মানুষের ফোনে ফোনে সতর্কবার্তা, ইসরায়েল কি লেবাননের টেলিকম নেটওয়ার্কের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে

দক্ষিণ লেবাননের জাওতার গ্রামে ২১ সেপ্টেম্বর রাতে ইসরায়েলি বিমান হামলায় আলোর বিচ্ছুরণ ঘটে আকাশেছবি: এএফপি

লেবাননের দক্ষিণাঞ্চল ও রাজধানী বৈরুতের অংশবিশেষ থেকে গতকাল সোমবার লোকজনকে সরে যেতে সতর্ক করে দেয় ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। এতে দেশটির সঙ্গে ইসরায়েলের পুরোদমে যুদ্ধ শুরুর আশঙ্কা নিয়ে ছড়িয়ে পড়ে উদ্বেগ। সেই সঙ্গে দেশটি লেবাননের টেলিকমিউনিকেশন নেটওয়ার্ক হ্যাক করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে—এমন শঙ্কাও দেখা দেয়।

ওই সতর্কবার্তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই লেবাননের দক্ষিণ ও পূর্বে বিভিন্ন এলাকায় নির্বিচার বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। এতে অন্তত ৪৯২ জন নিহত ও অনেকে আহত হয়েছেন। গতকাল সন্ধ্যায় ইসরায়েল জানায়, বৈরুতের অংশবিশেষেও হামলা চালিয়েছে তারা।

লেবাননের সঙ্গে পুরোদস্তুর যুদ্ধ শুরুর আশঙ্কার মধ্যে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইসরায়েল যে পন্থায় লেবাননে হামলার সতর্কবার্তা পাঠিয়েছে, সেটি প্রযুক্তিগত দিক থেকে দেশটির ওপর ইসরায়েলি আধিপত্যের কথাই স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েল তার সম্ভাব্য হামলা সম্পর্ক লোকজনকে সতর্ক করতে যে পদ্ধতি অনুসরণ করে আসছিল, সেটিরই পুনরাবৃত্তি ঘটাল লেবাননেও।

লেবাননে কী ঘটেছে, ইসরায়েলি সতর্কবার্তা কেন গুরুত্বপূর্ণ ও দেশটিজুড়ে জনসাধারণের ব্যক্তিগত যোগাযোগব্যবস্থা কীভাবে ইসরায়েল নিয়ন্ত্রণে নিয়ে থাকতে পারে, সেসব বিষয়ে জেনে নেওয়া যাক:

লেবাননে কী ঘটেছে

গতকাল দক্ষিণ লেবাননের বিভিন্ন গ্রাম ও বৈরুতের কোনো কোনো অংশের বাসিন্দারা গতকাল দিনের শুরুতে খুদে বার্তা ও ফোনকল পান। এসব খুদে বার্তা ও ফোনকল এসেছিল লেবাননের একটি ফোন নম্বর থেকে। তাতে দেশটির সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহর শক্ত ঘাঁটিগুলো থেকে বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়।

এই বাসিন্দাদের কেউ কেউ তাঁদের মোবাইল বা ল্যান্ডফোনে রেকর্ডকৃত কল পান। কিছু বাসিন্দা পান খুদে বার্তা। বৈরুত থেকে এ কথা জানান আল–জাজিরার সংবাদদাতা মাজেন ইব্রাহিম। সব বার্তাই ছিল একই রকম।

লেবাননের মানুষের ফোন নম্বর, তাঁদের অবস্থান—এমন সব ব্যক্তিগত তথ্য ইসরায়েল কীভাবে পেল, আমরা জানি না। এটি তথ্য ফাঁস, নাকি লেবাননের টেলিকম অবকাঠামোয় ইসরায়েলের হ্যাকিংয়ের কারণে ঘটল, সেটি এক প্রশ্ন।
—মাজেন ইব্রাহিম, বৈরুতে আল–জাজিরার সংবাদদাতা

সকাল ৮টা ২০ মিনিটের দিকে পাওয়া এমনই একটি বার্তায় লেখা ছিল, ‘আপনি যদি হিজবুল্লাহর অস্ত্রশস্ত্র থাকা কোনো ভবনে থাকেন, তবে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত ওই গ্রাম থেকে দূরে থাকুন।’

এ বার্তা পাঠাতে লেবাননের রেডিও সম্প্রচারমাধ্যমগুলোও হ্যাক করা হয়েছে বলে এই সংবাদদাতা জানান।

