ইরানকে শত শত কোটি ডলার কেন ফিরিয়ে দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র

রয়টার্সের প্রতীকী ছবি

যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের বৈরী সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। একে অপরকে চাপে ফেলতে নানা সময়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে দুই দেশ। এরই মধ্যে চলতি সপ্তাহে সম্ভাব্য একটি চুক্তির বিষয়ে একমত হয়েছে ওয়াশিংটন ও তেহরান। ওই চুক্তির আওতায় যুক্তরাষ্ট্রের জব্দ করা ইরানের শত শত কোটি ডলারের সম্পদ ফিরিয়ে দেওয়া হবে। একই সঙ্গে বন্দিবিনিময় করবে দুই দেশ।

চুক্তির বিষয়টি ঘোষণা করা হয়েছে গত বৃহস্পতিবার। এর আগে মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে কয়েক মাস ধরে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। বৃহস্পতিবারই ইরানে চার মার্কিন বন্দীকে কারাগার থেকে সরিয়ে গৃহবন্দী অবস্থায় রাখা হয়েছে। আরেক মার্কিনকে আগে থেকেই গৃহবন্দী করে রেখেছিল তেহরান। এদিকে যুক্তরাষ্ট্রে বন্দী অনেক ইরানিকেও মুক্তি দেওয়া হচ্ছে। তবে তাঁদের সংখ্যা কত, তা জানা যায়নি।

যুক্তরাষ্ট্রের জব্দ করা ইরানের অর্থ দক্ষিণ কোরিয়ার ব্যাংক থেকে কাতারে পাঠানো হবে। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানা যায়নি। এদিকে ইরানে বর্তমানে গৃহবন্দী থাকা পাঁচ মার্কিনকে কবে নাগাদ পুরোপুরি মুক্তি দেওয়া হবে, তা-ও স্পষ্ট নয়। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের কর্মকর্তাদের বিশ্বাস, সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি বা শেষ নাগাদ চুক্তির শর্তগুলো পূরণ হবে।

কী আছে চুক্তিতে

২০১৯ সালের আগে ইরান থেকে জ্বালানি তেল কিনেছিল দক্ষিণ কোরিয়া। তবে তার দাম পরিশোধ করা হয়নি। পরে ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এ-সংক্রান্ত লেনদেনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে ওই অর্থ আটকে যায়। সেই অর্থই বর্তমানে চুক্তির আওতায় ইরানে ফিরিয়ে দেওয়ার অনুমতি দিয়েছে ওয়াশিংটন।

ইরানের পাওনা অর্থ এখন দক্ষিণ কোরিয়ায় দেশটির মুদ্রা ওন থেকে ইউরোতে রূপান্তর করা হবে। এরপর তা পাঠানো হবে কাতারে। ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের চুক্তিতে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করেছে কাতার। মুদ্রার বিনিময় হার অনুযায়ী, ওই অর্থের পরিমাণ ৬০০ থেকে ৭০০ কোটি ডলারের মধ্যে হতে পারে।

২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি করে যুক্তরাষ্ট্রসহ ছয় দেশ। পরে ২০১৮ সালে ওই চুক্তি থেকে সরে যান যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এরপর তেহরানের ওপর একাধিক নিষেধাজ্ঞা দেয় ওয়াশিংটন। এতে দেশটির অর্থনীতির ওপর ব্যাপক চাপ পড়ে।

এ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কিছু শর্ত আছে। যেমন ওই অর্থ শুধু ওষুধ ও খাবারের মতো মানবিক পণ্য কেনাবেচায় ব্যবহার করা যাবে। ইরানের অনেকের দাবি, চুক্তি অনুযায়ী ওই অর্থ ইরানকে ফিরিয়ে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও ওই অর্থের ওপর তেহরানের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ থাকবে না। আর যুক্তরাষ্ট্রের শর্ত মেনে ইরান ফেরত পাওয়া অর্থ খরচ করছে কি না, তা কীভাবে নজরদারি করা হবে, সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেনি কাতার।

এর বিনিময়ে পাঁচজন ইরানি বংশোদ্ভূত মার্কিনকে মুক্তি দেবে তেহরান। বর্তমানে তাঁরা তেহরানের একটি হোটেলে নজরদারির আওতায় রয়েছেন বলে জানিয়েছেন তাঁদের হয়ে কাজ করা যুক্তরাষ্ট্রের একজন আইনজীবী।  

অর্থ ফিরিয়ে দিতে দীর্ঘ সময় লাগবে কেন

দক্ষিণ কোরিয়ার মুদ্রা ওনে জব্দ থাকা অর্থ ফেরত নিতে রাজি নয় ইরান। কারণ, এটি ডলার বা ইউরোর মতো অতটা বিনিময়যোগ্য নয়। যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দক্ষিণ কোরিয়া ওই অর্থ ইরানে ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে আপত্তি জানায়নি। তবে একসঙ্গে এই বিপুল পরিমাণ ওন (৬০০ থেকে ৭০০ কোটি ডলারের সমপরিমাণ) অন্য মুদ্রায় রূপান্তর করা হলে তা দক্ষিণ কোরিয়ার অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন দেশটির নীতিনির্ধারকেরা।

এ কারণেই দক্ষিণ কোরিয়া ধীরগতিতে এগোচ্ছে। জব্দ থাকা অর্থ ধীরে ধীরে ছাড় করে কাতারের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে পাঠাচ্ছে তারা। এদিকে ইরানের ওপর যেহেতু যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে, তাই এই লেনদেন যেন নিষেধাজ্ঞার আওতায় না পড়ে, তা-ও মাথায় রেখে কাজ করতে হচ্ছে। তাই কাতারের মতো তৃতীয় কোনো দেশের মাধ্যমে অর্থ লেনদেনের জটিল ও সময়সাপেক্ষ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

