কেরালায় সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যের ২০টি আসনে কংগ্রেস-জোট পেয়েছিল ১৯টি; বামজোট বাকি ১টি। ওই নির্বাচনে কংগ্রেস-জোট ভোট পায় ৪৭ শতাংশ; বামরা ৩৬ শতাংশ, বিজেপি–জোট ১৬ ভাগ।
এর আগের ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে এই রাজ্যে বিজেপি–জোট ভোট পায় ১৫ ভাগ, কংগ্রেস-জোট ৩৯ ভাগ এবং বাম-জোট ৪৩ ভাগ। ঐ নির্বাচনে বিজেপি বিধানসভায় মাত্র একটা আসন পায়। বামরা পায় ৯১টি; কংগ্রেস-জোট পায় ৪৭টি।
সর্বশেষ এই দুই নির্বাচন বিবেচনায় নিয়ে বলা যায়, বিজেপি কেরালায় আসনের হিসাবে কোন অবস্থানই তৈরি করতে পারছে না। যদিও বিগত দশকের চেয়ে তাদের ভোটের হিস্যা সামান্য বেড়েছে। কিন্তু আজও এই রাজ্য থেকে লোকসভায় বিজেপি কোনো এমপি পেল না।
সর্বশেষ গত মাসে অনুষ্ঠিত বিধানসভা ভোটের আজ প্রকাশিত ফলাফলেও বিজেপিকে কেরালায় দূরবর্তী তৃতীয় অবস্থানেই থাকতে হচ্ছে। এই লেখা তৈরির সময় ১৪০ আসনের মধ্যে দলটি মাত্র ১টি আসনে গণনায় এগিয়ে আছে। বোঝা যাচ্ছে, বিজেপি এখানে আগের অবস্থা পাল্টাতে পারেনি। অথচ ভারতজুড়ে গত এক দশক দলটির জয়জয়কার চলছে। মোদি-অমিত শাহ জুটিকে ভারতের নির্বাচনী ইতিহাসে অপ্রতিদ্বন্দ্বী জুটি বলা হচ্ছে। কিন্তু ২০১৪ ও ২০১৯ সালে এই জুটির সর্বভারতীয় সব নির্বাচনী সাফল্যকে ম্লান করে কেরালা অন্যান্য দলকে বেছে নিচ্ছে বিধানসভা ও লোকসভায় তাদের প্রতিনিধি হিসেবে।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে বিজেপির হিন্দুত্ববাদ কেরালায় এসে আবেদন হারিয়ে ফেলে কেন?
কেরালা ধর্মীয় চরিত্রে বহুত্ববাদী, ৪৫ ভাগ জনসংখ্যা অ-হিন্দু
কেরালায় বিজেপির ব্যর্থতার প্রাথমিক কারণ এই রাজ্যের রাজনৈতিক সচেতনতার উঁচু মান। সাধারণ সাম্প্রদায়িক কলাকৌশলে এখানকার ভোটাররা কোনো দলের প্রতি আকর্ষিত হয়ে যায় না। সচরাচর বিজেপির রাজনীতির মূল পুঁজিই হচ্ছে ধর্মীয় বিদ্বেষ। এই পুঁজি নিয়ে দলটি প্রায় পুরো ভারত মাতিয়ে বেড়ালেও কেরালায় এসে তাদের বিজয়রথ থেমে যায়। নিজেদের কর্মী জগতের বাইরে এখানে দলটির আবেদন সামান্য।
কেরালায় এবার নির্বাচনী প্রচারে রাজ্যের উত্তরের কিছু আসনে পার্শ্ববর্তী কর্ণাটক থেকে সংগঠক এনে প্রচার চালিয়েছে বিজেপি। কিন্তু এখানকার ধর্মীয় বহুত্ববাদী চরিত্র বিজেপির এই সংগঠকদের জন্য বড় সমস্যা হিসেবে থেকে গেছে।
মালায়ামবাসী কেরালায় হিন্দু বিশ্বাসের অনুসারী প্রায় ৫৫ ভাগ মানুষ, ২৭ ভাগ ইসলাম ধর্মাবলম্বী ও ১৮ ভাগ খ্রিষ্টান। যেহেতু রাজ্যে প্রায় ৪৫ ভাগ অ-হিন্দু মানুষ আছে, সে কারণে কেবল হিন্দুত্ববাদের ওপর ভর করে এখানে কোনো দলের নির্বাচনী সাফল্য পাওয়া দুরূহ।
