রাশিয়ার এস-৪০০ কেনায় কি মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় পড়বে ভারত
আগামী মাসের প্রথমেই ভারত সফরে আসছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। একই সময় ভারতে পৌঁছে যাচ্ছে রাশিয়ার অত্যাধুনিক আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা এস-৪০০। সীমান্ত নিয়ে চীনের সঙ্গে বিদ্যমান সংকটের মধ্যে এস-৪০০ হাতে পাওয়া ভারতকে অনেকটা স্বস্তি এনে দেবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। সেনাসদস্যরা মনে করছেন, বাজারে প্রচলিত আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাগুলোর মধ্যে এগিয়ে রয়েছে এস-৪০০। তবে এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে, রাশিয়া থেকে অস্ত্র কেনায় ভারত কি মার্কিন নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে যাচ্ছে?
ভারতের সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দুর বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ২০১৮ সালে একটি আইন পাস করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ‘কাউন্টারিং আমেরিকান অ্যাডভার্সারিস থ্রু স্যাংশন’ (সিএএটিএসএ) নামের ওই আইনে বলা হয়েছে, রাশিয়া, ইরান অথবা উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে প্রতিরক্ষা বা গোয়েন্দাসংক্রান্ত চুক্তি করলে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসবে। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগতে পারে, নিষেধাজ্ঞা কেমন হতে পারে?
ভারতের ওপর যেসব নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র
যুক্তরাষ্ট্রের সিএএটিএসএ আইনের ২৩১ ও ২৩৫ ধারা অনুযায়ী, রাশিয়া, ইরান অথবা উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে প্রতিরক্ষা বা গোয়েন্দা চুক্তিতে গেলে কমবেশি ১২টি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যাবে। তবে কমপক্ষে ৫টি নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সেগুলোর মধ্যে রয়েছে—
* চুক্তিতে যাওয়া দেশে যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সহায়তা বন্ধ হবে। পাশাপাশি সহায়তা বন্ধে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠাগুলোকে চাপ দেওয়া হবে।
* যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানায় থাকা পণ্য ও প্রযুক্তি বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হবে। সিএএটিএসএ আইনের আওতায় তুরস্কের কাছে মার্কিন এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান বিক্রির চুক্তি বাতিল করে যুক্তরাষ্ট্র। তুরস্কও রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ কিনেছিল।
* রাশিয়া, ইরান অথবা উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে চুক্তি করা দেশের ব্যাংক, উৎপাদনকারী ও সরবরাহকারীদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসবে। নিষিদ্ধ হবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পত্তির লেনদেন।
* চুক্তির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর আর্থিক ও ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হবে।
ভারতের অবস্থান এ ক্ষেত্রে কী
মার্কিন নিষেধাজ্ঞার হুমকির মুখে এর আগে নানা উদ্যোগ থেকে পিছু হটতে হয়েছে ভারতকে। ২০১৯ সালে এ কারণেই ইরান ও ভেনেজুয়েলার সঙ্গে জ্বালানি তেলের সরবরাহ বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় দেশটি। তবে এস-৪০০ ইস্যুতে বেশ শক্ত অবস্থানে নরেন্দ্র মোদির সরকার।
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার শঙ্কার মুখে পড়েও এস-৪০০ নিয়ে সামনে এগিয়েছে ভারত। রাশিয়ার কাছ থেকে আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাটির ৫টি ইউনিট কিনতে মোট ৫৪৩ কোটি মার্কিন ডলারের চুক্তি করেছে দেশটি। কিছু অর্থও পরিশোধ করা হয়েছে। এর জের ধরে আগামী মাসেই এস-৪০০-এর প্রথম চালান ভারতে আসার কথা রয়েছে।
এ নিয়ে ভারতের কয়েকজন কূটনীতিক বলেছিলেন, এস-৪০০ ভারতের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার বিষয়। কোনোভাবেই এ চুক্তি বাতিল করা যাবে না। এদিকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলছে, মার্কিন নিষেধাজ্ঞার বিষয়টি মাথায় রাখছে ভারত। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের সঙ্গে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে।
দ্য হিন্দুর খবরে বলা হয়েছে, ভারতের সঙ্গে রাশিয়ার প্রতিরক্ষাবিষয়ক অংশীদারত্ব বেশ পুরোনো। দেশটির হাতে থাকা সামরিক সরঞ্জামের ৭০ শতাংশই রাশিয়ার কাছ থেকে কেনা। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অস্ত্র কেনার পরিমাণ এরই মধ্যে বাড়িয়েছে ভারত; এর পরও এ মুহূর্তে রাশিয়াকে এড়িয়ে চলা বেশ কঠিন হবে দেশটির জন্য। ভারতের সেনাবাহিনীও মনে করছে, বাজারে প্রচলিত আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থাগুলোর মধ্যে এগিয়ে রয়েছে এস-৪০০।
যুক্তরাষ্ট্রের সামনে যে পথ খোলা
দ্য হিন্দুর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, এস-৪০০ ইস্যুতে ভারতকে সামনে রেখে নানাভাবে এগোতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। প্রথমেই আসে সিএএটিএসএ আইন অনুযায়ী নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা।
তবে বিশ্বরাজনীতিতে এই অঞ্চলে এ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের বড় অংশীদার ভারত। দুই দেশই আবার চতুর্দেশীয় গোষ্ঠী ‘কোয়াড’-এর সদস্য। ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীনের আগ্রাসন সামলাতেই মূলত গঠন করা হয়েছে কোয়াড। এ বিষয়গুলো মাথায় রেখে নিষেধাজ্ঞা ছয় মাস পিছিয়ে দিতে পারেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এ সময়ের মধ্যে ‘মার্কিনদের জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থ’ বিবেচনায় ভারতের ওপর নিষেধাজ্ঞায় ছাড়ের বিষয়ে সিদ্ধান্ত আসতে পারে বাইডেন প্রশাসন থেকে।
এদিকে সিএএটিএসএ আইন সংশোধনের প্রস্তাব এনেছেন তিনজন মার্কিন সিনেটর। সংশোধনীর এ প্রস্তাব পাস হলে কোয়াডের সদস্যরা মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় ছাড় পাবে। সিএএটিএসএ আইন সংশোধন করা হলে কোয়াড সদস্য হিসেবে এর সুফল পেতে পারে ভারত।
সবশেষ পদক্ষেপ হিসেবে সিএএটিএসএ আইনটিই বাতিল করতে পারে মার্কিন সরকার। এ ক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ইরানের কথা। পারমাণবিক অস্ত্র ইস্যু দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞা এনেছিল যুক্তরাষ্ট্র। পরে তা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়; যদিও বছর দশেকের ব্যবধানে তা আবার বহাল করে যুক্তরাষ্ট্র। তবে বর্তমান সময়ে এসে সিএএটিএসএ আইন বাতিলের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা।
সবকিছু মাথায় রেখে নিষেধাজ্ঞা ছয় মাস পেছানোর পদক্ষেপটিই যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচেয়ে সহজ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁরা বলছেন, এ সময়ের মধ্যে নিষেধাজ্ঞা ছাড়সহ বিকল্প পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে মার্কিন সরকার।
নিষেধাজ্ঞা ছাড়ে যেসব চাপে পড়তে পারে যুক্তরাষ্ট্র
দ্য হিন্দুর বিশ্লেষণ অনুযায়ী, শুধু ভারতের ওপর নিষেধাজ্ঞায় ছাড় দিলে যুক্তরাষ্ট্রের সিএএটিএসএ আইন দুর্বল হয়ে পড়বে। চাপ আসবে তুরস্কের দিক দিয়েও। কারণ, পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য এ দেশ এস-৪০০ কিনে মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় রয়েছে।
ভারতকে নিষেধাজ্ঞায় ছাড় দিলে অন্য দেশগুলো রাশিয়ার সঙ্গে অস্ত্র চুক্তিতে আগ্রহী হয়ে উঠতে পারে—এ বিষয়ও মাথায় রাখতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে। নিষেধাজ্ঞায় ছাড়ের আশায় রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তিতে যেতে পারে মার্কিন মিত্র সৌদি আরবও। এস-৪০০ কিনতে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছিল সৌদি সরকার। এর পরই দেশটিকে মার্কিন আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ‘টিএইচএএডি’ কিনতে প্রস্তাব দেয় যুক্তরাষ্ট্র।
হিন্দুর প্রতিবেদন বলছে, সব হিসাব–নিকাশ শেষে ভারতের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি হলে তা যুক্তরাষ্ট্রের জন্যই বিপদ ডেকে আনবে। কারণ, এর জের ধরে রাশিয়ার সঙ্গে শক্ত সামরিক সম্পর্কের দিকে এগোতে পারে ভারত। এর পরিপ্রেক্ষিতে চীনকে টেক্কা দিতে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগও গতি হারাতে পারে।