মধ্যপ্রাচ্যের বড় হুমকি এখন ধূলিঝড়
আকাশ কমলা হয়ে উঠেছে। হাসপাতালগুলো ব্যস্ত। ইরাকের হাজারো মানুষ হাসপাতালের জরুরি কক্ষে গিয়ে ভিড় করছে। তাদের অভিযোগ, শ্বাস নিতে পারছে না তারা। বেশ কিছু মানুষকে শ্বাসযন্ত্র ব্যবহার করতে হচ্ছে। অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মীদের বাড়িতে থেকে কাজ করতে বলেছে। অনেক স্কুল বন্ধ। বিমানবন্দরগুলোতে ফ্লাইট বন্ধ করতে হয়েছে। এর কারণ মারাত্মক ধূলিঝড়। মরুভূমির বালুর ঘূর্ণিতে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক জায়গায় জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। সেখানকার মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য এ ঝড় বড় হুমকি হয়ে উঠছে।
গত এপ্রিল থেকে ইরাকে প্রায় প্রতি সপ্তাহে তীব্র ধূলিঝড়ের এ দৃশ্য দেখা যাচ্ছে। কয়েক দশক আগে প্রতিবছর দুই বা তিনটি বড় বালুর ঝড় দেখা যেত। অথচ এবারের বসন্তেই ইরাক ইতিমধ্যে কমপক্ষে আটটি ঝড়ের মুখে পড়েছে। এর মধ্যে গত ১৬ মের একটি ঝড়েই প্রায় চার হাজার মানুষকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। এর মধ্যে সিরিয়া সীমান্তে ঝড়ে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। ঘন ঘন বালুর এ ঝড় লাখো মানুষের জন্য দুর্দশা সৃষ্টি করছে এবং বিলিয়ন ডলারের ক্ষতি করছে।
ইকোনমিস্টের তথ্য অনুযায়ী, বালুর ঝড় সব সময় মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মানুষের জীবনের একটি বাস্তবতা। বিশ্বের বৃহত্তম উষ্ণ মরুভূমি সাহারা ও তৃতীয় স্থানে থাকা আরব মরুভূমি এ অঞ্চলেই রয়েছে। প্রতিবছর বাতাস প্রায় ছয় কোটি টন সাহারার বালু ক্যারিবীয় অঞ্চলে বয়ে নিয়ে যায়।
কিছু কিছু দেশে ধূলিঝড়ের একটি সাধারণ নাম দেওয়া হয়। আরব উপকূলে শ্যামল নামের এ ঝড় দক্ষিণ–পশ্চিমে প্রবাহিত হয়। দুবাইয়ের আকাশচুম্বী ভবন, বাহরাইনের রাজধানী মানামা ধুলার আস্তরণে ঢেকে যায়। মিসরীয়দের কাছে এ ধূলিঝড় খামসিন নামে পরিচিত। বসন্তের সময় এ ঝড় বয়ে যায়। সাহারা অঞ্চলে সূর্যকে আড়াল করার মতো যথেষ্ট বালু এর মধ্যে যুক্ত থাকে।
বার্তা সংস্থা এএফপি জানায়, ধূলিঝড় যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা গত মে মাসে টের পেয়েছে আরব বিশ্বের দেশগুলো। মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বয়ে যাওয়া ওই ঝড় আঘাত হানে সংযুক্ত আরব আমিরাতেও। এতে দেশটিতে জরুরি সতর্কতা জারি করা হয়। ধূলিঝড়ের কারণে ধুলায় ছেয়ে যায় চারপাশ। এতে বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন দুবাইয়ের বুর্জ খলিফা কিছু সময়ের জন্য চোখের আড়ালে চলে যায়।
দুবাইয়ে অবস্থিত বুর্জ খলিফার উচ্চতা ৮২৮ মিটার (২ হাজার ৭১৬ ফুট ৬ ইঞ্চি)। এটি বিশ্বের সর্বোচ্চ ভবন হিসেবে পরিচিত। এটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রধান অর্থনৈতিক কেন্দ্র। আশপাশের অনেক এলাকা থেকে এটি খালি চোখেই দেখা যায়। তবে ওই ধুলার ঝড়ের সময় মনে হচ্ছিল, বুর্জ খলিফার ওপরে কেউ ধুলার আস্তরণ বিছিয়ে দিয়েছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত ছাড়াও ধুলার ঝড়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে ইরাক, কুয়েত, সৌদি আরব, ইরানসহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো। ঝড় আসার খবরে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অনেক বিমানবন্দর, স্কুলসহ বিভিন্ন স্থাপনা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