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র দানিয়েল হাগারি গতকাল সকালে এক্স হ্যান্ডেলে পাঠানো এক ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘আমরা লেবাননের গ্রামবাসীর প্রতি এ বার্তা ও ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর পাঠানো সতর্কবার্তায় মনোযোগ দেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি।’

মাজেন ইব্রাহিম বলেন, বাসিন্দাদের যেসব এলাকা খালি করতে বলা হয়েছে, এরই মধ্যে সেসব স্থান থেকে (গত বছরের ৮ অক্টোবরের পর) বাস্তুচ্যুত হয়েছেন তাঁরা। ওই দিন থেকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ও লেবাননের হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের মধ্যে গোলাগুলি শুরু হয়েছে।

আল–জাজিরার এ সংবাদদাতা বলেন, ‘গত ১১ মাসে ওই সব স্থান থেকে এক লাখের বেশি মানুষ তাঁদের বাড়িঘর ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। যে স্বল্পসংখ্যক লোক বাড়িঘর ছাড়তে চাননি, তাঁরাই এখনো সেখানে আছেন।’

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পেজার ও ওয়াকিটকিগুলো বিস্ফোরিত হওয়ার কয়েক মাস আগেই ইসরায়েল এসব যন্ত্রের ভেতর বিস্ফোরক ঢুকিয়ে দেয়। এ ঘটনার পর গতকাল লেবাননের নির্দিষ্ট এলাকার মানুষের ফোনে ফোনে সতর্কবার্তা পাঠানো ও কল করার মধ্য দিয়ে ইসরায়েল এ ইঙ্গিতই দিল যে শত্রু হিজবুল্লাহই শুধু নয়, সাধারণ লেবাননিদের ব্যক্তিগত তথ্যে অনুপ্রবেশ করার সক্ষমতাও রয়েছে তার।

এদিকে বৈরুতের যেসব বাসিন্দা ইসরায়েলি বাহিনীর রেকর্ডকৃত সতর্কবার্তা পেয়েছেন, তাঁদের মধ্যে লেবাননি তথ্যমন্ত্রী জিয়াদ ম্যাকারিও রয়েছেন বলে জানিয়েছে দেশটির সরকারি বার্তা সংস্থা।

মাজেন ইব্রাহিম বলেন, ‘মানুষের ফোন নম্বর, তাঁদের অবস্থান—এমন সব ব্যক্তিগত তথ্য ইসরায়েল কীভাবে পেল, আমরা জানি না। এটি তথ্য ফাঁস, নাকি লেবাননের টেলিকম অবকাঠামোয় ইসরায়েলের হ্যাকিংয়ের কারণে ঘটল, সেটি এক প্রশ্ন।’

লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলের টাইর এলাকায় ইসরায়েলি বাহিনীর বোমা হামলার শিকার ভবন থেকে ধোয়া বেরোচ্ছে। ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৪
ছবি: রয়টার্স

এ ঘটনা কি সতর্কবার্তার চেয়েও বেশি কিছু

ইসরায়েলের দাবি, বেসামরিক লোকজনের ক্ষয়ক্ষতি কমাতে এসব সতর্কবার্তা পাঠাচ্ছে তারা। গাজায় চলমান যুদ্ধেও এমন সতর্কবার্তা পাঠিয়েছে দেশটি। আর এর পেছনেও তারা ওই একই যুক্তি দেখিয়েছে।

কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি এ যুক্তিকে সমর্থন করে না। লেবাননে ইসরায়েলের বোমা এমন সব ভবনেও আঘাত হেনেছে, যেখানকার বাসিন্দারা কোনো সতর্কবার্তা পাননি। অন্যদিকে গাজায় বাড়িঘর ছেড়ে পালাতে থাকা মানুষের ওপরও হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী।

এ ঘটনায় বিস্ময়ের কিছু নেই। গত ৮ অক্টোবরের আগেই লেবাননের টেলিকম নেটওয়ার্ক হ্যাক করেছে ইসরায়েল।
—এলিজাহ ম্যাগনিয়ার, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের সংঘাতবিষয়ক বিশ্লেষক

সতর্কবার্তা নানাভাবে, যেমন গণমাধ্যমে বার্তা পাঠিয়ে, ফোনকল বা প্রচারপত্র বিলি করে দেওয়া যেতে পারে। তবে গাজায় ফোনের মাধ্যমে বছরজুড়ে যেভাবে সতর্কবার্তা পাঠানো হয়েছে, তাতে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি ইসরায়েলের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধেরও একটি উদাহরণ। এর উদ্দেশ্য, ফিলিস্তিনিদের এ কথা স্মরণ করিয়ে দেওয়া যে তাঁরা যখন, যেখানেই থাকুন, ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর নজরদারিতে রয়েছেন।

