সিরিয়ার সংঘাত কি থামাতে পারবেন অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট আল-শারা

সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা। রাজধানী দামেস্কে একটি আলোচনায়, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ছবি: রয়টার্স

সিরিয়ায় বর্তমানে যে সংঘাত চলছে, সেটা দেশটির প্রায় ১৩ বছরের গৃহযুদ্ধের ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ ঘটনা। দেশটির ক্ষমতাচ্যুত প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদের অনুগত যোদ্ধারা এই সংঘাত শুরু করেছেন। সরকারের নিরাপত্তা বাহিনী ব্যাপক শক্তি নিয়ে পাল্টা হামলা শুরু করলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। এই সংঘাত বন্ধ করতে দেশটির অন্তর্বর্তী সরকারের প্রেসিডেন্ট আহমেদ আল-শারা হিমশিম খাচ্ছেন। তবে তিনি বলেন, এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের তিনি আইনের আওতায় আনবেন।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটসের (এসওএইচআর) তথ্যমতে, চলমান সংঘাতে এরই মধ্যে সিরিয়ার উপকূলীয় অঞ্চলে এক হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় শহর লাতাকিয়া ও তারতুসে ক্ষমতাচ্যুত বাশার আল-আসাদের অনুগত যোদ্ধারা সমন্বিতভাবে হামলা শুরু করেন। লাতাকিয়া ও তারতুস বাশার সরকারের শক্তিশালী ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। এখনো বিচ্ছিন্নভাবে সংঘাত-সংঘর্ষের খবর পাওয়া যাচ্ছে।

সিরিয়ার একটি কুর্দি সশস্ত্র গোষ্ঠীর এক শীর্ষ নেতা চলমান ভয়ংকর সহিংসতার জন্য তুরস্কের সহায়তাপুষ্ট কিছু উগ্র ইসলামি গোষ্ঠীকে দায়ী করেছেন। তাঁর দাবি, এসব গোষ্ঠীর সদস্যরা আলাউইত সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষকে হত্যা করছেন। বাশার আল–আসাদও এই সম্প্রদায়ের মানুষ। কিন্তু এই অভিযোগ নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে মুখ খোলেনি তুরস্ক।

আরও পড়ুন

অন্তর্বর্তী প্রেসিডেন্ট শারার কার্যালয় জানিয়েছে, সংঘাত ও উভয় পক্ষের হত্যাকাণ্ড তদন্ত করে দেখার জন্য একটি স্বাধীন কমিটি গঠন করা হচ্ছে। যোদ্ধাদের হাতে সংগঠিত হত্যাকাণ্ডের বিভিন্ন ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্স এসব ভিডিও তাৎক্ষণিক যাচাই করে দেখতে পারেনি।

সিরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনীর একটি সূত্র বলেছে, লাতাকিয়া, জাবলা ও বানিয়াস শহরে লড়াই কমে এসেছে। তবে দুর্গম এলাকায় তল্লাশি অব্যাহত রয়েছে। এসব এলাকায় বাশারপন্থী প্রায় পাঁচ হাজার বিদ্রোহী লুকিয়ে রয়েছেন।

সিরিয়ার বর্তমান নেতা আল-শারাকে বহুভাগে বিভক্ত দেশটিতে নানা ধরনের চাপ সামলাতে হচ্ছে। গত রোববার রাজধানী দামেস্কের মাজ্জাহ পাড়ায় একটি মসজিদে তিনি সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের জাতীয় ঐক্য ও দেশের শান্তি রক্ষা করতে হবে। আমরা মিলেমিশে বাস করতে পারি। সিরিয়ায় বর্তমানে চলমান এসব চ্যালেঞ্জ ঘটতে পারে বলে আগেই ধারণা করা গিয়েছিল।’

