জনপ্রিয় যেসব প্রযুক্তি বদলে দিচ্ছে চারপাশ
দ্রুতগতিতে বদলে যাচ্ছে প্রযুক্তি খাত। এতে পরিবর্তন এবং অগ্রগতি আরও ত্বরান্বিত হচ্ছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের পেশাদারেরা বুঝতে পারছেন, ভবিষ্যতে তাঁদের ভূমিকাও বদলে যাবে। তাঁদের প্রযুক্তি ও যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে ক্রমাগত শিখতে হবে। উদীয়মান প্রযুক্তি এবং সর্বশেষ ট্রেন্ডগুলোর সঙ্গে হালনাগাদ থাকতে হবে। ভবিষ্যতে ব্যাপকভাবে প্রসারিত হতে পারে, এমন প্রযুক্তি খাতের জনপ্রিয় ১০টি খাত নিয়ে এ লেখা।
জেন এআই
প্রযুক্তিজগতে এখন সবখানেই আলোচনা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই নিয়ে। এর মধ্যে প্রযুক্তি দুনিয়ায় যে ট্রেন্ড চলছে, তা মূলত জেন-এআই নিয়ে। জেন-এআই বা জেনারেটিভ এআই অত্যন্ত পরিশীলিত এবং মানবসদৃশ আধেয় বা কনটেন্ট তৈরির ক্ষমতার মাধ্যমে প্রযুক্তি খাতে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে। কয়েক দশক ধরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মূলত বিশ্লেষণী কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এতে বিশাল তথ্যভান্ডার (বিশাল ডেটা সেট) বিশ্লেষণ করে কোনো বিষয়ের প্রশিক্ষণ দেওয়া বা ধরন চিহ্নিত করার কাজ করার সুবিধা পাওয়া যায়।
তবে এ ক্ষেত্রে উন্নতির ফলে ‘জেনারেটিভ এআই’ ক্ষেত্রটির ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। জেনারেটিভ এআই হচ্ছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার একটি রূপ, যা কোনো বস্তু তৈরি করতে পারে। এই প্রযুক্তি কোনো শব্দ, ছবি ও ভিডিওর মতো বিষয় সৃষ্টি করতে পারে। অনেক সময় এই পদ্ধতি মানুষের সৃজনশীলতার মতো জটিল বিষয়টি অনুকরণ করে থাকে। জিপিটি এবং মাল্টিমোডাল সিস্টেমের মতো জেনারেটিভ মডেলের অগ্রগতি, কনটেন্ট তৈরি, ডিজাইন অটোমেশন ও ইন্টারঅ্যাক্টিভ অভিজ্ঞতায় নতুন অ্যাপ্লিকেশন তৈরি হচ্ছে। এ প্রযুক্তি উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর পাশাপাশি সমস্যার সমাধান, গ্রাহকের সঙ্গে যুক্ততা এবং সৃজনশীল প্রক্রিয়ার মতো নানা ক্ষেত্রে কাজ করছে। কর্মক্ষেত্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান জেনারেটিভ এআই যুক্ত করার কাজ বিস্তৃত করবে।
কোয়ান্টাম কম্পিউটিং
কোয়ান্টাম কম্পিউটারগুলো নির্দিষ্ট কাজের জন্য ক্লাসিক্যাল কম্পিউটারের তুলনায় দ্রুত তথ্য প্রক্রিয়াকরণের জন্য কোয়ান্টাম মেকানিকসের বৈশিষ্ট্যগুলোকে কাজে লাগায়। আমরা ইতিমধ্যে ক্রিপ্টোগ্রাফির মতো ক্ষেত্রগুলোতে কোয়ান্টাম কম্পিউটিং প্রয়োগ করতে দেখছি। বর্তমানে নিরাপদ বিবেচিত কোডগুলোকে ক্র্যাক করা বা ভেঙে ফেলা, ওষুধ আবিষ্কার, নির্ভুল আণবিক কাঠামো তৈরির কাজে এর ব্যবহার দেখা যায়। কোয়ান্টাম কম্পিউটার এখনো অনেকটাই প্রাথমিক অবস্থায় রয়েছে; কিন্তু ঐতিহ্যবাহী কম্পিউটারে যেসব জটিল সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়, সে ক্ষেত্রে বিপ্লব আনতে পারে এ প্রযুক্তি।
ফাইভজি