এখানকার হিন্দু বিশ্বাসীদের মধ্যে আবার কমিউনিস্ট পার্টির উল্লেখযোগ্য সাংগঠনিক কাজ রয়েছে। রাজ্যের হিন্দু সমাজে ‘ইঝাভাহ’ নামে পরিচিত তুলনামূলকভাবে নিম্নবর্ণের কৃষিজীবী গোষ্ঠীতে বামদলগুলোর রয়েছে দৃঢ়ভিত্তি। বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ানও একজন ইঝাভাহ। এই সম্প্রদায় হলো রাজ্যের হিন্দুদের চার ভাগের এক ভাগ। এদের মধ্যে কমিউনিস্টদের উপস্থিতি এবং মুসলমান ও খ্রিষ্টানদের বিজেপি ভীতি মিলেমিশে থাকায় কেরালায় বিজেপির পক্ষে একচেটিয়া ঢেউ তোলা কঠিন হয়ে আছে।
হিন্দুদের উচ্চবর্ণ স্থানীয় ‘নায়ার’ আগের মতো আর বিজেপির ডাকে সাড়া দিচ্ছে না। তারা রাজ্যের যেকোনো একটি পুরোনো প্রধান দলের সঙ্গেই থাকতে চাইছে। নায়াররা কেরালায় জনসংখ্যার প্রায় ১৪ ভাগ এবং বিজেপির যা কিছু সাংগঠনিক ভিত্তি মূলত এদের মধ্যেই। এদের একাংশকে ব্যবহার করেই বিজেপি পুরো রাজ্যে মন্দিরগুলোকে কেন্দ্রে রেখে তৃণমূলে বিকল্প সামাজিক ভরকেন্দ্র গড়তে চেষ্টা করছে কয়েক দশক ধরে। এখনো তা বেশি সফলতা পায়নি। এবারের নির্বাচন তার সাক্ষ্য দিচ্ছে। তবে বিজেপির এই তুমুল চেষ্টার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হিসেবে রাজ্যের মুসলমানদের মধ্যে অতীতের উদার সংস্কৃতির উল্টো¯স্রোত বইছে মৃদুলয়ে। এটা আবার পরোক্ষে বিজেপিকেই সাহায্য করবে ভবিষ্যতে বৃহত্তর হিন্দু সমাজে তার রক্ষণশীল দুর্গ গড়তে।
নারী ভোটার বেশি, সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে তারা
কেরালার সামাজিক সংস্কৃতিতে অতি প্রাচীনকাল থেকে বহুধর্মীয় একটা ছাপ রয়েছে। ভারতের সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ, সিনাগগ ও চার্চ কেরালাতেই রয়েছে। এসবই এখানকার মানুষকে এক ধরনের সাম্প্রদায়িক মিলনের আবহে বড় করে তোলে, যা আরএসএস-বিজেপির রাজনীতির জন্য সহায়ক হয় না। তারা বিজেপির রাজনীতিকে স্বস্তি বিনষ্টকারী উপাদান হিসেবে দেখে এখনো। এখানকার ভাসমান ভোটার ও প্রতি নির্বাচনে পছন্দ পরিবর্তনকারী ভোটার সংখ্যাই বেশি, যা রাজ্যের রাজনীতিবিদদের প্রশাসনিক বিষয়ে চাপে রাখে। প্রশাসন পরিচালনার যোগ্যতা দিয়েই এখানে ভোটের হিসাব অদল-বদল হয়, ধর্মভিত্তিক উন্মাদনায় নয়।
এ ছাড়া উত্তর ও পূর্ব ভারতের সীমান্তঘেঁষা রাজ্যগুলোতে চীন-পাকিস্তান-বাংলাদেশকে ছদ্ম প্রতিপক্ষ বানিয়ে বিজেপি যেভাবে জাতীয়তাবাদী উন্মাদনা তৈরি করে, দক্ষিণে অনুরূপ সীমান্ত না থাকায় সেটাও অসম্ভব। যে কারণে কেরালার অনেক খ্যাতনামা পেশাজীবীকে দলে এনেও বিজেপি ভোটের দৌড়ে তাদের জিতিয়ে আনতে পারেনি। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ইত্যাদি জায়গায় বিজেপি যেভাবে অন্য দলের নেতাদের নানা প্রলোভনে বাগিয়ে এনে নিজেদের নির্বাচনী আসন বাড়ায়, কেরালায় এটাও বেশ দুরূহ। এক দল ছেড়ে অন্য দলে যাওয়ার ঐতিহ্য বেশ কম এখানে।
