'ফুপু-ভাতিজা'র দোস্তিতে ভয়ে বিজেপি
প্রায় আড়াই দশকের শত্রুতা ভুলে উত্তর প্রদেশের রাজনীতির ‘বুয়া-ভাতিজা’ জুটি যেদিন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘ঘুম হারাম’ করার কথা জানালেন, তার ঠিক একদিন আগে দিল্লির রামলীলা ময়দানে সারা দেশের দলীয় নেতাদের সমাবেশে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ আগামী লোকসভার ভোটকে পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধর সঙ্গে তুলনা করলেন। ভনিতা না করে জানালেন, ওই যুদ্ধে আফগানরাজ আহমেদ শাহ আবদালির হাতে মারাঠাদের হার দেশকে দু শ বছরের ‘গোলামির’ পথে ঠেলে দিয়েছিল। দলীয় নেতাদের সতর্ক করে অমিত শাহ বলেছিলেন, ‘মারাঠারা এর আগে ১৩১টা যুদ্ধে কখনো হারেনি। অথচ আসল লড়াইটাই তারা হেরে বসল! দেশও চলে গেল রসাতলে!’
রাজনীতির অলিন্দে তো বটেই, বিজেপিতেও প্রশ্ন উঠল, দীর্ঘ দিনের শত্রুতা ভুলে মায়াবতী-অখিলেশের বন্ধুতার সরণী ধরে হাঁটার সিদ্ধান্ত কি তা হলে দলীয় সভাপতিকে নার্ভাস করে দিল?
কী আশ্চর্য, ঠিক তার পরের দিন, যেদিন ‘বুয়া’ মায়াবতীর বহুজন সমাজ পার্টি (বিএসপি) ও ‘ভাতিজা’ অখিলেশের সমাজবাদী পার্টি (এসপি) নিজেদের মধ্যে রাজ্যের ৭৬টা আসন (৮০র মধ্যে) সমানভাবে ভাগ করে নিলেন, সেদিন ওই রামলীলা ময়দানে নরেন্দ্র মোদি কবুল করলেন, চেষ্টার ত্রুটি তিনি রাখেননি। কিন্তু সব কাজ সেরে ফেলতেও পারেননি। পারেননি বলেই দেশের আরো একবার তাঁকে দরকার।
ফের প্রশ্ন, এমন চুপসে পড়া মোদি গত পৌনে পাঁচ বছরে দেখা গেছে কি না। তা হলে তিনিও কি আক্রমণ ছেড়ে প্রতিরক্ষার বর্ম চাপাতে চলেছেন? বিপদকে সাক্ষাৎ করে পরিচিত ঔদ্ধত্য ঝেড়ে বিনয় ও বিনম্রতায় নিজেকে মুড়ে নতুন অবতারে পরিচিত হতে চলেছেন? এতটাই মোক্ষম ‘বুয়া-ভাতিজা’ জুটি?
পাঁচ বছর আগে দেশবাসীকে নতুন স্বপ্ন দেখিয়ে মোদি যখন একার শক্তিতে দেশের ক্ষমতায় আসেন, সেই ২০১৪ সালে উত্তর প্রদেশের ৮০টির মধ্যে বিজেপি পেয়েছিল ৭১, তার সহযোগী আপনা দল ২টি আসন। বাকি ৭ আসনের মধ্যে ৫টা (এসপি), অন্য দুটো রাহুল ও সোনিয়া গান্ধী। বিএসপির ঝুলি ছিল শূণ্য। ‘মোদি ম্যাজিক’ অস্বীকার না করেও বলা যেতে পারে, বিজেপির এই বিপুল জয়ের নেপথ্যের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল এসপি-বিএসপির আলাদা লড়াই। বিরোধী ভোট ভাগাভাগির পাশাপাশি রাজ্যের জাতভিত্তিক ছোট ছোট দলকে সঙ্গে নিয়ে বিজেপির ‘স্যোশাল ইঞ্জিনিয়ারিং’ শাসক দলের পক্ষে কিস্তি মাত করেছিল। ‘বুয়া-ভাতিজা’ অতীত ভুলে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার তাড়নায় এবার এককাট্টা। এই ‘দোস্তি’ই ভয় দেখাচ্ছে বিজেপিকে।