এ নিয়ে গত শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র জন কিরবি বলেন, ‘এ নিয়ে আমরা দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে গভীরভাবে কাজ করেছি। এখন দেশটি থেকে কাতারের ব্যাংক হিসাবে অর্থ পাঠানোয় কোনো বাধা নেই।’

ইরানে আটক মার্কিন কারা

ইরানি বংশোদ্ভূত যে পাঁচ মার্কিনকে তেহরান মুক্তি দিতে রাজি হয়েছে, তাঁদের মধ্যে তিনজনের নাম প্রকাশ করা হয়েছে। বাকি দুজনের পরিচয় এখনো জানা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্র বা ইরান—কেউই তাঁদের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।

যাঁদের পরিচয় জানা গেছে, তাঁদের মধ্যে প্রথমে রয়েছেন সিয়ামাক নামাজি। ২০১৫ সালে গ্রেপ্তার করা হয় তাঁকে। পরে গুপ্তচরবৃত্তির দায়ে তাঁকে ১০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগটি আন্তর্জাতিকভাবে সমালোচিত হয়েছিল। আরেকজন হলেন ইমাদ শারঘি। তাঁকে ১০ বছরের সাজা দেওয়া হয়েছিল। আর তৃতীয়জন হলেন মোরাদ তাহবাজ। ২০১৮ সালে গ্রেপ্তারের পর তাঁকেও ১০ বছরের সাজা দেওয়া হয়।

ইরানের পাওনা অর্থ এখন দক্ষিণ কোরিয়ায় দেশটির মুদ্রা ওন থেকে ইউরোতে রূপান্তর করা হবে। এরপর তা পাঠানো হবে কাতারে। মুদ্রার বিনিময় হার অনুযায়ী, ওই অর্থের পরিমাণ ৬০০ থেকে ৭০০ কোটি ডলারের মধ্যে হতে পারে।

মুক্তি পেতে যাওয়া পাঁচজনের হয়ে যাঁরা কাজ করছেন তাঁরা জানিয়েছেন, ওই ব্যক্তিরা নির্দোষ। তাঁদের অকারণে বন্দী করে রাখা হয়েছে। ১৯৭৯‍ সালে ইরানে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকেই পশ্চিমাদের সঙ্গে নানা ইস্যুতে দর-কষাকষির জন্য এমন বন্দীদের কাজে লাগিয়ে আসছে তেহরান।

এখন কেন চুক্তি

২০১৫ সালে ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি করে যুক্তরাষ্ট্রসহ ছয় দেশ। পরে ২০১৮ সালে ওই চুক্তি থেকে সরে যান যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এরপর তেহরানের ওপর একাধিক নিষেধাজ্ঞা দেয় ওয়াশিংটন। এতে দেশটির অর্থনীতির ওপর ব্যাপক চাপ পড়ে। এখন দক্ষিণ কোরিয়ায় জব্দ থাকা অর্থ ফিরে পেলে তা ইরানের অর্থনীতিকে অনেকটা চাঙা করবে।

এদিকে বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইরানকে আবার ওই পারমাণবিক চুক্তিতে ফিরিয়ে আনতে চাইছেন। গত বছরে ওই চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী কয়েকটি দেশ ইরানকে আবার চুক্তিতে ফিরে আসার প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে তেহরান ওই প্রস্তাব গ্রহণ করেনি। এখনো ইরানকে চুক্তিতে ফিরিয়ে আনার বিষয়ে কথা চলছে মার্কিন কংগ্রেসে।

ইরানকে জব্দ করা অর্থ ফিরিয়ে দেওয়া নিয়েও কম সমালোচনা হচ্ছে না। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট মাইক পেন্স, সিনেটের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক কমিটির রিপাবলিকান সদস্য জিম রিসচ ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও—সবাই অর্থের এই লেনদেনকে মুক্তিপণের সঙ্গে তুলনা করেছেন। তাঁদের ভাষ্য, বাইডেন প্রশাসনের এই কর্মকাণ্ডের জেরে ইরান আরও মানুষকে বন্দী করতে আগ্রহী হবে।

তাহলে কি যুক্তরাষ্ট্র-ইরান উত্তেজনা কমছে

এর উত্তর মোটাদাগে ‘না’। পারমাণবিক চুক্তি ও আণবিক বোমা নিয়ে তেহরানের উচ্চাকাঙ্ক্ষার কারণে আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্র ও ইরানের সম্পর্ক তলানিতে। এরপর আবার ২০১৯ সাল থেকে মধ্যপ্রাচ্যে একের পর এক হামলা এবং জাহাজ দখলের জন্য দায়ী করা হচ্ছে ইরানকে।

এর জেরে হরমুজ প্রণালিতে বাণিজ্যিক জাহাজগুলোকে নিরাপত্তা দিতে মার্কিন সেনা মোতায়েনের পরিকল্পনা পেন্টাগনের বিবেচনায় রয়েছে। হরমুজ প্রণালি ব্যবহার করে পারস্য উপসাগর থেকে বিপুল পরিমাণ জ্বালানি তেল আনা-নেওয়া করা হয়।

এরই মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে রাশিয়ার কাছাকাছি এসেছে ইরান। ইউক্রেনে হামলা চালাতে মস্কোকে ড্রোন দিয়ে সহায়তা করছে তেহরান। এই যুদ্ধে কিয়েভের পাশে রয়েছে ওয়াশিংটন। সব মিলিয়ে ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক আরও বৈরিতার দিকে এগোচ্ছে।