২৩ বছর জেলখাটা কে এই সিনওয়ার

আল-কুদস দিবসের অনুষ্ঠানে ভাষণ দেন ইয়াহিয়া সিনওয়ার। ১৪ এপ্রিল, ২০২৩ছবি: এএফপি

তেহরানে গত সপ্তাহে গুপ্তহত্যায় ইসমাইল হানিয়া নিহত হওয়ার পর হামাসের রাজনৈতিক শাখার নতুন প্রধান হিসেবে সদ্য নিয়োগ পেয়েছেন ইয়াহিয়া সিনওয়ার। গাজায় সংগঠনটির সামরিক শাখার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন তিনি।

হানিয়া হত্যাকাণ্ডের পর মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে উত্তেজনা যখন তুঙ্গে, ঠিক তখন হানিয়ার উত্তরসূরি হিসেবে গতকাল মঙ্গলবার সিনওয়ারের নাম ঘোষণা করা হয়। নিজের মাটিতে হানিয়াকে হত্যার ঘটনায় ইতিমধ্যে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ গ্রহণের অঙ্গীকার করেছে ইরান।

গত ৩১ জুলাই হানিয়ার ওপর ওই হামলার ঘটনায় ইসরায়েল এখনো তার সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার বা অস্বীকার কোনোটি করেনি।  

অজ্ঞাত স্থান থেকে সিনওয়ার তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে কতটুকু যোগাযোগ বজায় রাখতে সক্ষম হবেন, ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের দৈনন্দিন রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে ও গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠায় মধ্যস্থতার কাজ তদারক করতে পারবেন, সেসব বিষয়ে এখনো অস্পষ্টতা রয়ে গেছে।

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গত বছরের ৭ অক্টোবর নজিরবিহীন হামলা চালানোর মূল কারিগর সিনওয়ার ছিলেন বলে মনে করা হয়। এখন গাজার অজ্ঞাত স্থান থেকে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে হামাসের কার্যক্রম পরিচালনা করার চেষ্টা চালিয়ে যাবেন তিনি।

গাজাভিত্তিক ফিলিস্তিনি নেতা সিনওয়ার ইসরায়েলের এক নম্বর প্রকাশ্য শত্রু। তাই তাঁকে নতুন প্রধান হিসেবে ঘোষণা করে হামাস ইসরায়েল সরকারের প্রতি তার কঠোর মনোভাবেরই বার্তা পাঠাল।

তবে অজ্ঞাত স্থান থেকে সিনওয়ার তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে কতটুকু যোগাযোগ বজায় রাখতে সক্ষম হবেন, ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের দৈনন্দিন রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে ও গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠায় মধ্যস্থতার কাজ তদারক করতে পারবেন—সেসব বিষয়ে এখনো অস্পষ্টতা রয়ে গেছে।

দীর্ঘদিন ধরে আমরা শান্তিপূর্ণ উপায়ে ও জনসমর্থনভিত্তিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। আমরা আশা করেছি, গোটা বিশ্ব, মুক্ত মানুষেরা ও আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো আমাদের জনগণের পাশে দাঁড়াবে এবং আমাদের জনগণের বিরুদ্ধে দখলদার শক্তির (ইসরায়েল) অপরাধ ও নৃশংসতা বন্ধ করবে। দুঃখজনকভাবে, বিশ্ব নীরব দাঁড়িয়ে দেখেছে।
ইয়াহিয়া সিনওয়ার, হামাসের নতুন প্রধান

এদিকে সিনওয়ারকে হত্যার আকাঙ্ক্ষার বিষয়টি গোপন রাখেনি ইসরায়েল।
১৯৬২ সালে গাজার খান ইউনিস শহরে জন্মগ্রহণ করেন ইয়াহিয়া সিনওয়ার। তাঁকে প্রায়ই হামাসের সবচেয়ে অনমনীয় শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তাদের একজন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। ইসরায়েলের দখলদারত্বের বিরুদ্ধে গাজার ইসলামিক ইউনিভার্সিটিতে সোচ্চার ভূমিকা রাখায় আশির দশকের শুরুর দিকে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের হাতে বারবার গ্রেপ্তার হন সিনওয়ার।

ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গত বছরের ৭ অক্টোবর নজিরবিহীন হামলা চালানোর মূল কারিগর সিনওয়ার ছিলেন বলে মনে করা হয়। এখন গাজার অজ্ঞাত স্থান থেকে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে হামাসের কার্যক্রম পরিচালনা করার চেষ্টা চালিয়ে যাবেন তিনি।

বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রি সম্পন্ন করার পর ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তুলতে যোদ্ধাদের একটি নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠায় সিনওয়ার সহায়তা করেন। পরবর্তী সময়ে এ নেটওয়ার্ক হামাসের সশস্ত্র শাখা ইজ্জেদিন আল-কাসাম ব্রিগেড হিসেবে গড়ে ওঠে।

