ক বিশেষজ্ঞ

৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি

লেবাননের একাধিক যুদ্ধক্ষেত্রে লড়াই চলার পর উত্তেজনা কমানোর চেষ্টায় ইসরায়েল ও হিজবুল্লাহর মধ্যে গত ২৬ নভেম্বর ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতি চুক্তি সই হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের মধ্যস্থতায় সম্পাদিত এ চুক্তি অনুযায়ী, দক্ষিণ লেবানন থেকে নিজেদের সেনা সরিয়ে নেবে ইসরায়েলি বাহিনী। আর লাতিনি নদীর উত্তর থেকে হিজবুল্লাহ তাদের যোদ্ধাদের পুরোপুরি প্রত্যাহার করে নেবে। যুদ্ধবিরতিকালে কোনো পক্ষই একে অপরের ওপর হামলা চালাতে পারবে না। যদিও যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার এক দিন পরই শর্ত ভেঙে লেবাননে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল।

ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হতে হিজবুল্লাহর পক্ষে কাজ করেছে নানা ভাবনা। লেবাননের ভেতরে তাদের অবস্থান বিভিন্ন কারণেই নাজুক। এরই মধ্যে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ তার সামরিক সক্ষমতা হ্রাস করেছে। নিহত হয়েছেন হাসান নাসরুল্লাহসহ শীর্ষস্থানীয় অনেকে। সংগঠনটির ঘনিষ্ঠ মিত্র ইরানও বিভিন্ন সময় ইসরায়েলের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি হামলায় জড়াচ্ছে। এতে লেবানন ও গাজা—ইসরায়েলের এ দুই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তেহরান চাইছে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে।

যুদ্ধবিরতি শুরুর পর ইতিমধ্যে দক্ষিণ লেবাননে দেশটির সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। শর্ত অনুযায়ী, যুদ্ধবিরতির মেয়াদে দক্ষিণ লেবাননে শুধু দেশটির সেনাবাহিনী এবং জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীরা নিজেদের কাছে অস্ত্র রাখতে পারবেন।

চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। তিনি বলেছেন, এ চুক্তিকে সমর্থন দিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও অন্যান্য মিত্রদেশ।

লেবানন ও ইসরায়েলের ওপর প্রভাব

যুদ্ধবিরতিতে লাভ–ক্ষতির হিসাবে সার্বিকভাবে বেশি ঝুঁকিতে আছে লেবানন। ইসরায়েলের সঙ্গে সাম্প্রতিকতম এ যুদ্ধে জড়ানোর আগে থেকেই দেশটির অর্থনীতি ছিল ভঙ্গুর প্রকৃতির। ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে ইসরায়েলের তাণ্ডব চালানোকে কেন্দ্র করে দেশটির সঙ্গে শুরু হয় হিজবুল্লাহর সংঘাত। এতে লেবাননের অবকাঠামোগত, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে।

হিজবুল্লাহর প্রয়াত প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ
ফাইল ছবি: রয়টার্স

উপরন্তু, এই লড়াই লেবাননের অভ্যন্তরে জাতিগত উত্তেজনা বাড়িয়ে তুলেছে। দেশটি এখন গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে, ভেসে বেড়াচ্ছে এমন কথাবার্তা; যা একেবারে অমূলকও নয়।

তবে লড়াই শেষে ইসরায়েল–হিজবুল্লাহর ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতি লেবাননের সমাজে বিদ্যমান বিভিন্ন পক্ষের ওপর কী প্রভাব ফেলবে, তা নিয়ে রয়েছে অনিশ্চয়তা। হিজবুল্লাহর প্রধান নাসরুল্লাহসহ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের হারানোর পাশাপাশি ইসরায়েলের উপর্যুপরি হামলায় হিজবুল্লাহ দুর্বল হয়েছে। কিন্তু, তাকে যে শেষ করা সম্ভব নয়, তা খোদ ইসরায়েলিরাও জানেন। যুদ্ধবিরতির মধ্যে হিজবুল্লাহ নিজেদের সামরিকভাবে গুছিয়ে নেওয়া ও দেশের অভ্যন্তরে রাজনীতিতে নিজস্ব শক্তি বাড়ানোর দিকে জোর দিতে পারে। এতে অন্যান্য পক্ষ কেমন সাড়া দেয়, সেটিই এখন প্রধান দেখার বিষয়।