পঞ্চম প্রজন্মের মোবাইল নেটওয়ার্ক প্রযুক্তি ৫জির সম্ভাবনা সম্পর্কে বিশ্লেষকেরা দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছেন। উদীয়মান এ প্রযুক্তির ট্রেন্ড ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। দ্রুতগতির ডেটা ডাউনলোড ও আপলোড, বিস্তৃত এলাকায় ব৵বহার ও স্থিতিশীল সংযোগ পাওয়া যায় ৫জি নেটওয়ার্কে। ৫জির সম্প্রসারণ ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি), অগমেন্টেড রিয়েলিটি এবং স্বয়ংক্রিয় যানবাহনের মতো রূপান্তরকারী প্রযুক্তিগুলোকে উচ্চগতির ও কম বিলম্বিত সংযোগ প্রদানের মাধ্যমে সহজতর করে। এই প্রযুক্তি রিয়েলটাইম যোগাযোগ সক্ষম করার জন্য এবং ন্যূনতম বিলম্বে প্রচুর পরিমাণে ডেটা প্রক্রিয়াকরণের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে এ প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
ভিআর ২.০
উন্নত ভিআর প্রযুক্তি আরও সংযোগ স্থাপন এবং বাস্তবসম্মত অভিজ্ঞতা দিচ্ছে। ডিসপ্লে রেজল্যুশন, মোশন ট্র্যাকিং এবং ইন্টারঅ্যাক্টিভ উপাদানগুলোর উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে গেমিং, প্রশিক্ষণ এবং থেরাপিউটিক প্রেক্ষাপটে ভিআর ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। হালকা হেডসেট এবং দীর্ঘ ব্যাটারি লাইফসহ নতুন ভিআর সিস্টেমগুলো আরও ব্যবহারবান্ধব হয়ে উঠছে। এতে এ প্রযুক্তি আরও বেশি গ্রাহক কিনতে পারেন এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবনে যুক্ত হতে পারে।
অগমেন্টেড রিয়্যালিটি
অগমেন্টেড রিয়্যালিটি বর্তমান সময়ের একটি জনপ্রিয় প্রযুক্তি ট্রেন্ড। ব্যবসায় এটির ব্যবহার আরও বেশি বাড়ছে। বিভিন্ন হার্ডওয়্যারের উন্নয়ন, বিশেষ করে মোবাইল ডিভাইসে অগমেন্টেড রিয়্যালিটি বা এআর গ্লাসের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় এ প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে। এআর এখন আরও বেশি বিস্তৃত ও ব্যবহারবান্ধব অভিজ্ঞতা দিতে পারে। এ প্রযুক্তি রিটেইল, আবাসন, শিক্ষা খাতের মতো বিভিন্ন খাতে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে পারে। বিশেষ করে বিভিন্ন পণ্য প্রদর্শন, শিক্ষা ও বিভিন্ন পরিবেশে যোগাযোগের ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে এআর। এ খাতের বিভিন্ন ব্যবহারোপযোগী সমাধান ব্যবহারকারীদের ডিজিটাল রূপান্তরের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখবে।
আইওটি
এখন বিভিন্ন ছোট ছোট যন্ত্রে ইন্টারনেট সংযোগ রয়েছে। ফলে এসব যন্ত্র হয়ে উঠছে স্মার্ট। এসব যন্ত্রের সাহায্যে বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা ও একে নির্দেশনা দেওয়া যাচ্ছে। এসব যন্ত্রের সহায়তায় গড়ে উঠছে স্মার্ট শহর। ইন্টারনেট অব থিংস বা আইওটি প্রযুক্তিতে বিভিন্ন সেন্সর এবং ডিভাইসের একীকরণ জড়িত। এগুলোর সাহায্যে বিভিন্ন পরিষেবা দক্ষতার সঙ্গে পরিচালিত হয়। এর মধ্যে রয়েছে যানজট কমাতে যানজট ও গণপরিবহন পর্যবেক্ষণ, শক্তির ব্যবহার সর্বোত্তম করার জন্য স্মার্ট গ্রিড ব্যবহার এবং জননিরাপত্তা এবং জরুরি পরিষেবার জন্য সংযুক্ত ব্যবস্থা বাস্তবায়ন। শহর যত উন্নত হচ্ছে, বাসিন্দাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করতে আইওটির ব্যবহার তত বাড়ছে।