এ নিবিড় নজরদারি ইসরায়েলকে তার নির্দিষ্ট লক্ষ্যবস্তুতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতেও সহায়তা করেছে। গাজায় গ্রহণ করা এ পরিচিত পদ্ধতিই এবার লেবাননে ঘটাল ইসরায়েল।

লেবাননের টেলিকম নেটওয়ার্কে কীভাবে ইসরায়েলের অনুপ্রবেশ

গত সপ্তাহে মূলত হিজবুল্লাহর ব্যবহার করা স্বল্প প্রযুক্তির হাজার হাজার পেজার ও ওয়াকিটকিতে বিস্ফোরণের ঘটনায় অন্তত ৩৭ জন নিহত হয়েছেন। আহত প্রায় ৩ হাজার। লেবানন, হিজবুল্লাহ ও এই গোষ্ঠীর মিত্র যেমন ইরান এ ঘটনায় ইসরায়েলকে দায়ী করেছে। যদিও ইসরায়েল এর দায় স্বীকার করেনি, তবু অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ বলছেন, এটা ইসরায়েলেরই কাজ।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পেজার ও ওয়াকিটকিগুলো বিস্ফোরিত হওয়ার কয়েক মাস আগেই ইসরায়েল এসব যন্ত্রের ভেতর বিস্ফোরক ঢুকিয়ে দেয়। এ ঘটনার পর গতকাল লেবাননের নির্দিষ্ট এলাকার মানুষের ফোনে ফোনে সতর্কবার্তা পাঠানো ও কল করার মধ্য দিয়ে ইসরায়েল এ ইঙ্গিতই দিল যে শত্রু হিজবুল্লাহই শুধু নয়, সাধারণ লেবাননিদের ব্যক্তিগত তথ্যে অনুপ্রবেশ করার সক্ষমতাও রয়েছে তার।

অবশ্য ঝুঁকি ও সংঘাতবিষয়ক বিশ্লেষক এলিজাহ ম্যাগনিয়ারের মতে, এ ঘটনায় বিস্ময়ের কিছু নেই।

ইসরায়েলের হামলার আশঙ্কায় লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলের স্কুল বন্ধ ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ। এই খবরে দ্রুত শিশুদের নিয়ে নিরাপদে যাচ্ছেন অভিভাবকেরা।
দক্ষিণ লেবানন, ২৩ সেপ্টেম্বর ছবি: রয়টার্স

মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের সংঘাত ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করা এই বিশ্লেষক আল–জাজিরাকে বলেন, গত ৮ অক্টোবরের আগেই লেবাননের টেলিকম নেটওয়ার্ক হ্যাক করেছে ইসরায়েল।

এলিজাহ ম্যাগনিয়ার বলেন, ‘ল্যান্ডফোনের লাইন, গাড়ির প্লেট নম্বর, মোবাইল ফোনে তাদের (ইসরায়েল) প্রবেশাধিকার আছে। এর মানে হলো পশ্চিম তীর বা গাজার মতো লেবাননের দক্ষিণেও যেকোনো ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠায় সক্ষম তারা।’

ম্যাগনিয়ার আরও বলেন, অত্যাধুনিক গোয়েন্দা প্রযুক্তি ও সরঞ্জাম ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদকে ওই সব এলাকায় কারা বসবাস করেন, তাঁদের ফোন নম্বর কত, এমনকি তাঁদের বাসায় কাদের যাতায়াত, সেসব বিষয় নিখুঁতভাবে শনাক্ত করতে সক্ষম করে তুলেছে।

এই গোয়েন্দারা নির্দিষ্ট সরঞ্জাম নিয়ে শহরের সড়কগুলোতে গাড়ি চালিয়ে যাওয়ার সময় হাজার হাজার আইপি অ্যাড্রেস সংগ্রহ করতে সক্ষম বলে জানান এই বিশ্লেষক। সেই সঙ্গে কোনো এলাকায় হিজবুল্লাহর বৈঠকের মতো কোনো ‘অস্বাভাবিক ঘটনা’ ঘটছে কি না, সেটি শনাক্ত করা ও ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন করতেও সক্ষম তাঁরা—বলেন ম্যাগনিয়ার।