নাসরুল্লাহর শাহাদাতবরণ হিজবুল্লাহর প্রতি সমর্থনকেই আরও জোরাল করতে পারে। নাসরুল্লাহ এখন থেকে আরও বেশি প্রতীকী গুরুত্ব বহন করবেন। এ অঞ্চলে তিনি হয়ে উঠবেন (ইসরায়েলের বিরুদ্ধে) প্রতিরোধের স্থায়ী প্রতীক।
বশির সাদি, স্কটল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব স্টারলিংয়ের রাজনীতি ও ধর্মবিষয়ক শিক্ষক

হিজবুল্লাহকে লেবাননের সশস্ত্র সংগঠনগুলো আগামী দিনগুলোতে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে; যা আগে কখনো দেখা যায়নি। লেবাননবিষয়ক কিছু বিশেষজ্ঞের এমনও আশঙ্কা, হিজবুল্লাহ দুর্বল হওয়ার কারণে যে শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা পূরণে দেশটির অভ্যন্তরে ক্ষমতার লড়াই শুরু হতে পারে। এতে আরও বিভক্তির মুখে পড়তে পারে দেশটি।

বর্তমানে লেবানন চলছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। দুই বছর আগে থেকে সেখানে কোনো প্রেসিডেন্ট নেই। নিজেদের মিত্র দল থেকে নতুন প্রেসিডেন্ট নিয়োগ দিতে হিজবুল্লাহ দাবি তোলার পর থেকে এ অবস্থার শুরু। এখন দেশটির রাজনীতিবিদদের একজন নতুন প্রেসিডেন্ট বেছে নেওয়ার বিষয়ে একমত হতে হবে, যিনি নতুন প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দেবেন ও সরকার গঠন করবেন। এখন এসব কীভাবে হয়, তা–ও দেখার বাকি।

বিপরীতে যুদ্ধবিরতি ইসরায়েলকে তার উত্তরাঞ্চল পুনর্গঠনের সুযোগ এনে দেবে। হিজবুল্লাহর ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় এখানকার অনেক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্থবির হয়ে পড়েছে স্বাভাবিক কাজকর্ম। লেবানন সীমান্তের কাছে এ অঞ্চল থেকে পালিয়েছিল ৬০ হাজারের মতো ইসরায়েলি। সম্ভবত তারাও এখন ফিরবে বাড়িঘরে।

হিজবুল্লাহর সঙ্গে দীর্ঘ লড়াইয়ের ধকল কাটিয়ে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনীকে (আইডিএফ) ধাতস্থ হওয়ার সুযোগও এনে দেবে যুদ্ধবিরতি। এ ছাড়া লেবানন থেকে নজর সরিয়ে গাজায় ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর দিকে আরও বেশি মনোযোগ দিতে পারবে এ বাহিনী।

‘স্বার্থের অভিন্নতার ফল যুদ্ধবিরতি’

নভেম্বরের শেষে এসে কেন যুদ্ধবিরতি—দ্য কনভারসেশনের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়েছিল লেবানন ও মধ্যপ্রাচ্যের সীমান্ত বিরোধবিষয়ক বিশেষজ্ঞ অ্যাশের কাফম্যানের কাছে।

জবাবে কাফম্যান বলেন, ইসরায়েলের নেতানিয়াহু সরকার এবং হিজবুল্লাহ ও এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক ইরানের স্বার্থের মধ্যে একধরনের অভিন্নতা তৈরি হওয়ার ফলাফল হলো এ সময়ে যুদ্ধবিরতি; যদিও তাদের সবার ক্ষেত্রে কারণটা ভিন্ন।

ইসরায়েল সরকারের জন্য তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। প্রথমত, ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী এক বছরের বেশি সময় ধরে নানা পক্ষের সঙ্গে যুদ্ধ করে ক্লান্ত। এটিও আংশিক সত্য, ইসরায়েলের রিজার্ভ বাহিনীর সদস্যরা ক্রমেই বেশি সংখ্যায় কাজে যোগ দিচ্ছেন না। দেশটির সাধারণ জনগণও সংঘাতের জেরে ক্লান্ত। এ অবস্থায় দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ চেয়েছে হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধবিরতি।
দ্বিতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু নিজেও নানা বিষয়ে চাপের মুখে, বিশেষ করে তাঁর সরকারের জোট শরিক আলট্রা অর্থোডক্সদের পক্ষ থেকে। আবার ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর দৃষ্টিকোণ থেকে বললে, হিজবুল্লাহকে তারা দুর্বল করতে পেরেছে ঠিক, কিন্তু হারাতে পারেনি; যা সম্ভবও নয় বটে।