মধ্যপ্রাচ্যে ধূলিঝড় এখন আরও ঘন ঘন ও তীব্র হয়ে উঠছে। এ প্রবণতার কারণ হিসেবে অতিরিক্ত ঘাস কেটে ফেলা, বন উজাড়, নদীর পানির অত্যধিক ব্যবহার ও বাঁধনির্মাণকে দায়ী করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞেরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন আঞ্চলিক আবহাওয়ার ধরনকে বিপর্যস্ত করে তুলছে। মরুকরণের ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যেতে পারে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, ধুলার ঝড় অনেক জটিল এবং এটা সহজে বুঝতে পারার মতো বিষয় নয়। তবে এর মূল কারণ প্রাকৃতিক। ২০১৫ সালে অনেকেই ভয়ংকর ঝড়ের জন্য সিরিয়ার গৃহযুদ্ধকে দায়ী করেন। অনেকেই মনে করেন, সাঁজোয়া যানের কারণে ওই অঞ্চলে ব্যাপক ধুলার সৃষ্টি হয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা এ ঝড়ের পেছনে বাতাস ও অতিরিক্ত গরমকে দায়ী করেন। তাঁরা এ ক্ষেত্রে বন্দুকধারীদের ভূমিকা পাননি।
তবে মধ্যপ্রাচ্যে ধূলিঝড় সৃষ্টিতে মানবসৃষ্ট কারণও ভূমিকা রাখছে। পানির ঘাটতি ওই অঞ্চলকে আরও শুষ্ক করে তুলছে। বিশ্বব্যাংকের করা ২০১৯ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, মানবসৃষ্ট কর্মকাণ্ড যেমন নদী ও হ্রদের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে ধূলিকণার চার ভাগের এক ভাগ তৈরি হয়েছে।
ইরান কৃষিকাজের জন্য জলাভূমি শুকিয়ে ফেলেছে। ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন বাসিন্দাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য দক্ষিণ ইরাকের জলাভূমি শুকিয়েছিলেন। টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিসের ওপর বাঁধ দিয়ে কিছু অঞ্চল শুকিয়ে ফেলেছে তুরস্ক। এর অর্থ বাতাসে আরও বেশি ধূলিকণা উড়বে। অগ্নিকাণ্ড ও গাছ কাটার কারণে এ অঞ্চলের স্বল্প বনভূমি আরও সংকুচিত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, সিরিয়া ২০০১ সাল থেকে প্রায় ২৫ শতাংশ বনভূমি হারিয়েছে। যাঁরা স্বাস্থ্যবান ও বাড়ির ভেতরে থাকার মতো ভাগ্যবান, তাঁদের কাছে বালুর ঝড় উপদ্রব বলে মনে হয়। কিন্তু মিশরের কায়রোর মতো এলাকায় যাঁরা নতুন আসেন, তাঁরা ভুলেও জানালা খোলা রাখলে বিপদে পড়ে যান। যাঁদের বাইরে কাজের জন্য যেতে হয়, তাঁদের জীবনও দুর্বিষহ হয়ে পড়ে।
কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে, ১০ শতাংশের বেশি সৌদি নাগরিকের অ্যাজমা রয়েছে। এর পেছনে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কারণ ধূলিকণা। ধূলিঝড়ের কারণে অনেক ক্ষুদ্র বালুকণা ফুসফুসে চলে যায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, প্রতি ঘনমিটারে পাঁচ মাইক্রোগ্রামের বেশি ধূলিকণা অস্বাস্থ্যকর। কাতারের জনগণ এর চেয়ে আট গুণ বেশি ধূলিকণায় শ্বাস নেয়।
বিশ্বব্যাংক বলছে, বায়ুদূষণে মধ্যপ্রাচ্যে প্রতিবছর ৩০ হাজারের বেশি মানুষ অকালমৃত্যুর শিকার হয়। এ মৃত্যু আরও বাড়ছে। এর অর্থনৈতিক ক্ষতিও ব্যাপক। কর্মীদের বাড়িতে থেকে কাজ করতে হয়। ফসল বালুতে ডুবে যায়।
বিমানবন্দরগুলোকে ফ্লাইট বাতিল করতে হয়। জাতিসংঘের হিসাবে, মধ্যপ্রাচ্যে ধূলিঝড়ে সরাসরি অর্থনৈতিক ক্ষতি প্রতিবছর ১ হাজার ৩০০ কোটি মার্কিন ডলার। এর বাইরে পরোক্ষ ক্ষতিও অনেক।
বিশেষজ্ঞেরা মনে করছেন, মাঝেমধ্যে ধূলিঝড় একটি অসুবিধামাত্র, কিন্তু ঘন ঘন হলে তা মহামারি হবে।
এএফপি, রয়টার্স ও ইকোনমিস্ট অবলম্বনে মো. মিন্টু হোসেন