বিহারের সেই 'পাকড়ওয়া' বিয়ে অবৈধ: আদালত
২০১৭ সালের ডিসেম্বরে ভাইরাল হয়ছিল ভারতের বিহার রাজ্যের একটি ভিডিও। বিয়ের আসরে বসে বড় ঘোমটা দিয়ে জড়সড় হয়ে বসে থাকা কনের পাশে আকুল হয়ে কাঁদছেন বর। বরের বিয়ের সাজ বলতে মাথায় পাগড়ি ও গলায় উত্তরীয়। পরনের পোশাক সাধারণ শার্ট-প্যান্ট। ভিডিওতে দেখা যায়, বরের কান্না দেখে পাশ থেকে খুব বিরক্তি নিয়ে একজন বলছেন, ‘আমরা তো তোমাকে ফাঁসি দিচ্ছি না, বাপু!’ একজন বয়স্ক নারীকে দেখা গেল বরের চোখ মুছে দিতে। সান্ত্বনা দিয়ে বলছেন, ‘যা হওয়ার হয়ে গেছে।’
ভিডিওর ক্রন্দনরত ওই বরের নাম বিনোদ কুমার (৩০)। তিনি ভারতের একজন প্রকৌশলী। বিয়েটি ছিল ‘পাকড়ওয়া’ বিয়ে, জোরপূর্বক বরকে ধরে এনে বিয়ে দেওয়া হয়। ওই বিয়ে অস্বীকার করে তখনই মামলা করেছিলেন বিনোদ। প্রায় দেড় বছরের আইনি লড়াই শেষে ভারতের আদালত তাঁর পক্ষে আদেশ দিয়েছেন। ওই বিয়েকে অবৈধ ঘোষণা করেছেন আদালত।
বিনোদের ঘটনাটিকে কেন্দ্র করে একটি হিন্দি সিনেমাও হয়েছে, যা মুক্তির অপেক্ষায়।
এ ধরনের বিয়ের চল ভারতের বিহার ও উত্তর প্রদেশের কিছু এলাকায়। ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো বলছে, ‘পাকড়ওয়া’ বিয়ের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঘটেছে বিহার রাজ্যে। ভারতের অন্যতম দরিদ্র রাজ্য বিহারে এখনো পণপ্রথা ব্যাপক। ছেলের পরিবারকে অনেক যৌতুক দিয়ে মেয়ের বিয়ে দিতে হয়। গরিব মানুষের পক্ষে এটা সম্ভব হয় না। ফলে কন্যাদায়গ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা উপযুক্ত পাত্র পেলে তাঁকে আপসে বাগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। না পারলে অস্ত্রের মুখে কিংবা ভাড়াটে গুন্ডা দিয়ে ওই পাত্রকে অপহরণ করেন। এরপর জোর করে বাড়ির মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়।
ভারতীয় গণমাধ্যম এনডিটিভি অনলাইনের খবরে জানানো হয়, বিনোদ কুমার জানিয়েছেন, মে মাসে তাঁর বিয়ে বাতিলের আদেশ দিয়েছেন আদালত। তবে মাত্র কয়েক দিন আগে তাঁর কাছে আদালতের ওই আদেশ পৌঁছেছে। শুরুতে স্থানীয় পুলিশ বিনোদের অভিযোগ আমলে না নিয়ে তা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে। বিয়েটা মেনে নিয়ে সংসার করতে পরামর্শ দেয়। তবে ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহলের নজরে এলে এতে হস্তক্ষেপ করা হয়। ঘটনা খতিয়ে দেখে তারা নিশ্চিত হয় যে বিনোদকে জোর করে বিয়ে দেওয়া হয়েছে। জোরপূর্বক এই বিয়ে থেকে নিষ্কৃতি পেতে বিনোদ কুমার দুইটি মামলা করেন। একটি হলো বিয়েটি অকার্যকর ঘোষণা করা এবং অপরটি হলো ফৌজদারি মামলা।
বিনোদ জানান, অস্ত্রের মুখে তাঁকে বিয়ে করতে বাধ্য করা হয়। বিয়ে না করলে তাঁকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। ঘটনার প্রায় ছয় সপ্তাহ পর ১৩ জানুয়ারি বিনোদ কনের পরিবারের বিরুদ্ধে জোরপূর্বক বিয়ের অভিযোগ এনে মামলা করেন। এর আগে ঘটনার পরপর তিনি ভাইকে সঙ্গে নিয়ে থানায় গেলেও পুলিশ অভিযোগ নেয়নি। পুলিশ তাঁর ভাইকে বলেছিল, ‘কাঁহি তো শাদি কিজিয়েগা, ম্যানেজ কর লিজিয়ে’ (কোথাও না কোথাও তো বিয়ে করবেনই, মিটমাট করে ফেলুন)।
এনডিটিভিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিনোদ বলেন, ‘কনের ভাই সুরেন্দ্র যাদব আমাকে মারধর করেন এবং তাঁর বোনকে বিয়ে না করলে মেরে ফেলার হুমকি দেন। তাঁরা আমাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে বিয়ের মণ্ডপে বসান এবং আমার মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে রাখেন। আমি এত অসহায় বোধ করছিলাম। আমার কিছুই করার ছিল না। আমি কেঁদেই যাচ্ছিলাম, কিন্তু তাঁরা তা আমলেই নেননি।’
বিনোদ জানান, ঘটনাটি খুবই পরিকল্পিত ছিল। তিনি পাটনায় বন্ধুর বিয়েতে যাওয়ার জন্য বাড়ি থেকে বেরিয়েছিলেন। তাঁর পরিচিত এক ব্যক্তি তাঁকে বিয়েবাড়িতে নামিয়ে দেবেন বলে তাঁর সঙ্গে যেতে বলেন। কিন্তু পথে ওই ব্যক্তি জানান, তাঁকে বাড়ি থেকে কিছু একটা নিতে হবে। এই বলে বিনোদকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। ওই বাড়িতে আগে থেকেই বিয়ের প্রস্তুতি নেওয়া ছিল। বিনোদ সেখানে প্রবেশ করামাত্র তাঁকে অস্ত্রের মুখে একটি কক্ষে বন্দী করা হয় এবং মারধর করা হয়।
আদালতের আদেশের ব্যাপারে বিনোদ বলেছেন, তেমন কোনো সুযোগ না থাকলেও কনেপক্ষ যদি আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে, তবে তিনি এর শেষ পর্যন্ত লড়াই করবেন।
আশির দশকে বিহারের বেগুসারাই, সামস্তিপুর, পাটনা ও লক্ষ্মীসারাই জেলাগুলোতে বিয়ের জন্য বর তুলে আনার ঘটনা প্রথম শোনা যায়। বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকা এ ঘটনা রীতিমতো রেওয়াজে পরিণত হয়ে গেছে। অজস্র গল্পের উপাদান হয়েছে এসব ঘটনা। হিন্দি ও ভোজপুরি ভাষায় এই কাহিনি নিয়ে তথ্যচিত্র এবং সিনেমাও তৈরি হয়েছে। এ ধরনের বিয়ের পর কনেরাও পড়েন সমস্যায়। এই ‘শটগান ওয়েডিং’–এর শিকার বিনোদ একাই হননি। বিহারে হাজার হাজার ছেলে এমন অপহরণের পর জোরপূর্বক বিয়ের শিকার হচ্ছেন।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মতে, অতিমাত্রায় যৌতুক দাবি এবং আইনের প্রতি অবজ্ঞা এ ধরনের গুরুতর অপরাধের মূল কারণ। যৌতুকের জন্য কনের পরিবারকে যত অর্থ ব্যয় করতে হয়, এর চেয়ে অনেক কম খরচ হয় অপহরণের কাজে। অপহরণকারীরা কম খরচেই বর তুলে আনার কাজটি করে দেন। শুরুতে শটগান ওয়েডিংয়ের ঘটনা ঘটা শুরু করেছিল উচ্চবর্ণের ভূমিহার এবং পশ্চাৎপদ শ্রেণির ওবিসি (আদার ব্যাকওয়ার্ড ক্লাস) যাদবের মধ্যে। ভারত সরকার সামাজিক ও শিক্ষায় পিছিয়ে থাকা বর্ণের লোকজনকে শ্রেণিভুক্ত করতে ওবিসি শব্দটি ব্যবহার করে। বিনোদ একজন ওবিসি। বিনোদের ঘটনাটি বুঝিয়ে দিয়েছে, অপহরণ করে বিয়ে হলেও বর্ণ ও গোত্র ( নির্দিষ্ট একটি বর্ণের মধ্যে উপশাখা) নিয়ে সতর্কতা বজায় রাখা হয়েছে।
বিহার পুলিশ বিয়ের জন্য বর অপহরণের আলাদা কোনো ডেটা সংরক্ষণ করে না। পালিয়ে বিয়ের ঘটনাও এতে ধরা হয়। রাজ্যের অপরাধবিষয়ক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০১০ সালে বিয়ের জন্য অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ৭০২টি। ২০১৬ সালে এই সংখ্যা প্রায় দেড়গুণ বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ৭০টিতে। ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এ ধরনের অপহরণের ঘটনা ঘটেছে ৩ হাজার ১১০টি। তবে যে হারে শটগান ওয়েডিংয়ের ঘটনা ঘটছে, সে তুলনায় এই পরিসংখ্যানে তা খুব কমই প্রকাশ পাচ্ছে। তবে ‘পাকড়ওয়া’ বিয়ের বিরুদ্ধে পুলিশ তৎপর হওয়ায় এখন তা অনেকখানি কমেছে।