প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কূটনীতির সমালোচনা করে প্রয়াত সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি বলেছেন, দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক কখনো ব্যক্তিগত হয় না। লাহোরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের বাড়ি যাওয়ার কোনো প্রয়োজনই ছিল না মোদির। আত্মজীবনীর চতুর্থ ও শেষ খণ্ড দ্য প্রেসিডেনশিয়াল ইয়ার্স: ২০১২-২০১৭তে এভাবে মোদির সমালোচনা করেছেন ভারতের প্রথম বাঙালি রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি। গত মঙ্গলবার বইটি প্রকাশিত হয়েছে।
প্রণব মুখার্জি ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ভারতের রাষ্ট্রপতি ছিলেন। তিনি গত বছরের ৩১ আগস্ট মারা যান। আর নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসেন ২০১৪ সালে।
আফগানিস্তান থেকে দেশে ফেরার পথে ২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর মোদি আচমকাই লাহোরে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের বাড়ি গিয়েছিলেন।
এই আচমকা সফরের ঘোষণা মোদি নিজেই টুইট করে জানিয়েছিলেন। সেই সফর নিয়ে কূটনৈতিক স্তরে বিস্তর আলোচনা হয়েছিল। এর কিছুদিনের মধ্যেই পাঠানকোটের ভারতীয় বিমানবাহিনীর ঘাঁটিতে জঙ্গি হানায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। প্রধানমন্ত্রী মোদির এই আচরণ প্রণব মেনে নিতে পারেননি। আত্মজীবনীর শেষ খণ্ডে এর উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, ‘নওয়াজ শরিফের বাড়ি যাওয়ার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। সেই সময় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক যা ছিল, তাতে গায়ে পড়ে এই বন্ধুত্ব বা দৌত্য ছিল নিছকই অপ্রয়োজনীয় ও অযৌক্তিক।’
দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে বিদেশি রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে ব্যক্তিগত রসায়নকে মোদি বরাবর গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন। সম্পর্ককে ব্যক্তিগত স্তরে নিয়ে যেতে চেয়েছেন। ব্যক্তিগত সখ্য স্থাপনে উদ্যোগী হয়েছেন। কূটনৈতিক সম্পর্কের ঊর্ধ্বে গিয়ে বন্ধুত্ব স্থাপনের এই প্রচেষ্টা প্রণব অনুমোদন করেননি। মোদিকে জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে ‘ভরসাযোগ্য বন্ধু’ বলে অভিহিত করেছিলেন। তার উল্লেখ করে প্রণব লিখেছেন, ‘আমি রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে ব্যক্তিগত বন্ধুত্বের বিরোধী। কারণ, তা কূটনৈতিক সম্পর্কের বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আন্তর্জাতিক সম্পর্কে এই বন্ধুত্বের কোনো গুরুত্ব নেই। কূটনীতিতে কোনো সম্পর্কই ব্যক্তিগত হয় না।’
এই প্রসঙ্গে প্রণব বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর পারিবারিক রসায়নের উল্লেখ করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘বাংলাদেশের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বও পুরোপুরি রাজনৈতিক। অবশ্যই শেখ হাসিনার সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। তখন তিনি ভারতে ছিলেন। আমার মনে হয়, প্রধানমন্ত্রী মোদি ব্যক্তিগত (বিভিন্ন রাষ্ট্রনায়কদের সঙ্গে) সম্পর্কের সমীকরণ নিয়ে বড় বেশি বাড়াবাড়ি করেছেন। এ ধরনের সম্পর্ককে সত্যিকারের বন্ধুত্ব ভেবে নেওয়া ভুল ও অযৌক্তিক।’
মোদির অনভিজ্ঞতা এর জন্য দায়ী বলে মনে করেন প্রণব। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে বার কয়েক বিদেশ ভ্রমণ করলেও প্রয়াত রাষ্ট্রপতির মতে, অভ্যন্তরীণ বা আন্তর্জাতিক নীতি নিয়ে বিশেষ ধারণা ছিল না। অনভিজ্ঞই ছিলেন। সেই কারণে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে একের পর এক যে ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, অতীতে আর কেউ তেমন করেননি। ফলে সমালোচিত হয়েছেন। প্রণবের মতে, অনভিজ্ঞতার দরুন প্রধানমন্ত্রী মোদির প্রথমবারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে নওয়াজ শরিফসহ সার্ক সদস্যদেশের রাষ্ট্রনেতাদের আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের বিস্মিত করেছিল। সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নিয়েও মোদি বাড়াবাড়ি করেছিলেন বলে প্রণববাবু মনে করেন। কারণ, তাঁর মতে, ‘পাকিস্তানি আগ্রাসনের জবাবে সীমান্তে এমন ঘটনা আকছার ঘটে। ভারতীয় সেনা এমন ধরনের হামলা প্রায়ই চালিয়ে থাকে। এতটা বাড়াবাড়ি তাই না করলেও চলত। এতে ভারতের কোনো লাভ হয়নি।’
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের সঙ্গে মোদিকে সম্পর্ক গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছেন প্রণব। লিখেছেন, ‘ইমরান স্বাধীনতার পরে জন্মেছেন। তিনি নতুন প্রজন্মের রাজনীতিক। স্বাধীনতা-পূর্ব ভারতে মুসলিম লিগ যে ধরনের রাজনীতি করত, তার কোনো দায় ইমরান খানের নেই।’ প্রণব লিখেছেন, ‘ভারত সম্পর্কে ইমরানের অবস্থান কী, সে বিষয়ে আমাদের নিশ্চিত হওয়া দরকার। ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, ইমরানের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক গড়ে তোলা উচিত।’
প্রধানমন্ত্রী মোদির কাজের ধরনের কিছু সমালোচনা প্রণব আত্মজীবনীর এই খণ্ডে করেছেন। মোদির কাজ করার ধরন তাঁর ‘স্বৈরতন্ত্রী’ বলে মনে হয়েছে। সেই কারণে তাঁকে কিছু পরামর্শও দিয়েছেন। বলেছেন, বিরোধীদের হেলাফেলা না করে তাঁদের কথা বেশি করে শোনা উচিত। সংসদে আরও বেশি করে তাঁর উপস্থিত থাকা দরকার। সংসদ সুষ্ঠুভাবে চালনার প্রাথমিক দায়িত্ব পালনে মোদির ব্যর্থতার উল্লেখ করে সাবেক রাষ্ট্রপতি লিখেছেন, সংসদকে ব্যবহার করে বিরোধীদের সন্তুষ্ট করার মধ্য দিয়ে দেশবাসীর কাছে তিনি সঠিক তথ্য পৌঁছে দিতে পারেন। এই ফোরামকে ব্যবহার করা প্রয়োজন। ইউপিএ (সংযুক্ত প্রগতিশীল মোর্চা) আমলে এই বিষয়ে নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি লিখেছেন, সব সময় তিনি বিরোধী নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। বিভিন্ন বিষয়ে ইউপিএ ও এনডিএ (জাতীয় গণতান্ত্রিক জোট) দুই শিবিরের অভিজ্ঞ নেতাদের মতামত নিতেন। নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি আগে বলেছিলেন, ‘সংখ্যাগরিষ্ঠতা স্থিতিশীলতা দেয় ঠিকই, কিন্তু কাজ করতে হয় সবার সঙ্গে মিলেমিশে। সংসদীয় গণতন্ত্রের নিয়মই তা। এর উল্টো পথের পথিকদের ভোটাররা শাস্তি দিয়েছেন।’