কেরালার আরেকটি নির্বাচনী বিশেষত্ব হলো, এখানকার পৌনে তিন কোটি ভোটারের মধ্যে পুরুষের চেয়ে নারী ভোটার প্রায় নয় লাখ বেশি। এই নারীদের বড় এক অংশ শ্রমজীবী। এরাও স্থানীয় বামদলগুলোর বড় ভোটব্যাংক। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে এই নারীরা বড় এক প্রাচীর হিসেবে কাজ করছে।
জিততে মুসলমান-খ্রিষ্টান ভোট পেতে হয়, বিজেপির জন্য যা কঠিন
সমকালীন ভারতের নির্বাচনী ইতিহাসে কেরালায় বিজেপির বারবার ব্যর্থতা থেকে কয়েকটি স্পষ্ট বার্তা মেলে। প্রথমেই যা ধরা পড়ে, তা হলো সংখ্যালঘুদের জন্য দলটির কোনো ইতিবাচক রাজনীতি নেই। বিজেপি পরিপূর্ণভাবে সংখ্যাগুরুর দল হয়ে পড়েছে—যা ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে বেশ বেমানান। এ কারণে বিজেপি উত্তর ভারতে প্রায় একচেটিয়া হয়ে উঠলেও দক্ষিণ ভারতে কর্ণাটকের বাইরে তার অস্তিত্ব প্রত্যাশিত মাত্রায় সবল নয়। আবার যেহেতু উত্তর ভারতে বিজয়ের জন্য বিজেপি সংখ্যাগুরুর মনোরঞ্জনে জোর দেয়, সে কারণে কেরালার মতো দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্যগুলোতে তার চূড়ান্ত নির্বাচনী সফলতার সম্ভাবনা নিকট ভবিষ্যতেও কম।
কেরালায় উল্লেখযোগ্য সংখ্যায় আসন পেতে হলে বিজেপিকে অবশ্যই বড় অঙ্কের মুসলমান ও খ্রিষ্টান ভোট পেতে হবে। সে ক্ষেত্রে বিজেপি রাজ্যের খ্রিষ্টানদের দুটি ধারার মধ্য থেকে ‘সিরিয়ান খ্রিষ্টান’ নামের অংশকে কাছে টানার চেষ্টা করছে। তাদের এসব কৌশল দীর্ঘ মেয়াদে কতটা সফল হবে, সেটা ভবিষ্যতই বলতে পারে। তবে তাৎক্ষণিক লাভ পেতে এবারের বিধানসভা নির্বাচনে তারা ১০ জন খ্রিষ্টান ও ৫ জন মুসলমানকে মনোনয়ন দিয়েছিল। কিন্তু ভোটের ফলে এই কৌশলের মোড় পরিবর্তনকারী কোনো ফলাফল দেখা যাচ্ছে না।
সাক্ষরতার উঁচু হার রাজনৈতিক সচেতনতার জ্বালানি
কেরালার গত কয়েকটি নির্বাচনের ফল বিশ্লেষণ থেকে যা দেখা যায়,Ñভারতের রাজনীতিসচেতন এলাকাগুলো বিজেপিকে গ্রহণ করছে না, যতটা গ্রহণ করছে রাজনৈতিক সচেতনতায় পিছিয়ে থাকা অঞ্চল। কেরালা ছাড়াও পাঞ্জাব, পশ্চিমবঙ্গ, দিল্লিতে বিজেপির কম গ্রহণযোগ্যতা কেরালার অভিজ্ঞতাকেই স্মরণ করিয়ে দেয়। এসব অঞ্চলে শিক্ষার উচ্চ হার রাজনৈতিক সচেতনতার জ্বালানি হিসেবে কাজ করছে। ৯৬ শতাংশ সক্ষরতার হার নিয়ে কেরালা এ ক্ষেত্রে বর্তমানে ভারতের সব রাজ্যের ওপরে অবস্থান করছে। তারপরই রয়েছে দিল্লি।
কেরালার নির্বাচনী রাজনীতির অভিজ্ঞতা থেকে তৃতীয় আরেক বৈশিষ্ট্য দেখা যাচ্ছে, হিন্দুত্বকে ব্যবহার করা ছাড়া বিজেপির হাতে বিকল্প কর্মসূচি নেই—যা দিয়ে ধর্মীয় পরিচয় নির্বিশেষে সব ভারতীয়ের কাছে যাওয়া যায়। দেশটির দক্ষিণে মানুষ রাজনীতিকে যতটা জনজীবনের প্রশাসনিক ইস্যু হিসেবে দেখে, ততটাই কম দেখে ধর্মযুক্ত বিষয় হিসেবে। এ রকম মানুষকে নিয়ে বিজেপির সমস্যা। দক্ষিণের সাংস্কৃতিক এই ভিন্নতা মোদি-অমিত শাহর নির্বাচনী প্রকৌশলবিদ্যা কোনোভাবে অতিক্রম করতে পারছে না। কেরালায় মোটা দাগে সেটাই প্রমাণ হলো আবার আজ।
আলতাফ পারভেজ: গবেষক