ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কৃষকদের দাবি মেনে নিয়েছেন। তাঁদের জীবিকাকে হুমকির মুখে ফেলা বিতর্কিত কৃষি আইন বাতিল করেছেন তিনি। মোদির এ সিদ্ধান্ত বদলের কারণে উত্তর প্রদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিজেপির নিয়ন্ত্রণে আসেনি। মোদির সিদ্ধান্ত নিয়ে কৃষকদের প্রতিক্রিয়া খুব বেশি ইতিবাচক নয়। উত্তর প্রদেশে ধর্মীয় বিভাজনের যে ফায়দা বিজেপি এর আগে ঘরে তুলেছিল, তা এবার তোলা কঠিন হবে বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে।
এদিকে কৃষি আইন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর কৃষক আন্দোলনের ভবিষ্যৎ নির্ধারণে সংযুক্ত কিষান মোর্চা রোববার বৈঠকে বসছে। দিল্লির সিংঘু সীমান্তে সেই বৈঠক শুরু হবে বেলা ১১টায়। এর আগে বিভিন্ন কৃষক সংগঠনের নেতারা আজ শনিবার সিংঘু, টিকরি ও গাজিপুর সীমান্তে দিনভর নিজেদের মধ্যে নিজস্ব সংগঠনের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনায় বসেন। রোববারের বৈঠকে এসব প্রস্তাব বিবেচনার পর মোর্চার ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারিত ও ঘোষিত হবে।
শনিবার কৃষকদের বিভিন্ন সংগঠনের নেতারা ঘরোয়াভাবে যে আলোচনা করেন, তাতে কয়েকটি বিষয় প্রাধান্য পায়। যেমন কৃষকদের ঘরে ফিরে যাওয়ার যে আবেদন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি করেছেন, তাকে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হবে। সেই আহ্বানে সাড়া দেওয়ার আগে কৃষক আন্দোলনে নিহতদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য সরকারকে চাপ দেওয়া হবে কি না। ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) বেঁধে দিতে আইন করার দাবিতে অনড় থাকা হবে কি না। অথবা এসব দাবি সীমান্ত অবরোধ তুলে নেওয়ার শর্ত হিসেবে রাখা হবে কি না।
এত দিন ধরে আন্দোলন সম্মিলিতভাবে চলে আসছে। ব্যক্তিগত বা সাংগঠনিক অভিপ্রায় যা–ই থাকুক, পরবর্তী সিদ্ধান্তও গৃহীত হবে সম্মিলিতভাবে।
উত্তর প্রদেশের কৃষকনেতা রাকেশ টিকায়েত বলেন, আইন খারিজের কথা প্রধানমন্ত্রী মুখে বলেছেন। তা কাজে পরিণত না হলে সীমান্ত ছেড়ে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এই দাবি মোর্চারও দাবি হয়ে উঠবে কি না, সে বিষয়েও বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
মোর্চার নেতা হান্নান মোল্লা আজ সন্ধ্যায় প্রথম আলোকে বলেন, এটা ঠিক যে সরকারের মুখের কথায় কৃষকদের ভরসা নেই বললেই চলে। আস্থার ঘাটতি প্রবলভাবে বেড়ে গেছে। সেই কারণে এমন ধরনের নানা সংশয় জাগছে। এত দিন ধরে আন্দোলন সম্মিলিতভাবে চলে আসছে। ব্যক্তিগত বা সাংগঠনিক অভিপ্রায় যা–ই থাকুক, পরবর্তী সিদ্ধান্তও গৃহীত হবে সম্মিলিতভাবে। সেই বৈঠক বসবে রোববার। এর আগে আজ দিনভর বিভিন্ন সংগঠন নিজেদের প্রস্তাব নিয়ে বিভিন্ন সীমান্ত ঘাঁটিতে আলোচনা করেছে।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, রাজধানী নয়াদিল্লি থেকে ৫০০ কিলোমিটার দূরে জনবহুল উত্তর প্রদেশের মোহরানিয়া গ্রামের কৃষক গুরু সেবক সিং বলেন, তিনি ও তাঁর মতো অন্যরা মোদি ও ও তাঁর দলের প্রতি আস্থা হারিয়েছেন।
