১৩ বার গ্রেপ্তার ৩১ বছরের কারাদণ্ড, তাঁর হাতে শান্তির নোবেল
কারাগারে বন্দী অবস্থায় এ বছর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেলেন ইরানি মানবাধিকারকর্মী নার্গিস মোহাম্মদি। ইরানের পুলিশ ১৩ বার গ্রেপ্তার করেছে তাঁকে। নানা অভিযোগে তাঁকে মোট ৩১ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ১৫৪ বার বেত্রাঘাতের দণ্ডও দেওয়া হয়েছিল এই নারী অধিকারকর্মীকে।
নরওয়ের নোবেল কমিটি আজ শুক্রবার এ পুরস্কারের জন্য ৫১ বছর বয়সী নার্গিস মোহাম্মদির নাম ঘোষণা করে। তিনি ইরানে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠা ও মৃত্যুদণ্ড বন্ধের জন্য কাজ করছেন। নোবেল কমিটি বলেছে, ইরানে নারীদের ওপর নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য তাঁকে এ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে।
‘গুজব ছড়ানোর’ অভিযোগের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হয়ে বর্তমানে তেহরানের কুখ্যাত এভিন কারাগারে বন্দী আছেন নার্গিস। ২০১০ সাল থেকে প্রায় অব্যাহতভাবে বন্দী থাকলেও কারাগার থেকেই তিনি নারীদের ওপর নির্যাতন ও নিপীড়নের ঘটনা প্রকাশ করে আসছেন।
পুরস্কার ঘোষণার সময় নোবেল কমিটি বলেছে, ইরানে নারীদের ওপর নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই, মানবাধিকার সমুন্নত রাখা এবং সবার অধিকার নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখার জন্য নার্গিস শান্তিতে নোবেল পেয়েছেন। এই সাহসী সংগ্রামের জন্য তাঁকে ব্যক্তিগতভাবে চরম মূল্য দিতে হয়েছে।
নার্গিস মোহাম্মদিকে নারী মুক্তি আন্দোলনের যোদ্ধা অভিহিত করে নরওয়ের নোবেল কমিটির প্রধান বেরিত রেইস–আনদেরসেন বলেন, ‘সব মিলিয়ে (ইরানি) কর্তৃপক্ষ তাঁকে ১৩ বার গ্রেপ্তার করেছে, ৫ বার দোষী সাব্যস্ত করেছে এবং মোট ৩১ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে। এ ছাড়া ১৫৪ বার বেত্রাঘাতের দণ্ডও দেওয়া হয়েছে। আমি যখন কথা বলছি, তখনো তিনি কারাগারে বন্দী।’
ইরান সরকারের প্রতি নার্গিসকে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন রেইস–আনদেরসেন। তিনি বলেন, ‘ইরানি কর্তৃপক্ষ সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে তাঁকে মুক্তি দেবে, যাতে তিনি এই সম্মাননা গ্রহণ করতে উপস্থিত হতে পারেন। আমরা এখন এটাই আশা করছি।’
নরওয়ের নোবেল কমিটির প্রধান তাঁর বক্তব্য শুরু করেন ‘নারী–জীবন–স্বাধীনতা’ শব্দগুলো দিয়ে, যা দিয়ে তিনি ইরানে গত বছর নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে সংঘটিত গণবিক্ষোভের দিকে ইঙ্গিত করেন। গত বছর সেপ্টেম্বরে ইরানের নীতি পুলিশের হেফাজতে মাসা আমিনি নামের ২২ বছরের এক তরুণীর মৃত্যুর পর এই বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল। ঠিকমতো হিজাব না পরায় ওই তরুণীকে আটক করা হয়েছিল।