যুক্তরাষ্ট্রের নিন্দা

সিরিয়ার সেনাবাহিনীর সদস্যরা। আলেপ্পোতে, ৭ মার্চ ২০২৫
ছবি: রয়টার্স

গত ডিসেম্বরে শারার নেতৃত্বাধীন সুন্নি ইসলামপন্থী গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শাম (এইচটিএস) বাশারকে ক্ষমতাচ্যুত করে ক্ষমতা দখল করে। বাশার দেশ ছেড়ে রাশিয়ায় আশ্রয় নেন। কিন্তু দেশে তাঁর কিছু ঘনিষ্ঠ উপদেষ্টা ও সমর্থক রয়ে যান। তবে এরই মধ্যে শারার নেতৃত্বাধীন গোষ্ঠীর সদস্যরাই অন্তর্বর্তী সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ পান। অন্যদিকে নতুন এই সরকার সিরিয়ার সব সশস্ত্র বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ নিতে সক্ষম হয়।

আরও পড়ুন

বাশারের পতনের মধ্য দিয়ে তাঁর পরিবারের কয়েক দশকের শাসনের অবসান হয়েছে, যা নানা ধরনের নিপীড়নের জন্য কুখ্যাত হয়ে আছে। ২০১১ সালে দেশটিতে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ শুরু হলে তা কঠোর হাতে দমনের চেষ্টা করে বাশার সরকার, ফলে দেশটিতে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়।

দীর্ঘ এই গৃহযুদ্ধে বিভিন্ন পশ্চিমা দেশ, বেশির ভাগ আরব দেশ ও তুরস্ক বিদ্রোহীদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়। আর রাশিয়া ও ইরানের সহায়তাপুষ্ট বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী বাশারের পক্ষে দাঁড়ায়। এতে ভিন্ন ভিন্ন বহু পক্ষ ও স্বার্থের প্রক্সি যুদ্ধের ময়দানে পরিণত হয় সিরিয়া। এই যুদ্ধে লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। স্থানচ্যুত হয়েছেন কয়েক কোটি মানুষ।

বাশারের পতনের পর থেকে তুরস্কের সহায়তাপুষ্ট গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে কুর্দি বাহিনীগুলোর সংঘাত নতুন করে মাথাচাড়া দেয়। উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার অধিকাংশ অঞ্চল এসব কুর্দি গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে। বাশার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরপরই সিরিয়ার নানা সামরিক স্থাপনায় হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। কয়েকটি সূত্র বলেছে, সিরিয়াকে দুর্বল রাখতে যুক্তরাষ্ট্রে তদবির অব্যাহত রেখেছে ইসরায়েল।

অস্ত্র হাতে সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি অনুগত নিরাপত্তা বাহিনীর কয়েকজন সদস্য। ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী পশ্চিম সিরিয়ার লাতাকিয়া শহরে। ৯ মার্চ ২০২৫
ছবি: এএফপি

এক যুগের বেশি সময়ের যুদ্ধে সিরিয়ার অবকাঠামো প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এর সঙ্গে বাশার সরকারের ওপর দেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞায় ধুঁকছে দেশটির অর্থনীতি। এসব কিছুর কারণে দেশটিকে স্থিতিশীল করা বেশ চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়েছে।

‘উগ্র ইসলামপন্থী সন্ত্রাসীদের’ বিচারের আওতায় আনতে সিরিয়ার কর্তৃপক্ষগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। পাশাপাশি দেশটির ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়েছে ওয়াশিংটন। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্কও অভিযুক্ত ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

বিদ্রোহ বাড়ছে

বাশারের পতনের পর সিরিয়ার অবস্থা তুলনামূলকভাবে শান্ত ছিল। কিন্তু উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের লাতাকিয়া ও তারতুস প্রদেশে আলাউইত সম্প্রদায়ের বাশারপন্থীদের বিদ্রোহ বৃদ্ধি হওয়ায় নতুন সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীগুলো কঠোর অবস্থানে যায়। ফলে সেখানে সহিংসতা বাড়তে থাকে।

এসওএইচআর গত শনিবার জানিয়েছে, এরই মধ্যে এক হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ৭৪৫ জন সাধারণ মানুষ ও ১৪৮ জন বাশারপন্থী যোদ্ধা। নতুন সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য প্রায় ১২৫ জন।

