গাজার বাসিন্দা মাশরাভি বললেন, এ কেমন শান্তি

গাজার খান ইউনিসে ধ্বংসস্তূপের পাশ দিয়ে শিশুকে নিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন এক নারীফাইল ছবি: রয়টার্স

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পরপর এক কবিতায় ফয়েজ আহমদ ফয়েজ প্রশ্ন করেছিলেন, ‘এমন কদাকার যে ভোর, এত দিন কি তারই অপেক্ষায় ছিলাম?’ গাজার বাসিন্দা আহমদ আল-মাশরাভিরও একই প্রশ্ন। মোট ৪৬৫ দিনের একতরফা যুদ্ধ শেষে সে ভূখণ্ডে যুদ্ধবিরতি হতে যাচ্ছে। গাজায় নেমেছে কবরের নীরবতা। নিউইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আল-মাশরাভি বলেছেন, ‘এ কেমন শান্তি? মাথার ওপর নিরাপদ আচ্ছাদন নেই। ঘরে খাবার নেই, সুপেয় পানি নেই, আমার সন্তানেরা ক্ষুধায় কাতরাচ্ছে। চারদিকে কেবলই ধ্বংস আর ধ্বংস। আপনি একে শান্তি বলেন?’

তারপরও গাজার ফিলিস্তিনবাসী ১৫ মাসের নৃশংসতার পর অর্জিত যুদ্ধবিরতিকে স্বাগত জানিয়েছে। তিন ধাপের সেই যুদ্ধবিরতির প্রথম দিন আজ রোববার। তবে কত দিন তা টেকে, সন্দেহ রয়েছে। মার্কিন চাপের মুখে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাঁর মন্ত্রিসভার কট্টরপন্থীদের চাপ অগ্রাহ্য করে যুদ্ধবিরতি অনুমোদন করিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু তা শুধু প্রথম ধাপ বা প্রথম ৪২ দিনের জন্য। সামান্য যেকোনো অজুহাতে ইসরায়েল হামাসকে চুক্তিভঙ্গের অভিযোগে যুদ্ধবিরতি বাতিল করতে পারে। আবার শুরু হতে পারে নির্বিচার বোমাবর্ষণ।

গাজা যুদ্ধবিরতির সবচেয়ে বড় ফায়দা যদি ট্রাম্পের হয়, তবে সবচেয়ে বড় ক্ষতি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের। এই যুদ্ধের তিনিই সবচেয়ে বড় ‘লুজার’। যুদ্ধের প্রথম দিন থেকে তিনি নেতানিয়াহুকে বুকে জড়িয়ে রেখেছিলেন।
গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি এলাকা
এএফপি ফাইল ছবি

ইসরায়েলি মন্ত্রিসভার কট্টরপন্থীরা ঠিক সেই সুযোগেরই অপেক্ষায় আছে। হামাস এখনো নিশ্চিহ্ন হয়নি, যথেষ্ট গাজাবাসীকে হত্যা করা হয়নি—এই যুক্তিতে অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মতরিচ ও জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেনগভির এই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে গোঁ ধরেছিলেন। চলতি শর্তে যুদ্ধবিরতি মেনে নিলে তাঁরা সরকার থেকে বেরিয়ে যাবেন, এমন হুমকিও তুলেছিলেন। মোটেই বিস্ময়ের ব্যাপার হবে না, যদি নিজের গদি টিকিয়ে রাখতে নেতানিয়াহু তাদের সে দাবি মেনে আবার যুদ্ধে ফিরে যান।

একটা জিনিস স্পষ্ট। অভ্যন্তরীণ আপত্তি অগ্রাহ্য করে নেতানিয়াহু যে যুদ্ধবিরতি চুক্তি কার্যকরণে সক্ষম হলেন, তার জন্য বাহবা ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রাপ্য। পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছিলেন, ২০ জানুয়ারি তাঁর শপথ গ্রহণের আগেই গাজা থেকে জিম্মিদের ফিরিয়ে আনতে হবে, অন্যথা মধ্যপ্রাচ্যে আগুন জ্বলবে।

যে প্রস্তাবের ভিত্তিতে এখন যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলো, অবিকল সেই চুক্তি গত বছরের মে মাসে প্রেসিডেন্ট বাইডেন ঢাকঢোল পিটিয়ে উপস্থিত করেছিলেন। একই প্রস্তাব জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে তিনি পাস করিয়েও নিয়েছিলেন। নেতানিয়াহু তাতে কান দেননি। এবার সেই একই প্রস্তাব তিনি মেনে নিয়েছেন দুই কারণে। প্রথমত, তাঁর কৌশলগত লক্ষ্য বহুলাংশে অর্জিত হয়েছে, হামাস ও হিজবুল্লাহ সামরিকভাবে পরাস্ত হয়েছে। অন্য কারণ, ট্রাম্পের দাবি মেনে নিয়েছেন, এমন একটি ভাব করে তিনি শুধু যে মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তাঁর বন্ধুত্ব আরও পোক্ত করলেন, তা-ই নয়, এ অঞ্চলে তাঁর অনর্জিত কৌশলগত স্বার্থ আদায়ের পথ প্রশস্ত করে রাখলেন। গাজার পর তাঁর লক্ষ্য ইরানের সামরিক স্থাপনা ও সিরিয়ায় ইসরায়েলি সামরিক উপস্থিতি।