পুলিশ হেফাজতে মাসা আমিনির মৃত্যুর প্রতিবাদে ছড়িয়ে পড়া এই আন্দোলন ছিল ইরানের শাসকগোষ্ঠীর জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। আন্দোলন দমনে ব্যাপক নিষ্ঠুরতা চালায় ইরান সরকার। বিক্ষোভকারী নারীদের ধরে নিয়ে কারাগারে চালানো হয় নির্মম নির্যাতন। গত ডিসেম্বরে নার্গিস মোহাম্মদি কারাগার থেকে বিবিসিকে পাঠানো এক চিঠিতে বন্দী নারীদের ওপর হওয়া ভয়াবহ শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের বিবরণ তুলে ধরেন।
নার্গিস মোহাম্মদি ইরানের মানবাধিকার সংস্থা ডিফেন্ডারস অব হিউম্যান রাইটস সেন্টারের ভাইস প্রেসিডেন্ট। এই সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন দুই দশক আগে শান্তিতে নোবেলজয়ী আরেক ইরানি নারী শিরিন এবাদি।
২০২০ সালে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে নার্গিস ইরানে নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে আত্মোৎসর্গের কারণ ব্যাখ্যা করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমার মতে, বিশ্বের যেকোনো জায়গা তা ইরান বা অন্য কোনো দেশ হোক না কেন, স্বাধীনতা ও ন্যায়বিচার অর্জনের লক্ষ্যে মানবাধিকার রক্ষার প্রচেষ্টা ও পদক্ষেপ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এতে নিজের মধ্যে দারুণ ভালো লাগা তৈরি হয়।’ নোবেল পুরস্কার জয়ের পরও নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় লড়াই চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন নার্গিস মোহাম্মদি।
‘বিশ্বের জন্য অনুপ্রেরণা’
নার্গিস মোহাম্মদির নোবেলজয় ভয়ভীতি, হয়রানি, সহিংসতা ও ধরপাকড়ের মুখে ইরানি নারীরা যে সাহসিকতা দেখিয়েছেন, তার প্রতি শ্রদ্ধা বলে উল্লেখ করেছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের মুখপাত্র এলিজাবেথ থ্রোসেল বলেন, এই পুরস্কার ইরানের নারীদের সাহসিকতা ও দৃঢ়সংকল্প এবং কীভাবে তা বিশ্বের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছে, সেই বিষয়কেই তুলে ধরেছে।
শান্তিতে নোবেল পাওয়ায় নার্গিসকে স্বাগত জানিয়ে গত বছর শান্তিতে নোবেল পাওয়া ইউক্রনের মানবাধিকার সংস্থা সেন্টার ফর সিভিল লিবার্টিসের প্রধান ওলেকসান্দ্রা মাতভিচাক বলেন, ‘আমরা যে বিশ্বে বসবাস করছি, সেখানে সবাই একে–অপরের সঙ্গে খুবই সম্পৃক্ত। বর্তমানে ইরানের মানুষ স্বাধীনতার জন্য লড়ছে। তাঁদের সফলতার ওপর আমাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে।’
নার্গিস মোহাম্মদির পরিবার বলেছে, তাঁর এই পুরস্কার লাভ ইরানে নাগরিকদের স্বাধীনতার জন্য যে লড়াই চলছে, তার একটি গুরুত্বপূর্ণ ও ঐতিহাসিক মুহূর্ত। নার্গিসের নোবেল শান্তি পুরস্কারের এই সম্মাননা সব ইরানির, বিশেষ করে ইরানের সেই সব সাহসী নারী ও মেয়েদের, যাঁরা স্বাধীনতা ও সাম্যের লড়াইয়ে বীরত্ব দেখিয়ে বিশ্বকে মুগ্ধ করেছেন।
যা বলছে ইরানের গণমাধ্যম
এই পুরস্কারের সমালোচনা করে ইরানের বার্তা সংস্থা ‘ফার্স’ বলেছে, ইরানের জাতীয় নিরাপত্তাবিরোধী কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকায় নার্গিস মোহাম্মদিকে নোবেল পুরস্কার দেওয়া হয়েছে। তিনি এই পুরস্কার পেয়েছেন পশ্চিমাদের কাছ থেকে। জাতীয় নিরাপত্তাবিরোধী নানা কর্মকাণ্ড করে তিনি একাধিকবার সংবাদের শিরোনাম হয়েছেন।