ইসরায়েলের দক্ষিণের একটি এলাকায় ৭ অক্টোবর হামলা চালায় ফিলিস্তিনের স্বাধীনতা আন্দোলনের সশস্ত্র সংগঠন হামাস। হামলার জেরে এলাকাটিতে সেনা মোতায়েন করে ইসরায়েল। এই ইসরায়েলি সেনাদের মধ্যে আছেন তাল ও জাক নামের দুজন। এলাকাটিতে কত দিন থাকতে হবে, সে বিষয়ে তাঁদের কোনো ধারণা নেই।
ইসরায়েলের এই দুই তরুণ সেনা সিএনএনকে বলেন, তাঁদের কয়েক সপ্তাহ থাকতে হতে পারে। আবার থাকতে হতে পারে মাসের পর মাস।
ফিলিস্তিনের গাজা সীমান্তের কাছের একটি ইসরায়েলি সামরিক ক্যাম্পে বসে জাক বলেন, তাঁর এই কথা সব সেনার জন্যই প্রযোজ্য। কারণ, কেউ জানেন না যে ঠিক কত দিন তাঁদের থাকতে হবে।
দুই সেনাই ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর (আইডিএফ) একটি আর্টিলারি ইউনিটে কাজ করেন। ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর এই ইউনিটকে ইসরায়েলের দক্ষিণের এলাকায় মোতায়েন করা হয়।
ইসরায়েলে হামাসের হামলায় ১ হাজার ৪০০ জনের বেশি নিহত হন। হামাসের যোদ্ধারা প্রায় ২০০ জনকে ইসরায়েল থেকে ধরে গাজায় নিয়ে জিম্মি করেছেন।
৭ অক্টোবর থেকেই নির্বিচারে পাল্টা হামলা শুরু করে ইসরায়েল। ইসরায়েলি হামলায় পাঁচ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। ইতিমধ্যে অবরুদ্ধ গাজা পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে।
হামাসের হামলার জেরে তিন লাখ রিজার্ভ সেনা তলব করেছে ইসরায়েল। পাশাপাশি তারা গাজা সীমান্তে বিপুল সেনাসমাবেশ ঘটিয়েছে। জড়ো করেছে ব্যাপক সামরিক সরঞ্জাম। এর অংশ হিসেবেই ইসরায়েলি আর্টিলারি ইউনিটটি গাজা সীমান্তে দায়িত্ব পালন করছে।
গাজায় স্থল অভিযান চালানোর পরিকল্পনা ইসরায়েলের। গত বৃহস্পতিবার ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট সীমান্তে জড়ো হওয়া সেনাদের বলেন, তাঁরা এখন দূর থেকে গাজাকে দেখছেন। কিন্তু শিগগির তারা ভেতর থেকেই গাজাকে দেখতে পাবেন। গাজা আর একই রকম থাকবে না।
তবে ইসরায়েলের অভিযান কেমন হতে পারে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
আইডিএফ গাজায় একটি পূর্ণমাত্রার হামলা শুরু করতে পারে। অথবা তারা জিম্মিদের উদ্ধারে আরও সুনির্দিষ্ট হামলা চালাতে পারে। একই সঙ্গে তারা গাজায় হামাসের স্থাপনা নিশানা করে হামলা চালাতে পারে।
কিন্তু এরপর কী হবে, তা আরও এক বড় প্রশ্ন।
ইসরায়েলি নেতৃত্ব হামাস থেকে গাজাকে ‘মুক্ত’ করার প্রয়োজনীয়তার কথা বলছেন। তবে গাজা উপত্যকাটির ২০ লাখের বেশি অধিবাসীর ভবিষ্যৎ-সম্পর্কিত পরিকল্পনা এখনো অজানা।
তেল আবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের মোশে দায়ান সেন্টার ফর মিডল ইস্টার্ন অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজের জ্যেষ্ঠ গবেষক হারেল চোরেভ বলেন, এই বিষয়ে ইসরায়েলে একটা ঐকমত্য রয়েছে যে হামাসকে সম্পূর্ণরূপে নির্মূল করা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প হবে ভয়ানক।
হারেল চোরেভের ভাষ্য, এর অর্থ, গাজার অবকাঠামো ধ্বংস করা। গাজা শহরের নিচে থাকা শহর, যাকে গাজা সিটি মেট্রো বলে তারা, সেটি ধ্বংস করা।
