যুদ্ধের কারণে নবজাতক সন্তানদের থেকে আলাদা হয়ে পড়ছেন গাজার মায়েরা

উত্তর গাজার কামাল আদওয়ান হাসপাতালে অপরিণত অবস্থায় জন্ম নেয় ফিলিস্তিনি শিশু সান্দোস মুকাত। ইসরায়েলি সেনারা হাসপাতালে অভিযান চালালে শিশুটিকে দক্ষিণ গাজায় সরিয়ে নেওয়া হয়। শিশুটি এখন মা–বাবার কাছ থেকে আলাদা। মা ইয়েহিয়া হামুদা মুঠোফোনে শিশুটির ছবি দেখাচ্ছেন। জাবালিয়া, উত্তর গাজাফাইল ছবি: রয়টার্স

যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে জেরুজালেমে একসঙ্গে তিন সন্তান জন্ম দেন গাজার বাসিন্দা হানানে বায়ুক (২৬)। আর কিছুদিন পর শিশুগুলো এক বছর বয়সে পা রাখবে। তারা জন্মের পর নিজেদের মাকে শুধু একবারই দেখেছে। হানানে বায়ুকের আশঙ্কা, সন্তানদের ছাড়া তিনি মারা যাবেন।

হানানের তিন সন্তানের নাম নাজোয়া, নোয়ার ও নাজমেহ। ২০২৩ সালের ২৪ আগস্ট তাদের জন্ম। প্রসবের পর সন্তানদের রেখেই ফিলিস্তিনে ফিরে আসতে হয়েছিল হানানেকে। কারণ, তাঁর ইসরায়েলে ভ্রমণের অনুমতির মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছিল।

সন্তান গর্ভে ধারণের জন্য দীর্ঘ সাত বছর নানা দুর্ভোগ ও কষ্ট সয়েছেন হানানে। গ্রহণ করতে হয়েছে ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন বা আইভিএফ (টেস্টটিউবে ভ্রূণ নিষিক্ত করা) চিকিৎসাপদ্ধতি। অবশেষে পূর্ব জেরুজালেমের আল মাকাসেদ হাসপাতালে সন্তান জন্ম দিতে সক্ষম হন তিনি। জেরুজালেমে যাওয়ার জন্য আগেই অনুমতিপত্র নিতে হয়েছিল এই ফিলিস্তিনি নারীকে।

হেবা ইদরিস তাঁর নবজাতক কন্যাকে উত্তর গাজায় স্বামী সালেহর নিজের বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে চান। হেবা ও সালেহ দম্পতি ইসরায়েলি বিমান হামলায় এ পর্যন্ত নয়বার ঘর ছেড়েছেন। সালেহ তাঁর শিশুকন্যাকে শুধু ছবিতেই দেখেছেন। অশ্রুসিক্ত হেবা বলেন, ‘আমি আমার কন্যাকে দেখতে চাই, তার কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ায় আমি অনেক বেশি কষ্ট পাচ্ছি।’

জন্মের পর হানানের সন্তানদের ইনকিউবেটরে রাখা হয়েছিল। নবজাতকদের দেখার জন্য খুব বেশি সময় পাননি হানানে; বড়জোর দেড় ঘণ্টা। এরপরই তাঁকে গাজায় ফিরে আসতে হয়। হানানে বলেন, জেরুজালেমে থাকার অনুমতি শেষ হয়ে যাওয়ায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাঁকে চলে যেতে বলে।

অপরিণত অবস্থায় জন্ম হওয়ায় হানানের তিন সন্তানকে কয়েক সপ্তাহ ইনকিউবেটরে রাখতে হয়েছিল। গাজার হাসপাতালগুলোয় পর্যাপ্ত ইনকিউবেটর না থাকায় সন্তানদের পূর্ব জেরুজালেমে রাখা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। গত অক্টোবরে আবার সেখানে যাওয়ার কথা ছিল হানানের। কিন্তু এর আগেই ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ও ইসরায়েলের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যায়।

গাজা থেকে ইসরায়েলে প্রবেশের একমাত্র পথ ইরেজ টার্মিনাল। হানানে ওই পথ দিয়ে পূর্ব জেরুজালেম যেতে অনুমতিপত্রের জন্য ৫ অক্টোবর আবেদন করেছিলেন। কিন্তু এর দুই দিন পর হামাস যোদ্ধারা টার্মিনালের ভেতরে বিস্ফোরণ ঘটান।