সেবক সিংয়ের ভাষ্য, আজ প্রধানমন্ত্রী মোদি তাঁর ভুল প্রতিশ্রুতির বিষয়টি বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু এ ভুল বুঝতে তাঁর এক বছরের বেশি সময় লাগল। তিনি এখন জানেন যে কৃষকেরা তাঁর দলকে আর ভোট দেবেন না।
কৃষকদের প্রতি সরকার যে আচরণ করেছে, তার মূল্য দিতে হবে।
উত্তর প্রদেশের যুবা কৃষকদের জন্য বিষয়টি আরও বেশি ব্যক্তিগত পর্যায়ের। সেবক সিংয়ের ১৯ বছর বয়সী ভাই গুরুবিন্দর সিং গত অক্টোবরে নিহত হয়েছেন। বিতর্কিত এই কৃষি আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভকারী কৃষকদের ওপর গাড়ি তুলে দেওয়ার ঘটনায় যে আটজন নিহত হয়েছিলেন, তাঁদের একজন ছিলেন গুরুবিন্দর।
হাজার হাজার কৃষক রাজধানী নয়াদিল্লির উপকণ্ঠে এক বছরের বেশি সময় ধরে কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ করে আসছেন। বিজেপি সরকার কৃষি খাতকে আধুনিকায়ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে এ আইন প্রণয়ন করলেও কৃষকদের বিক্ষোভে মোদি ও বিজেপি সরকারের ওপর চাপ বাড়ছিল।
গুরু সেবক সিং আরও বলেন, ‘আজ আমি বলতে পারি আমার ভাই শহীদ হয়েছেন। আমার ভাই সেই সাহসী, ‘কৃষকদের মধ্যে যাঁরা আত্মত্যাগ করেছেন। তাঁরা জীবন দিয়ে প্রমাণ করেছেন সরকার কৃষি অর্থনীতিকে ধ্বংস করতে এ আইন প্রণয়ন করেছে।’
এদিকে কৃষি আইন বাতিলে আজ শনিবার প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস ‘কিষান বিজয় দিবস’ পালন করেছে। এ উপলক্ষে দেশের বিভিন্ন স্থানে কংগ্রেসের কর্মীরা বিজয় মিছিল করেছেন।
লাঠি ও রড দিয়ে কৃষকদের মারা হয়েছে। বৈধ অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করায় তাঁদের আটক করা হয়েছে। এক মন্ত্রীর পরিবারের সদস্য দ্রুতগতির গাড়ি কৃষকদের ওপর তুলে দিয়েছে। আমরা কীভাবে তা ভুলে যাব?
দেড় বছর আগে কোভিড পরিস্থিতির সময় তিন কৃষি আইন প্রণয়নে কেন্দ্র অধ্যাদেশ জারি করেছিল। তারপর গত বছরের সেপ্টেম্বরে সংসদের খণ্ডকালীন অধিবেশনে প্রায় বিনা আলোচনায় বিরোধীদের দাবি উপেক্ষা করে তিন আইন পাস করা হয়। বিক্ষুব্ধ কৃষকেরা রাজপথে নেমে বিক্ষোভ শুরু করেন। তাঁরা অভিযোগ করেন, এ আইন সংস্কার করা হলে তাঁদের চাকরি ঝুঁকির মুখে পড়ে যাবে। এ ছাড়া ফসল ও দামের নিয়ন্ত্রণ চলে যাবে বেসরকারি ফড়িয়াদের হাতে। কৃষকদের এ প্রতিবাদ দেশটির সবচেয়ে বড় ও দীর্ঘস্থায়ী আন্দোলন হয়ে ওঠে।
উত্তর প্রদেশ ও পাঞ্জাব রাজ্যে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ছয়টি কৃষক ইউনিয়নের নেতারা বলছেন, প্রতিবাদী কৃষকদের সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা ও দেশবিরোধী আখ্যা দেওয়া সরকারকে তাঁরা ক্ষমা করবেন না।
উত্তর প্রদেশের কৃষক ইউনিয়নের সদস্য সুধাকর রায় বলেন, ‘লাঠি ও রড দিয়ে কৃষকদের মারা হয়েছে। বৈধ অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করায় তাঁদের আটক করা হয়েছে। এক মন্ত্রীর পরিবারের সদস্য দ্রুতগতির গাড়ি কৃষকদের ওপর তুলে দিয়েছে। আমরা কীভাবে তা ভুলে যাব?’