১৯৮৭ সালে শেখ আহমেদ ইয়াসিন হামাস প্রতিষ্ঠা করার পরপরই যাঁরা সংগঠনটির নেতৃত্বে আসেন, ইয়াহিয়া সিনওয়ার তাঁদের একজন। পরের বছরই ইসরায়েলি বাহিনী তাঁকে গ্রেপ্তার করে ও চার দফা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। যার অর্থ, ৪২৬ বছরের সমপরিমাণ কারাদণ্ড দেওয়া হয় তাঁকে। তাঁর বিরুদ্ধে ইসরায়েলি সেনা ও ইসরায়েলের পক্ষে কাজ করা সন্দেহভাজন চার ফিলিস্তিনি গুপ্তচরকে হত্যার অভিযোগ আনা হয়েছিল।

আরও পড়ুন

ইয়াহিয়া সিনওয়ার দীর্ঘ ২৩ বছর ইসরায়েলের কারাগারে কাটিয়েছেন। বন্দী অবস্থায় থেকেই শিখেছেন হিব্রু ভাষা। ভালোভাবে রপ্ত করেছেন ইসরায়েলের কূটকৌশল ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। পরে এক বন্দিবিনিময় চুক্তির আওতায় ২০১১ সালে মুক্তি পান। তাঁর বিনিময়ে বন্দী ইসরায়েলি সেনা গিলাদ শালিতকে ছেড়ে দেয় হামাস।

কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর দ্রুতই সিনওয়ার হামাসের শীর্ষ পদে ফেরত আসেন। ২০১২ সালে সংগঠনটির রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। দায়িত্ব পান সামরিক শাখা কাসাম ব্রিগেডের সঙ্গে রাজনৈতিক শাখার কার্যক্রম সমন্বয়ের।

২০১৪ সালে গাজায় সাত সপ্তাহ ধরে ব্যাপক হামলা ও অভিযান চালায় ইসরায়েল। ওই সময় হামাসের উভয় শাখায় নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রাখেন সিনওয়ার। পরের বছর যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে ‘বৈশ্বিক সন্ত্রাসী’ হিসেবে আখ্যায়িত করে।

২০১৭ সালে সিনওয়ার হামাসের গাজা শাখার প্রধান হন। স্থলাভিষিক্ত হন ইসমাইল হানিয়ার। হানিয়া তখন সংগঠনটির রাজনৈতিক শাখার প্রধান নির্বাচিত হন।
গাজায় ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু করলে হানিয়া মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ সফর করে বক্তব্য দেন। নিহত হওয়ার আগপর্যন্ত দেশে দেশে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সমর্থন আদায় ও গাজায় যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত ছিলেন তিনি। তবে ৭ অক্টোবরের পর থেকে একেবারেই কথাবার্তা বলেননি সিনওয়ার।

আরও পড়ুন

অবশ্য ২০২১ সালে ভাইস নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে সিনওয়ার বলেছিলেন, নিজেদের উচ্চ মূল্য দেওয়ার বিনিময়ে ফিলিস্তিনিরা যুদ্ধ চান না। কিন্তু তাঁরা সাদা পতাকাও (আত্মসমর্পণ করা) ওড়াবেন না।

সিনওয়ার আরও বলেছিলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আমরা শান্তিপূর্ণ উপায়ে ও জনসমর্থনভিত্তিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছি। আমরা আশা করেছি, গোটা বিশ্ব, মুক্ত মানুষেরা ও আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো আমাদের জনগণের পাশে দাঁড়াবে এবং আমাদের জনগণের বিরুদ্ধে দখলদার শক্তির (ইসরায়েল) অপরাধ ও নৃশংসতা বন্ধ করবে। দুঃখজনকভাবে, বিশ্ব নীরব দাঁড়িয়ে দেখেছে।’

ইসরায়েলে নির্বিচার রকেট হামলায় বেসামরিক লোকজনের ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে জেনেও হামাসের হামলার এমন কৌশল সম্পর্কে জানতে চাইলে সিনওয়ার বলেন, ‘ফিলিস্তিনিরা তাঁদের কাছে থাকা অবলম্বন দিয়েই লড়াই করছেন।’ বিপরীতে অত্যাধুনিক সব অস্ত্রশস্ত্র থাকার পরও ইসরায়েল ইচ্ছাকৃতভাবে বেসামরিক ফিলিস্তিনিদের বাছবিচার ছাড়াই হত্যা করছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।

হামাসপ্রধান উল্টো প্রশ্ন করেন, ‘বিশ্ব কি আমাদের কাছে এটাই আশা করে যে যখন আমরা মারা পড়ছি, তখন আমরা সদাচরণ করা ভুক্তভোগী হয়ে থাকব? ইসরায়েল আমাদের ধরে ধরে মারবে আর আমরা টুঁ শব্দটি করব না?’

আরও পড়ুন