হারেল চোরেভ মূলত হামাসের ব্যবহার করা সুড়ঙ্গের বিশাল গোলকধাঁধার কথা উল্লেখ করেছেন। এই সুড়ঙ্গ হামাসের রকেট ও গোলাবারুদ সংরক্ষণে ব্যবহৃত হয়। এ সুড়ঙ্গেই হামাসের ‘কমান্ড অ্যান্ড কন্ট্রোল সেন্টার’ অবস্থিত।
হারেল চোরেভ বলেন, সুড়ঙ্গ ধ্বংসের অর্থ হলো হামাসের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া। আর অবশ্যই গাজাসহ অন্যত্র হামাসের নেতৃত্বকে নির্মূল করা।
তবে ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের মধ্যপ্রাচ্যনীতির গবেষণা ফেলো হাসান আলহাসান বলেন, হামাসকে ধ্বংস করার পরিকল্পনা বিপজ্জনক ও জটিল হতে পারে। এর পরিণতি হতে পারে অপ্রত্যাশিত।
যুক্তি হিসেবে হাসান আলহাসান বলেন, গাজা, গাজার সমাজ ও গাজার ভূগোলের মধ্যে হামাস গভীরভাবে প্রোথিত। তাই হামাসকে পরাজিত করার জন্য ইসরায়েলকে গাজা উপত্যকায় ভূসংস্থান ও জনসংখ্যাগত পরিবর্তন আনতে হবে, যদিও তা ইতিমধ্যে ঘটে চলছে।
আইডিএফ ইতিমধ্যে উত্তর গাজার সব বেসামরিক নাগরিকদের দক্ষিণে সরে যেতে বলেছে। কারণ, তারা এ এলাকায় বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলি বাহিনীর এই নির্দেশ এক মহামানবিক বিপর্যয় তৈরি করেছে।
জাতিসংঘের মানবিক কার্যক্রম-বিষয়ক সমন্বয়ের কার্যালয় (ওসিএইচএ) গত শনিবার জানায়, গাজার প্রায় ১৪ লাখ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, যা পুরো উপত্যকার মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশের বেশি।
গাজা বহু বছর ধরেই অবরোধের মধ্যে আছে। কিন্তু হামাসের হামলার পর গাজায় বিদ্যুৎ, জ্বালানি, খাদ্য, পানি সরবরাহ বন্ধ করে দেয় ইসরায়েল।
যদিও পরে ইসরায়েল দাবি করে, তারা ১৫ অক্টোবর পানি সরবরাহ আবার চালু করেছে। কিন্তু পানির পাম্প চালানোর জন্য গাজায় বিদ্যুৎ নেই।
গবেষণা ফেলো হাসান আলহাসান বলেন, গাজার মানবিক পরিস্থিতিকে অত্যন্ত কঠিন করে তোলার কৌশল নিয়েছে ইসরায়েল। তবে ইসরায়েলের এই কৌশল নিয়ে মিসর ও জর্ডানের মধ্যে উদ্বেগ আছে। কারণ, এতে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা ব্যাপকভাবে মিসর ও জর্ডানে প্রবেশ করতে পারে।
ইসরায়েল এখন পর্যন্ত বলে আসছে, তারা হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। তারা গাজার বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে না।
আইডিএফের এক মুখপাত্র গত শনিবার সিএনএনকে বলেন, তাঁরা বেসামরিক ব্যক্তিদের হতাহতের ঘটনা এড়ানোর চেষ্টা করছেন। কিন্তু এখন একটা শহুরে যুদ্ধ অনিবার্য।
আইডিএফের মুখপাত্রের এই কথার অর্থ হলো, শহুরে যুদ্ধে বেসামরিক ব্যক্তিদের হতাহতের ঘটনা ঘটতে পারে।
গাজায় সম্ভাব্য স্থল অভিযানের কথা জানিয়ে আইডিএফের মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল পিটার লার্নার সিএনএনকে বলেন, তাঁদের লক্ষ্য হামাসকে পরাজিত করা। হামাস যাতে আর কখনোই গাজা শাসনের ক্ষমতা বা হামলা চালানোর ক্ষমতা ধরে রাখতে না পারে, তা নিশ্চিত করাই তাঁদের দায়িত্ব।
তবে এখন যা স্পষ্ট, তা হলো গাজার বেসামরিক মানুষের দুর্ভোগ-দুর্দশা শিগগির শেষ হচ্ছে না। গাজায় ইসরায়েলের সম্ভাব্য স্থল অভিযানের পর তাদের কী হবে, তা যে কেউ অনুমান করতে পারেন।