আরও পড়ুন

ইসরায়েলি কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুসারে, ইসরায়েলে ৭ অক্টোবর হামাস যোদ্ধাদের নজিরবিহীন হামলায় ১ হাজার ১৯৮ জন নিহত হন। জবাবে সেদিন থেকেই গাজায় তাণ্ডব শুরু করে ইসরায়েল। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলি হামলায় এ পর্যন্ত ৪০ হাজার ২৬৫ জন নিহত হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কতজন হামাস যোদ্ধা আর কতজন বেসামরিক মানুষ, তা বিস্তারিতভাবে জানায়নি মন্ত্রণালয়। জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর বলছে, নিহত মানুষের মধ্যে বেশির ভাগই নারী ও শিশু।

হানানে বায়ুকের মতোই অবস্থা গাজার অবরুদ্ধ বাসিন্দা হেবা ইদরিসের (২৭)। তিনিও জেরুজালেমে তাঁর একমাত্র কন্যা সাইদার কাছে ফিরতে পারছেন না। দুই মাস আগে মাকাসেদ হাসপাতালে অপরিণত অবস্থায় জন্ম হয় সাইদার।

হেবা ইদরিস তাঁর নবজাতক কন্যাকে উত্তর গাজায় স্বামী সালেহর নিজের বাড়িতে ফিরিয়ে আনতে চান। হেবা ও সালেহ দম্পতি ইসরায়েলি বিমান হামলায় এ পর্যন্ত নয়বার ঘর ছেড়েছেন। সালেহ তাঁর শিশুকন্যাকে শুধু ছবিতেই দেখেছেন। অশ্রুসিক্ত হেবা বলেন, ‘আমি আমার কন্যাকে দেখতে চাই, তার কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ায় আমি অনেক বেশি কষ্ট পাচ্ছি।’

আরও পড়ুন

হানানে বায়ুকও ঘর ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। তিনি এখন দক্ষিণে বাস্তুচ্যুতদের একটি শিবিরে বসবাস করছেন। শ্বশুরবাড়ির সাত সদস্যকে নিয়ে একটি তাঁবুতে দিন কাটছে তাঁর। এএফপিকে তিনি বলেন, ‘এটা আমাকে পাগল বানিয়ে দিচ্ছে। অন্তঃসত্ত্বা হতে আমার অনেক সময় লেগেছে। এখন আমি সব সময় কাঁদি।’ যুদ্ধের কারণে গাজায় ফোনের নেটওয়ার্ক ভালো না থাকায় নবজাতকদের খবর নিতে পারেন না বলেও জানান তিনি।

হানানে বলেন, ‘আমি মাঝেমধ্যে ভাবি, মারা যাওয়ার আগে যদি আমার মেয়েদের গাজায় ফিরিয়ে আনতে পারতাম। কারণ, আমি তাদের একবারের জন্যও চুমু খেতে পারিনি। তবে আবার নিজের আবেগকে ধরে রাখি এবং নিজেকে বলি, যুদ্ধ থেকে অনেক দূরে নিরাপদে থাকাই ওদের জন্য ভালো।’

আরও পড়ুন

মাকাসেদ হাসপাতালের এনআইসিইউর পরিচালক হাতেল খামমাজ বলেন, সাধারণ সময়ে হলে নাজোয়া, নোয়ার ও নাজমেহকে এত লম্বা সময় হাসপাতালে রাখা সম্ভব হতো না। তবে এখন হাসপাতালটিতে শিশু জন্মের হার অনেক কমে গেছে। কারণ, ইসরায়েল গাজা থেকে মায়েদের সে দেশে ঢোকার অনুমতি বন্ধ করে দিয়েছে। ইসরায়েলের অনেক তল্লাশিচৌকি দিয়ে গাড়ি চলাচল বন্ধ। এমনকি যাঁদের কাছে অনুমতিপত্র আছে, তাঁরাও জেরুজালেমে বিশেষ সুবিধা পাচ্ছেন না।

খামমাজ আরও বলেন, ‘যুদ্ধ শুরুর আগে আমাদের হাসপাতালের এনআইসিইউতে গাজার সাত থেকে আটটি শিশু ছিল। সেখানে একসঙ্গে ৩০ জনকে সেবা দেওয়া যায়। কিন্তু অক্টোবরের পর কেউই এখানে ভর্তি হয়নি। এ ছাড়া পশ্চিম তীরের অনেক অসুস্থ মানুষ আমাদের কাছে আসতে পারছেন না।’