মুখে বাইডেন অনেকবারই শান্তি ও যুদ্ধবিরতির কথা বলেছেন, কিন্তু সে কথা বলা শেষ হওয়ার আগেই গাজার যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য জাহাজবোঝাই বোমা ও গোলাবারুদ পাঠিয়েছেন। অনেক দিন পরও বিশ্বের মানুষ তাঁকে ‘জেনোসাইড জো’ নামেই ডাকবে।
যুদ্ধবিরতির আগের দিনেও গাজায় ইসরায়েলি হামলা অব্যাহত ছিল। মরদেহ জড়িয়ে ধরে স্বজনদের আহাজারি। গতকাল খান ইউনিসে
ছবি: এএফপি

গাজা যুদ্ধবিরতির সবচেয়ে বড় ফায়দা যদি ট্রাম্পের হয়, তবে সবচেয়ে বড় ক্ষতি প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের। এই যুদ্ধের তিনিই সবচেয়ে বড় ‘লুজার’। যুদ্ধের প্রথম দিন থেকে তিনি নেতানিয়াহুকে বুকে জড়িয়ে রেখেছিলেন। যুদ্ধের পুরো সময় তিনিই ছিলেন ইসরায়েলে প্রধান সমর সরঞ্জাম সরবরাহকারী। ভিয়েতনাম যুদ্ধে এক দশকের বেশি সময় যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৭ মিলিয়ন টন বোমা ব্যবহার করে। মাত্র ১৪১ বর্গমাইলের গাজায় ১৫ মাসে প্রায় একই পরিমাণ বোমা ফেলা হয়েছে। হাসপাতাল, স্কুল, উদ্বাস্তু শিবিরের মতো স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়েছে ২ হাজার টনের এমকে-৪২ বোমা, যার প্রতিটিতে লেখা ছিল ‘মেড ইন ইউএসএ’।

মুখে বাইডেন অনেকবারই শান্তি ও যুদ্ধবিরতির কথা বলেছেন, কিন্তু সে কথা বলা শেষ হওয়ার আগেই গাজার যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য জাহাজবোঝাই বোমা ও গোলাবারুদ পাঠিয়েছেন। অনেক দিন পরও বিশ্বের মানুষ তাঁকে ‘জেনোসাইড জো’ নামেই ডাকবে।

কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের ধারণা, গাজা যুদ্ধের একটি সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে ফিলিস্তিনের পূর্ণ স্বাধীনতা প্রশ্নে ‘টু স্টেট সলিউশন’ (দুই রাষ্ট্র সমাধান) নিয়ে আবার আলাপ-আলোচনার শুরু। টাইম ম্যাগাজিনের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেছেন, তিনি মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘস্থায়ী শান্তির পক্ষে। এই সদিচ্ছার জন্য তাঁকে ধন্যবাদ দেওয়া যায়, কিন্তু বাস্তবতা সেই সম্ভাবনা বাস্তবায়নের ইঙ্গিত দেয় না। তিনি নিজে এবং তাঁর প্রস্তাবিত মন্ত্রিসভার প্রত্যেকে ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র। মাইক হাকাবি, যাকে তিনি ইসরায়েলে পরবর্তী মার্কিন রাষ্ট্রদূত মনোনীত করেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, পুরো ফিলিস্তিনের ওপরেই ইসরায়েলের পূর্ণ অধিকার রয়েছে।

বোমাবাজি বন্ধ হলে আরব নাগরিকদের আর প্রতিদিন টিভির পর্দায় ফিলিস্তিনি শিশুদের মরা মুখ দেখতে হবে না। দুদিনেই তারা গাজা যুদ্ধের কথা ভুলে যাবে। তখন সৌদি যুবরাজের ইসরায়েলের সঙ্গে দোস্তিতে আপত্তির আর কোনো কারণই থাকবে না।
জর্জ টাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মার্ক লিঞ্চ

বিদায়ী মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন গত সপ্তাহে ওয়াশিংটনে এক ভাষণে বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তির সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধক ইসরায়েল। হামাসের সম্ভাব্য বিকল্প হতে পারে পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ। অথচ নেতানিয়াহু নিজে সুপরিকল্পিতভাবে তাদের কাজ করার ক্ষমতা খর্ব করেছেন। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আইন ভেঙে পশ্চিম তীরে অবৈধ ইহুদি বসতি তিনি বাড়িয়েই চলেছেন। একই সময়ে পশ্চিম তীরবাসীদের ওপর অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের হামলা তিনি দেখেও দেখছেন না। ‘মনে হয় না এ অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতারা তাঁদের নাগরিকদের স্বার্থরক্ষায় খুব একটা আগ্রহী’, হতাশ হয়ে বলেছেন ব্লিঙ্কেন।

আরব দেশগুলো সম্পর্কেও একই কথা। ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র গঠনের জন্য তারা চাপ সৃষ্টি করতে পারত, কিন্তু তাদের কেউই এ ব্যাপারে কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না। বরং উল্টো, মার্কিন প্রশাসনের উৎসাহ ও উদ্যোগে তারা ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণে অধিক আগ্রহী। ভাবা হচ্ছে, ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফায় ইসরায়েল ও সৌদি আরবের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হবে। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান গাজা যুদ্ধ চলাকালে তেমন কোনো কূটনৈতিক উদ্যোগে গররাজি ছিলেন (‘লোকে কী বলবে!’)। কিন্তু এখন সে অবস্থা বদলাতে পারে। জর্জ টাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মার্ক লিঞ্চ ফরেন অ্যাফেয়ার্স পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বোমাবাজি বন্ধ হলে আরব নাগরিকদের আর প্রতিদিন টিভির পর্দায় ফিলিস্তিনি শিশুদের মরা মুখ দেখতে হবে না। দুদিনেই তারা গাজা যুদ্ধের কথা ভুলে যাবে। তখন সৌদি যুবরাজের ইসরায়েলের সঙ্গে দোস্তিতে আপত্তির আর কোনো কারণই থাকবে না।