লেবাননে ইসরায়েলের হামলায় বিধ্বস্ত হয়েছে এ রকমই বহু ভবন
ফাইল ছবি: রয়টার্স

ঘোর শত্রু ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধবিরতিতে রাজি হতে একই সময়ে হিজবুল্লাহর পক্ষে কাজ করেছে নানা রকম ভাবনা। লেবাননের ভেতরে তাদের অবস্থান বিভিন্ন কারণে অনেকটা নাজুক হয়ে আছে। এরই মধ্যে ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ হিজবুল্লাহর সামরিক সক্ষমতা হ্রাস করেছে। নিহত হয়েছেন হাসান নাসরুল্লাহসহ শীর্ষস্থানীয় অনেকে। তা ছাড়া সংগঠনটির ঘনিষ্ঠ মিত্র ইরানও বিভিন্ন সময়ে ইসরায়েলের সঙ্গে পাল্টাপাল্টি হামলায় জড়াচ্ছে। এতে লেবানন ও গাজা—ইসরায়েলি বাহিনীর দুই যুদ্ধক্ষেত্র থেকে তেহরান চাইছে নিজেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে।

অন্যদিকে ইরানের চাওয়া, হিজবুল্লাহ যেন লেবাননে যত দ্রুত সম্ভব নিজের আগের অবস্থানে ফিরতে পারে। আসছে বছরের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রশাসনে বসতে চলেছেন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ইরানের ধারণা, ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদে মার্কিন প্রশাসন তেহরান ও মধ্যপ্রাচ্যে এর ‘প্রক্সিগুলোর’ বিষয়ে আরও আগ্রাসী অবস্থান নেবে। আর প্রক্সিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিজবুল্লাহ। এমন পরিস্থিতিতে ইরানে নতুন প্রেসিডেন্ট, যুক্তরাষ্ট্রে নতুন প্রশাসন, ইরানের প্রধান প্রক্সি ও ইসরায়েলের যুদ্ধবিরতি—এসব বিষয় ট্রাম্পের হোয়াইট হাউসের সঙ্গে তেহরানের গঠনমূলক সংলাপ শুরুর জন্য হতে পারে প্রথম পদক্ষেপ।

‘ইরানের প্রতিরোধ অক্ষ’

ইসরায়েলকে মোকাবিলা করতে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অরাষ্ট্রীয় মিত্রদের ব্যবহার করার ইরানি প্রতিরক্ষাকৌশল, ‘প্রতিরোধ অক্ষ’। ‘এ অক্ষে হিজবুল্লাহর ভূমিকা এখন হ্রাস পেতে পারে’, বলছেন উইলসন সেন্টারের মিডল ইস্ট প্রোগ্রামের গ্লোবাল ফেলো জো ম্যাকারন।

ম্যাকারনের পর্যবেক্ষণ, ‘প্রধানত কাসেম সোলাইমানিকে (ইরানের ক্ষমতাধর সামরিক কমান্ডার) হত্যার পর নাসরুল্লাহ হয়ে ওঠেন এ অক্ষের কেন্দ্রীয় ব্যক্তি। নাসরুল্লাহ হত্যাকাণ্ডের জেরে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে হিজবুল্লাহর আঞ্চলিক পর্যায়ে প্রভাব বিস্তারের সক্ষমতা সম্ভবত কমতে থাকবে।’

যা–ই হোক, স্কটল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব স্টারলিংয়ের রাজনীতি ও ধর্মবিষয়ক শিক্ষক এবং ‘হিজবুল্লাহ অ্যান্ড দ্য পলিটিক্স অব রিমেমব্রান্স’–এর রচয়িতা বশির সাদি জো ম্যাকারনের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন। তাঁর মতে, নাসরুল্লাহর শাহাদাতবরণ হিজবুল্লাহর প্রতি সমর্থনকেই আরও জোরালো করতে পারে। তিনি বলেন, ‘নাসরুল্লাহ এখন থেকে আরও বেশি প্রতীকী গুরুত্ব বহন করবেন। এ অঞ্চলে তিনি হয়ে উঠবেন (ইসরায়েলের বিরুদ্ধে) প্রতিরোধের স্থায়ী প্রতীক।’

বিজয় নিয়ে নেতানিয়াহুর বাগাড়ম্বর

যুদ্ধবিরতিতে রাজি হওয়ার পর বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক ‘বিজয়ী’ ভাষণ দেন। সেখানে তিনি দাবি করেন, ‘হিজবুল্লাহকে আমরা এক দশক পিছিয়ে দিয়েছি, তিন মাস আগেও যা ছিল কল্পবিজ্ঞানের মতো। কিন্তু আমরা তা করেছি। হিজবুল্লাহ আর আগের মতো নেই।’