কৃষিক্ষেত্রে জৈবপ্রযুক্তি
কৃষিক্ষেত্রে জৈবপ্রযুক্তির অগ্রগতি কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব ঘটাচ্ছে যা পোকামাকড় এবং রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধি, উন্নত পুষ্টিগুণ এবং উচ্চফলনসহ ফসল উৎপাদনকে আরও সম্ভবনাময় করে তুলছে। সিআরআইএসপিআর জিন সম্পাদনা প্রযুক্তির মতো নানা উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে, যা খরা ও লবণাক্ততার মতো পরিবেশগত চাপ সহ্য করতে সক্ষম। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে এবং খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে এ ধরনের জৈবপ্রযুক্তির ব্যবহার আরও বাড়বে।
স্বয়ংক্রিয় গাড়ি
এ সময়ের আরেকটি প্রযুক্তি ট্রেন্ড হচ্ছে স্বয়ংক্রিয় গাড়ি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, সেন্সর, মেশিন লার্নিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে দিকনির্ণয় ও চালকের সহায়তা ছাড়া এ ধরনের গাড়ি চলতে সক্ষম হয়ে উঠছে। অবশ্য সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয় নিখুঁত গাড়ি এখনো তৈরির কাজ চলছে। তবে স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তি সক্ষমতা ইতিমধ্যে বিভিন্ন গাড়িতে যুক্ত হয়েছে। গণপরিবহন ও বিভিন্ন মালবাহী যানবাহনে এ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহারে দুর্ঘটনা কমানো, যানজট ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশদূষণ ঠেকানোর মতো সুবিধা যুক্ত হতে পারে।
ব্লকচেইন
বিটকয়েনের মতো ভার্চুয়্যাল মুদ্রার জন্য শুরুতে ব্লকচেইন প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছিল। ব্লকচেইন হলো তথ্য সংরক্ষণ করার একটি নিরাপদ এবং উন্মুক্ত পদ্ধতি। এ পদ্ধতি অনুযায়ী, ডেটাগুলো বিভিন্ন ব্লকে একটির পর একটি চেইন আকারে সংরক্ষণ করা হয় এবং এতে তথ্যের মালিকানা সংরক্ষিত থাকে। এই প্রযুক্তি এখন ক্রিপ্টোকারেন্সির বাইরেও নানা ক্ষেত্রে ব্যবহার শুরু হয়েছে। স্বচ্ছতা প্রদান, নিরাপত্তা বৃদ্ধি এবং জালিয়াতি কমানোর ক্ষমতার জন্য বিভিন্ন শিল্প খাতে ব্লকচেইন ব্যবহার করা হচ্ছে। এর বাইরে সাপ্লাই চেইন বা পণ্যের উৎপত্তিস্থলে নজরদারি, ভোটিং সিস্টেম ও মেডিকেল রেকর্ড নিরাপদ রাখতেও এ ধরনের প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে।
এজ কম্পিউটিং
আরেকটি নতুন ট্রেন্ডিং প্রযুক্তি হচ্ছে এজ কম্পিউটিং। কেন্দ্রীয় ডেটা সেন্টারের ওপর নির্ভর করার পরিবর্তে ডেটা বা তথ্য উৎপাদন উৎসের কাছাকাছি ডেটা প্রক্রিয়াকরণের বিষয়টি এজ কম্পিউটিংয়ের অন্তর্ভুক্ত। এটি এমন অ্যাপ্লিকেশনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে ক্লাউড কম্পিউটিংয়ে যে দেরি হতে পারে, তা ছাড়াই রিয়েল টাইমে তথ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়োজন হয়। স্বয়ংক্রিয় গাড়ি, শিল্প খাতের আইওটি, স্থানীয় তথ্য প্রক্রিয়াকরণের মতো ক্ষেত্রে এজ কম্পিউটিংয়ের ব্যবহার বাড়ছে।
তথ্যসূত্র : এএফপি, রয়টার্স ও সিম্পলিলার্ন