সুধাকর রায় দাবি করেন, বিতর্কিত আইন নিয়ে প্রতিবাদের সময় ১৭০ জনের বেশি কৃষককে হত্যা করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির এক সদস্য বলেছেন, আইন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তটি শীর্ষ এক কৃষক সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করার পর নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। বিজেপি আইনের সুবিধাগুলো যথাযথভাবে তাদের বোঝাতে পারেনি বলে আলোচনার সময় তুলে ধরা হয়েছিল।
তবে বিরোধী দলের নেতারা ও কয়েকজন বিশ্লেষক মনে করছেন, উত্তর প্রদেশের আগামী বছরের নির্বাচন লক্ষ্য করে বিজেপি এ পদক্ষেপ নিয়েছে।
কংগ্রেস নেতা পি চিদাম্বরম টুইট করে বলেছেন, গণতান্ত্রিক প্রতিবাদ করে যা অর্জন করা যায় না, নির্বাচনের ভয়ে তা অর্জন করা গেল।
তবে সেবক সিং সতর্ক করে বলেন, কৃষকদের প্রতি সরকার যে আচরণ করেছে, তার মূল্য দিতে হবে।
মোদিকে প্রিয়াঙ্কার চিঠি
কংগ্রেস নেত্রী প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্র গতকাল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে এক চিঠিতে জানিয়েছেন, লখিমপুর খেরিতে গাড়িচাপা দিয়ে কৃষক হত্যার অভিযোগ যাঁর বিরুদ্ধে, সেই কেন্দ্রীয় প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী একই মঞ্চে বসলে তা নিহত কৃষক পরিবারদের অসম্মান ও অপমান করার শামিল হবে। এই কাজ তিনি যেন না করেন।
উত্তর প্রদেশ সফরের সময় লক্ষ্ণৌয়ে এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ও প্রতিমন্ত্রী অজয় মিশ্রর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীরও থাকার কথা। গতকাল লক্ষ্ণৌয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সেই চিঠি পড়ে প্রিয়াঙ্কা বলেন, ‘লখিমপুর খেরির ঘটনার প্রধান অভিযুক্ত আশিসের বাবা মন্ত্রী অজয় মিশ্র। এখনো তিনি আপনার মন্ত্রিপরিষদের সদস্য। ঘটনার পর থেকেই রাজ্য সরকার ন্যায়বিচারের কণ্ঠরোধের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টও এ নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছেন। আমি নিহতদের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছি। অজয় মিশ্র মন্ত্রী থাকলে তাঁরা ন্যায়বিচার পাবেন বলে মনে করেন না। দেশের মানুষকে ন্যায়বিচার দেওয়ার দায়িত্ব আপনারই।’ প্রিয়াঙ্কার দাবি, অবিলম্বে অজয় মিশ্রকে মন্ত্রিসভা থেকে বরখাস্ত করা হোক।
মোদিকে বরুণ গান্ধীর চিঠি
বিতর্কিত তিন কৃষি আইন প্রত্যাহারের পরদিনই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি লিখে বিজেপির সাংসদ বরুণ গান্ধী চার দফা দাবি জানালেন। সেই সঙ্গে তিনি বলেছেন, এই সিদ্ধান্ত আগে নিলে ৭০০-এর বেশি কৃষককে মৃত্যুবরণ করতে হতো না। এসব কৃষক পরিবারের প্রত্যেককে এক কোটি রুপি ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন উত্তর প্রদেশের পিলিভিটের এই সাংসদ।
গত শুক্রবার সকালে প্রধানমন্ত্রী মোদি জাতির উদ্দেশে দেওয়া আকস্মিক ভাষণে তিন বিতর্কিত কৃষি আইন প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। আজ শনিবার প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লেখেন বরুণ। কিছুদিন ধরেই কৃষক আন্দোলনসহ বিভিন্ন বিষয়ে বরুণ নিজস্ব অভিমত প্রকাশ করে আসছেন। তাঁর মতামত অনেক সময় বিজেপির দলীয় নীতির বিরুদ্ধেও যাচ্ছিল। উত্তর প্রদেশের লখিমপুর খেরিতে তীব্র বেগে গাড়ি চালিয়ে আন্দোলনরত চার কৃষককে হত্যার পর বরুণ কড়া ভাষায় প্রতিবাদও জানিয়েছিলেন। এরপরই তাঁকে বিজেপির কর্মসমিতি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও বরুণ প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখে অবিলম্বে চার দফা দাবি পূরণের কথা বলেন।
কেন আরও আগে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো না, সেই বিস্ময় প্রকাশ করে বরুণ চিঠিতে লিখেছেন, আগে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে ৭০০-র বেশি কৃষককে মৃত্যুবরণ করতে হতো না। চার দফা দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, দীর্ঘ এক বছরের এই আন্দোলনকালে নিহতদের পরিবারের প্রত্যেককে এক কোটি রুপি ক্ষতিপূরণ দেওয়া হোক। পাশাপাশি কৃষকদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক কারণে যেসব ভুয়া মামলা দায়ের করা হয়েছে, তা তুলে নেওয়া হোক। তাঁর আরও দাবি, কৃষকেরা ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইনি স্বীকৃতির যে দাবি তুলেছেন, তা ন্যায্য। সেই দাবি মেনে সরকারের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত।