মোদির বিজেপিকে নারীরা কেন ভোট দেন
একটা কথা খুব প্রচলিত আছে—প্রত্যেক সফল পুরুষের পেছনে একজন নারীর অবদান রয়েছে।
তবে সম্প্রতি ভারতের একাধিক রাজ্যে অনুষ্ঠিত গুরুত্বপূর্ণ বিধানসভা নির্বাচনে দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সাফল্যের পেছনে লাখো নারীর অবদান রয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
গত ফেব্রুয়ারি-মার্চ মাসে ভারতের পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন হয়। পাঁচটির মধ্যে চারটি রাজ্যেই বিজেপি জয় পায়। সাম্প্রতিক দুটি জরিপে দেখা গেছে, এই চার রাজ্যে বিজেপি পুরুষদের চেয়ে নারী ভোটারদের ভোট বেশি পেয়েছে। চার রাজ্যের মধ্যে উত্তর প্রদেশও রয়েছে, যার জনসংখ্যা ব্রাজিলের চেয়ে বেশি।
এখন ভারতের নারীরা কেন মোদির দল বিজেপিকে ভোট দিতে বেশি পছন্দ করছেন, তার কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছেন বিবিসির গীতা পাণ্ডে।
১৯৬২ সাল থেকে লিঙ্গভেদে ভোটার উপস্থিতি নির্ণয় করে আসছে ভারতের নির্বাচন কমিশন। তখন থেকে শুরু করে একটা বিশেষ প্রবণতা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত লক্ষ করা যায়। আর তা হলো জাতীয় নির্বাচনে নারী ভোটাররা কংগ্রেসকে বেশি ভোট দিচ্ছেন।
তবে ২০১৯ সালে ভিন্ন চিত্র দেখা যায়। সে বছরই প্রথম বিজেপি নারীদের ভোট সবচেয়ে বেশি পায়। যদিও এখন ভারতের বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের মতো বিজেপিতেও নারীর প্রতিনিধিত্ব কম। এমনকি নারীবিদ্বেষী বক্তব্য দেওয়ার কারণে প্রায়ই বিজেপির নেতাদের খবরের শিরোনাম হতে দেখা যায়।
তা ছাড়া বিজেপিশাসিত কিছু রাজ্যে ধর্ষণের ঘটনা সামাল দিতে ব্যর্থ হওয়ার জন্যও দলটিকে দেশ-বিদেশে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে হয়েছে।
মোদি সরকারের বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে দেশটিতে দীর্ঘ সময় ধরে চলা তুমুল বিক্ষোভে নারীদের নেতৃত্ব দিতে দেখা যায়। এত কিছুর পরও ভারতে আগের চেয়ে বেশিসংখ্যক নারী এখন বিজেপিকে ভোট দিচ্ছেন। অন্তত পরিসংখ্যান সে কথাই বলছে।
বিজেপি কীভাবে নারীদের পছন্দের দল হয়ে উঠল
দিল্লিভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অব ডেভেলপিং সোসাইটিজের (সিএসডিএস) গবেষক সঞ্জয় কুমার মনে করেন, বিজেপি ভারতীয় নারীদের পছন্দের দল হয়ে ওঠার মূলে রয়েছেন মোদি।
সঞ্জয় কুমার বলেন, নারী ভোটারদের কাছে বিজেপির আকর্ষণ হুট করে তৈরি হয়নি। এখানে মোদি অবশ্যই একটি প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি বড় প্রভাবক হিসেবেই কাজ করেছেন।
নিজের সাম্প্রতিক বই ‘দ্য নিউ বিজেপি’ লিখতে গিয়ে এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করেছেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও লেখক নলিন মেহতা। তাঁর গবেষণা অনুযায়ী, বিজেপি ১৯৮০ সালে দলের নারী শাখা গড়ে তোলে। তারপর দলটি নারীদের কাছে পৌঁছানোর তৎপরতা শুরু করে।
মেহতা বলেন, বিজেপিতে তখন কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী নারী নেত্রী ছিলেন। দলটি বিশেষ করে নারী ইস্যুতে উল্লেখযোগ্য অঙ্গীকার করে। তবে তারপরও কয়েক দশক ধরে অনেক নারী ভোটার বিজেপিকে ভোট দেননি। বিজেপিকে ব্যাপকভাবে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার নেতা প্রাধান্যশীল দল হিসেবে দেখা হতো। ফলে, নারীদের কাছে দলটির খুব কমই আকর্ষণ ছিল।
নারী ভোটারদের সমর্থন পাওয়ার ক্ষেত্রে জাতীয় পর্যায়ে বড় ধরনের পরিবর্তন ২০১৯ সালে দেখতে পায় বিজেপি। এ সম্পর্কে বলতে গিয়ে ২০০৭ সালে ফিরে যান মেহতা। ২০০৭ সালে মোদি ভারতের পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্য গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী পদে পুনর্নির্বাচন করেছিলেন। সে সময়ে মোদি ব্যাপকভাবে নারী ভোটারদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছিলেন বলে মনে করেন মেহতা।
নির্বাচনী সমাবেশগুলোয় মোদি প্রায়ই তাঁর ৫৬ ইঞ্চি চওড়া বুকের ছাতি নিয়ে কথা বলতেন। ভারতের হিন্দিভাষী রাজ্যগুলোয় শক্তিশালী পুরুষেরা তাঁদের শক্তিমত্তা প্রকাশে এ ধরনের শব্দ ব্যবহার করে থাকেন। মোদি রাজনীতিতে এ শব্দের ব্যবহার করেন।
মেহতা বলেন, যতবার মোদি এ কথা বলতেন, ততবার দর্শক-শ্রোতাদের মধ্য থেকে শ্রবণযোগ্য আওয়াজ শোনা যেত। বিশেষ করে যে সারিতে নারী ভোটাররা বসতেন, সেখান থেকে এই শব্দ আসত। তাঁর সমাবেশে প্রায়ই পুরুষের চেয়ে নারীদের উপস্থিতি বেশি থাকত। তিনি নারীদের উদ্দেশে বলতেন, ‘আমি আপনাদের ভাই, আপনাদের ছেলে। আমাকে ভোট দিন। আমি আপনাদের চাওয়া-পাওয়ার দিকটি দেখব।’
মোদির কৌশল
পুরুষালির সীমাবদ্ধতা আছে। এ বিষয়কে আমলে নেন মোদি। তিনি ‘আলফা’ পুরুষের ভাবমূর্তির সঙ্গে নারীকেন্দ্রিক প্রচার-প্রচারণার পাশাপাশি উন্নয়ন কৌশল নেন। তাঁর এই কৌশল কাজে দেয়। তিনি ২০০৭ সালের পর ২০১২ সালেও গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী নির্বাচিত হন।
২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে মোদির দল বিজেপি বিপুল বিজয় অর্জন করে। তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। এ সময় মোদি তাঁর কৌশলকে আরও কার্যকরভাবে কাজে লাগান।
প্রধানমন্ত্রী হিসেবে জাতির উদ্দেশে দেওয়া প্রথম ভাষণে মোদি কন্যাভ্রূণ হত্যার বিরুদ্ধে কথা বলেন। কন্যাভ্রূণ হত্যা বন্ধের আহ্বান জানান। কঠোর ভাষায় ধর্ষণের নিন্দা জানান মোদি। ছেলেসন্তানকে ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে অভিভাবকদের পরামর্শ দেন তিনি।
মেহতার মতে, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মোদি পরিবর্তনের অনুঘটক হয়ে ওঠেন। ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তিনি নিয়মিত নারী ইস্যুতে কথা বলেন। ব্যক্তিগত ক্যারিশমাকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি তিনি দলে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ান।
২০১৯ সালের নির্বাচনে অন্য যেকোনো দলের চেয়ে বেশিসংখ্যক নারীকে প্রার্থী করে বিজেপি। এই নির্বাচনে জয়ের পর আগের যেকোনো সরকারের তুলনায় বেশিসংখ্যক নারীকে মন্ত্রী করেন মোদি। দলের সাংগঠনিক কাঠামো পুনর্গঠন করা হয়। দলে নারীদের জন্য কোটা বরাদ্দ করা হয়।
মেহতা বলেন, বিজেপির নারী সমর্থকদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ গ্রামের বাসিন্দা। তাঁদের অবস্থান দারিদ্র্যসীমার নিচে। মূলত এই নারীদের লক্ষ্য করেই দলীয় কল্যাণ প্রকল্প নেয় বিজেপি।
ভারতে পুরুষতান্ত্রিকতার বীজ গভীরে রোপিত। দেশটিতে সম্পত্তিতে নারীদের অধিকার খুবই কম। ভারতে ২০১৪ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত দরিদ্র লোকজনকে ১৭ লাখের বেশি বাড়ি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এই বরাদ্দের প্রায় ৬৮ শতাংশ নারীর একক নামে অথবা পুরুষের সঙ্গে যৌথ নামে নিবন্ধন দেওয়া হয়েছে।
মোদি সরকার লাখো বাড়িতে টয়লেট তৈরি করে দিয়েছে। লাখো নারীকে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে সহযোগিতা করেছে। উদ্দেশ্য—নারীরা যাতে সরাসরি পেনশন, ভর্তুকি ও অন্য সুযোগ-সুবিধা পান।
মেহতা বলেন, মোদিকে প্রায়ই বলতে শোনা যায়, তাঁরা একটি কল্যাণ নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছেন, যার আওতায় দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত নারীদের সুরক্ষা দেওয়া যাবে। এই স্কিমগুলো পুরোপুরি নিখুঁত নয়। কিন্তু তা অবশ্যই পরিবর্তন নিয়ে আসবে। এসব কারণেই ভারতের অনেক নারী ভোটার এখন অন্য সব দলের চেয়ে বিজেপিকে ভালো বিবেচনা করছেন।
গ্রহণযোগ্যতা কত দিন থাকবে
ভারতের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রধান মায়া মিরচান্দানি মনে করেন, নারী ভোটারদের কাছে থেকে বিজেপি এখন যে পরিমাণ সমর্থন পাচ্ছে, সে অবস্থা বেশি দিন থাকবে না।
মায়া মিরচান্দানি বলেন, মোদি অত্যন্ত ক্যারিশমাটিক। তিনি সমর্থকদের কাছ থেকে অসাধারণ সহানুভূতি পাচ্ছেন। তাঁরা মোদিকে একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে দেখেন, যিনি সাধারণ জীবনযাপন করছেন। তাঁদের কাছে তিনি আকর্ষণীয়। কারণ তিনি উপযুক্ত। তিনি দাম্ভিক নন। তিনি নিষ্পাপ। কিন্তু মোদির বয়স এখন ৭১ বছর। মোদিকে নিয়ে মানুষের এসব ধারণা তাঁর বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ম্লান হয়ে যাবে।
মায়া আরও বলেন, ভারত এখন যেসব সমস্যার মুখোমুখি, মোদির আবেদন সেগুলোকে ছাপিয়ে যেতে পারে কি না, তা দেখার বিষয়। ভারতে বেকারত্ব বাড়ছে। মুদ্রাস্ফীতির হার উচ্চ। জ্বালানির দাম ক্রমাগত বাড়ছে। এ অবস্থায় যে একটি মাত্র বিষয় মোদির সমর্থকদের এক করে রেখেছে, তা হলো ধর্মীয় পরিচয়ের রাজনীতি। কিন্তু যদি সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়, অর্থনীতিকে যদি সংকটজনক অবস্থা থেকে বের করে আনা না যায়, তাহলে ঘর সামলানো নারীরাই মোদির বিরুদ্ধে চলে যাবেন। তবে সেই সময় এখনো আসেনি; কিন্তু আসতে পারে।