এসওএইচআরের প্রধান রামি আবদুল রহমান বলেছেন, নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে আলাউইত সম্প্রদায়ের নারী ও শিশু রয়েছে। রোববার তিনি বলেন, ২০১৩ সালে দামেস্কের শহরতলিতে বাশার বাহিনী রাসায়নিক অস্ত্র দিয়ে হামলা চালিয়েছিল। তাতে নিহত হয়েছিলেন প্রায় ১ হাজার ৪০০ জন। বৃহস্পতিবার থেকে চলা সহিংসতা সেই হামলার পর সবচেয়ে ভয়াবহ।

বৃহস্পতিবার বাশারপন্থীদের সমন্বিত হামলায় নিজেদের তিন শতাধিক সদস্য নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে সিরিয়ার নিরাপত্তা বাহিনী। রোববার সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম সানা জানায়, বাশারের নিজের শহর লাতাকিয়ায় গণকবরের সন্ধান পাওয়া গেছে। এতে সাম্প্রতিক সংঘাতে নিহত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদেরও মরদেহ শনাক্ত হয়েছে।

আরও পড়ুন

বাশারপন্থী যোদ্ধারা আলাউইত সম্প্রদায়ের মানুষ। এটি শিয়া ধর্মাবলম্বীদের একটি শাখা। সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলীয় অঞ্চলেই এই সম্প্রদায়ের বেশির ভাগ মানুষ বাস করেন। বাশার আল-আসাদের পরিবারও এই সম্প্রদায়ের। কিন্তু এই সম্প্রদায়ের অধিকাংশের সঙ্গে বাশার পরিবারের কোনো সম্পর্ক নেই। গত বছরের ৮ ডিসেম্বর বাশার সরকারের পতনের পর থেকে এই সম্প্রদায়ের মানুষকে হামলার লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়ার অভিযোগ

কুর্দি কমান্ডার মাজলুম আবদি এক লিখিত মন্তব্যে রয়টার্সকে বলেন, সাধারণ মানুষকে হত্যার জন্য ‘তুরস্কের সমর্থিত ও উগ্র ইসলামপন্থী’ নানা সশস্ত্র গোষ্ঠীই প্রধানত দায়ী। এসব অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনতে তিনি শারার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।

বাশারপন্থীদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাতে লাতাকিয়ায় যাচ্ছেন সরকারি বাহিনীর সদস্যরা। ৬ মার্চ ২০২৫
ছবি: এএফপি

বেশ কিছু তরুণকে হত্যা এবং আলাউইত সম্প্রদায়ের গ্রাম ও শহরে ঘরে ঘরে তল্লাশি চালানোর জন্য দামেস্কের নতুন কর্তৃপক্ষকে দায়ী করা হচ্ছে। এসব ঘটনা কিছু অবাধ্য সশস্ত্র গোষ্ঠীর মাধ্যমে ঘটেছে, যারা বাশারপন্থীদের দমনে সরকারি নিরাপত্তা বাহিনীকে সহায়তা করতে এসেছিল। তারা দীর্ঘদিন ধরে আগের নানা অপরাধের জন্য বাশার সমর্থকদের দায়ী করে আসছিল।

কাদমুস শহরের এক বাসিন্দা রয়টার্সকে বলেছেন, শহর ও চারদিকের গ্রামের লোকজন নিজেদের বাঁচাতে আশপাশের মাঠ-প্রান্তরে পালিয়ে গেছেন। তিনি যোদ্ধাদের ট্যাংক ও ভারী অস্ত্রশস্ত্রের বহর নিয়ে আসতে দেখেছেন। তিনি নিজের শহরে ছোট ছোট ড্রোন দিয়ে ঘরবাড়ি ও প্রধান সড়কের পাশে থাকা গাড়ি জ্বালিয়ে দিতে দেখেছেন।

নিরাপত্তা বাহিনীর এক সদস্য জানিয়েছেন, বাশারপন্থীরা গত ২৪ ঘণ্টায় পানি ও বিদ্যুৎ সরবরাহের অনেক সরকারি স্থাপনায় হামলায় চালিয়েছেন। এতে এসব সেবা ব্যাহত হচ্ছে।

লাতাকিয়া পাহাড়ি অঞ্চলে নিরাপত্তা জোরদার করতে সেখানে অতিরিক্ত সেনা পাঠাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এসব দুর্গম বনে সরকারবিরোধী যোদ্ধারা লুকিয়ে রয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশের একটি সূত্র।