অবশ্য নেতানিয়াহুর বক্তব্যকে বাগাড়ম্বর বলে মনে করেন বশির সাদি। দ্য নিউ আরবকে (টিএনএ) তিনি বলেন, ‘ইসরায়েলের সাম্প্রতিকতম হামলায় হিজবুল্লাহর সক্ষমতা ক্ষয়ে যাওয়ার দাবি মাত্রাতিরিক্ত আশাবাদী। ইসরায়েল সত্যিই যদি হিজবুল্লাহকে চূড়ান্ত আঘাত করতে পারত, তবে যুদ্ধবিরতিতে রাজি না হয়ে সে সামনে এগোনো অব্যাহত রাখত।’

যুদ্ধক্ষেত্রে ইসরায়েলের কয়েকটি ট্যাংক
ফাইল ছবি: রয়টার্স

লরেন ট্রমবেটা ইতালীয় বার্তা সংস্থা এএনএসএ এবং ভূরাজনৈতিক সাময়িকী লাইমসের মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক সংবাদদাতা। তাঁর মতে, (হামলার মুখে) নিজেকে টিকিয়ে রেখে হিজবুল্লাহ এটাই দেখিয়েছে যে ইসরায়েল তাকে শেষ করতে পারবে না, হিজবুল্লাহর সঙ্গে সংঘাতের শুরুতে যা ছিল ইসরায়েলের চিন্তার বাইরে।

আর ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের (আইসিজি) লেবাননবিষয়ক বিশ্লেষক ডেভিড উড বলেন, নিজ ভূখণ্ডে ইসরায়েলকে নিরপেক্ষ অঞ্চল গঠনে বাধ্য করা দেশটির জন্য হিজবুল্লাহর তরফে একটি কৌশলগত আঘাত। আবার একের পর এক হামলায় ইসরায়েলের উত্তর সীমান্ত থেকে ৬০ হাজার ইসরায়েলিকে পালাতে বাধ্য করা ও যুদ্ধবিরতির আওতায় বাড়িঘরে তাদের ফেরার সুযোগ দেওয়া হিজবুল্লাহর জন্য আরেকটি বড় জয় বলে দাবি লেবাননের সংগঠনটির।

ট্রাম্পের অবস্থান ও গাজার ভবিষ্যৎ

ইসরায়েল হিজবুল্লাহর সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি সই করেছে, এর অর্থ এই নয় যে এখন ফিলিস্তিনের বিধ্বস্ত গাজায়ও তারা যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হবে। এ উপত্যকা তাদের কাছে ভিন্ন কিছু। গাজা যুদ্ধ ইসরায়েলের জন্য তার সীমান্ত নিরাপদ করা ও জিম্মিদের মুক্ত করার চেয়ে আরও বেশি কিছু।

গাজা ইসরায়েলের কাছে প্রতিশোধ নেওয়ারও একটি স্থান। এ যুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এবং ফিলিস্তিনিদের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা সম্পূর্ণ গুঁড়িয়ে দেওয়ার মতো বিষয়।

এদিকে লেবাননে যুদ্ধবিরতিও ভঙ্গুর প্রকৃতির। আগেই বলা হয়েছে, এ চুক্তির মেয়াদ ৬০ দিন। তত দিনে ট্রাম্প ওভাল অফিসে ফিরবেন। যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত এ প্রেসিডেন্ট আগেই ইঙ্গিত দিয়েছেন, লেবাননে যুদ্ধবিরতি চান তিনি। তবে সেই যুদ্ধবিরতি স্বরূপ কেমন হবে, সে বিষয়ে কিছু বলেননি।

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন

স্বাভাবিকভাবে হোয়াইট হাউসে বসার পর এ অঞ্চল নিয়ে ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত কী হয়, তা দেখার অপেক্ষায় পুরো মধ্যপ্রাচ্যবাসী।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্র নেতানিয়াহু ও তাঁর সরকার, সেই সঙ্গে বেশির ভাগ ইসরায়েলির বিশ্বাস, মধ্যপ্রাচ্যে সামরিকভাবে জিততে চাইলে শত্রুদের ওপর চাপ বজায় রেখে আধিপত্য বিস্তার করতে হবে। সে অনুযায়ী, এই অঞ্চলে ইসরায়েলের পক্ষে ক্ষমতার ভারসাম্যে বদল আনতে যুদ্ধবাজ নেতানিয়াহু একতরফা শক্তি প্রয়োগ করে চলেছেন। আর যুক্তরাষ্ট্রও তাঁকে তা করতে দিচ্ছে অবাধে।

{তথ্যসূত্র: বিবিসি, দ্য নিউ আরব ও দ্য কনভারসেশন}

আরও পড়ুন
আরও পড়ুন