ভয় পাওয়ার কারণও আছে। ২০১৭ সালে রাজ্য বিধানসভার ভোট হয়। ২০১৪ সালের মতো সেই ভোটেও আলাদা লড়েছিল এসপি-বিএসপি। এই ভাগাভাগি বিজেপিকে রাজ্য দখলের পথও মসৃণ করে দিয়েছিল। পরিসংখ্যান দেখাচ্ছে, ৪০৩ আসনের বিধানসভায় ৪১ দশমিক ৩৫ শতাংশ ভোট পেয়ে সঙ্গীদের নিয়ে বিজেপি দখল করে ৩২৫ আসন, ২৮ দশমিক ০৭ শতাংশ ভোট পেয়ে এসপি পায় ৫৪টি এবং ২২ দশমিক ২৩ শতাংশ ভোট পেয়ে বিএসপির জোটে ১৯টি আসন। পাটিগণিতের সহজ উত্তর, এসপি-বিএসপি ভোট এক জোট হলে তাদের মোট ভোট দাঁড়াত ৫০ দশমিক ৫ শতাংশ, বিজেপির তুলনায় যা প্রায় ৯ শতাংশ বেশি। মনে রাখতে হবে, ২০১৭ সালে মোদি-ক্যারিশমা কিন্তু বিন্দুমাত্র ফিকে হয়নি। সেই পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৭ সালে এসপি-বিএসপি জোট ৮০-র মধ্যে ৫৭টি আসন জিততে পারত। বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ পেত মাত্র ২৩টি।
এবার ‘বুয়া-ভাতিজা’ যে চার আসন খালি রেখেছেন তার দুটিতে দুই দলই কোনোদিন সেই অর্থে লড়াই করেনি। অমেঠি থেকে রাহুল ও রায়বেরিলি থেকে সোনিয়া গান্ধীর জয় সহজ করে তোলাই ছিল তাঁদের বাসনা। অন্য দুটি আসন তাঁরা খালি রেখেছেন যাতে পশ্চিম উত্তর প্রদেশের জাঠ নেতা অজিত সিংয়ের রাষ্ট্রীয় লোক দল (আরএলডি) জোটের শরিক হন। মাত্র দুটি করে আসন ছাড়ার সিদ্ধান্ত রাহুল-সোনিয়া এবং অজিত সিংদের সন্তুষ্ট করবে কি না সন্দেহ, কিন্তু এটাও ঠিক দুই দলের কেউই ‘বুয়া-ভাতিজা’র এই একতরফা সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেনি। উল্টে রাহুল প্রভূত প্রশংসা করেছেন মায়াবতী-অখিলেশের।
ভোটের বাকি এখনো অনেক দিন। এই দুই মাসে রাজনীতির রং যে বদলাবে না কে বলতে পারে? রাজ্যে বিজেপির দুই শরিক আপনা দল ও সুহেলদেব ভারতীয় সমাজ পার্টি এবার বেশি আসনের দাবিতে অনড়। পৌনে পাঁচ বছর ধরে ‘অবহেলার’ অভিযোগও এই দুই দলের নেতারা বড় করে তুলে ধরেছেন। কে বলতে পারে, অস্তিত্ব রক্ষায় এই দুই শরিক ভোটের আগে জোট ছাড়বে না? এনডিএ ছাড়লে পাঁচ বছর আগের ‘স্যোশাল ইঞ্জিনিয়ারিং’ও চৌপাট হয়ে যাবে। কংগ্রেসও যদি জেদাজেদিতে না গিয়ে বাস্তবতাকে মেনে নেয়? বিজেপির চিন্তা সেটাও।
কর্নাটক থেকেই রাহুল দলের কৌশল পাল্টে ফেলেছেন। দলের একাংশের মতে, অমেঠি ও রায়বেরিলি মেনে নিয়ে দলের উচিত হবে অন্য সব কেন্দ্রে প্রার্থী দাঁড় করানো। কারণ, কংগ্রেস এই পড়তি সময়েও যেটুকু ভোট (৭ শতাংশেরও কম) পায়, তার প্রায় পুরোটাই বর্ণহিন্দুদের। প্রার্থী না দিলে এই ভোট বিজেপিতে চলে যাবে। রাহুল তা চাইবেন না।
‘বুয়া-ভাতিজা’ শুধু জোটের ঘোষণাতেই থেমে নেই, রাজ্যে অন্তত ২০টা যৌথ জনসভা করার ছক তাঁরা কষে ফেলেছেন। মনে রাখা দরকার, গত বছর যে তিন আসনের উপনির্বাচনে এই দুই দল হাত মিলিয়েছিল, প্রতিটিতেই তারা জিতেছে। এবং কোথাও এই দুই নেতা-নেত্রী এক সঙ্গে প্রচারে যাননি। এবার সেই ব্যতিক্রম ঘটতে চলেছে।
বিজেপির বলিরেখা গাঢ় হওয়ার কারণ অবশ্যই আছে। ‘পানিপথের তৃতীয় যুদ্ধ’ ও ‘সবকিছু দিতে না পারার’ স্বীকারোক্তির মধ্য দিয়ে দুই শীর্ষ নেতার দুশ্চিন্তাই প্রকট হয়েছে।