রাজস্থানে ভোট শুরু, ৩০ বছরের প্রথা কি এবার ভাঙবে
ভারতের রাজস্থান রাজ্যের বিধানসভার ভোট আজ শনিবার সকালে শুরু হয়েছে। ২০০ আসনের এই রাজ্যের বিধানসভা আসনের মধ্যে ১৯৯টিতে ভোট হচ্ছে। শনিবার সকাল সাতটায় শুরু হওয়া এই ভোট ঠিক করে দেবে, দীর্ঘ তিন দশকের প্রথা মেনে এবারও রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটবে কি না।
উত্তর ভারতের গো-বলয়ের এই রাজ্যের শাসনভার বিজেপি ও কংগ্রেস ৩০ বছর ধরে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে চলেছে। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর রাজ্যের জনগণ শাসক পাল্টে দিয়েছে। ১৯৯৩ সালে রাজ্য শাসন করত বিজেপি, ১৯৯৮ সালে কংগ্রেস ক্ষমতায় আসে। পরের প্রতি পাঁচ বছরে সেই রাজনৈতিক চরিত্রের বদল ঘটেছে। সেই প্রথা এবারও মানা হলে ক্ষমতায় আসার কথা বিজেপির।
প্রথা অটুট রাখতে চেষ্টার ত্রুটি রাখেনি বিজেপি। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথসহ বিজেপির সব বড় নেতা দিনরাত এক করে দিয়েছেন। তাঁদের প্রচারে মুখ্যমন্ত্রী অশোক গেহলটের ‘ব্যর্থতার’ চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে ‘মুসলমান তুষ্টিকরণ’-এর অভিযোগ। সেই সঙ্গে ‘দুনীতি’ প্রসঙ্গ।
পাল্টা অশোক গেহলট হাতিয়ার করেছেন তাঁর পাঁচ বছরের ‘সুশাসন’ ও বিভিন্ন জনমুখী প্রকল্প। কীভাবে তিনি তাঁর শাসনকালে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন যন্ত্রণা ও কষ্ট লাঘবের চেষ্টা করেছেন, গরিব মানুষের হাতে সরাসরি অর্থের জোগান দিয়ে ক্রয়ক্ষমতা বাড়িয়ে অর্থনীতি সচল রাখতে চেয়েছেন, মূল্যবৃদ্ধি রুখতে ভর্তুকির ব্যবস্থা করেছেন, সেসবই তুলে ধরছেন বড় করে। ফলে এই প্রথম এমন একটা ধারণা সৃষ্টি হয়েছে, ৩০ বছরের প্রথা এবার প্রথমবারের মতো ভেঙে গেলেও যেতে পারে।
এ ধারণা বা রাজনৈতিক জল্পনার সম্ভাব্য কারণ রাজ্য বিজেপির অবিসংবাদিত নেত্রী বসুন্ধরা রাজের ‘অসন্তোষ’। বিজেপিতে রাজ্য স্তরের যে তিন নেতা-নেত্রী মোদি-শাহ জমানায় এখনো তাঁদের ‘স্বকীয়তা’ বজায় রেখে চলেছেন, অন্যভাবে বলতে গেলে, মোদি-শাহর ‘অন্ধ অনুগামী’ হয়ে ওঠেননি, বসুন্ধরা রাজে তাঁদের একজন। অন্য দুজন হলেন মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহান ও ছত্তিশগড়ের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী রমন সিং।
এবার ভোটে বিজেপি এই তিনজনকেই তেমন গুরুত্ব দেয়নি। তিনজনের একজনকেও সম্ভাব্য মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে সামনে রেখে বিজেপি প্রচার চালায়নি। বরং রাজনৈতিক বার্তাটা এমন, ক্ষমতায় এলে তিন রাজ্যেই বিজেপি নতুন মুখকে দায়িত্ব দেবে।
অথচ বিজেপির বসুন্ধরা রাজে ও কংগ্রেসের অশোক গেহলট ২৫ বছর ধরে পালা করে রাজস্থান শাসন করে আসছেন। গেহলট মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন তিনবার, বুসন্ধরা দুবার। কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে সেভাবে কল্কে না পেয়ে বেশ খানিকটা অসম্মানিত বোধ করে তিনি অনেক দিন স্বেচ্ছাবন্দী ছিলেন।
অবশ্য শেষবেলায় বিজেপি তাঁকে ও তাঁর সমর্থকদের টিকিট দিয়ে মানভঞ্জনের চেষ্টা করেছে। এতে কতটা কাজ হবে আজ শনিবার জনতা তা বুঝিয়ে দেবেন। ভোটের আগে বিজেপি মহলে এই বার্তা স্পষ্ট, প্রথা মেনে ক্ষমতার হাতবদল হলে রাজধানী জয়পুরের কুর্সিতে এবার বসুন্ধরাকে দেখা যাবে না।
বিজেপিতে এই দোলাচলের মতো কংগ্রেসে বড় প্রশ্ন, এত দিন ধরে গেহলটের ‘বিরোধিতা’ করে আসা তরুণ কংগ্রেস নেতা শচিন পাইলট দলকে জেতাতে কতটা মরিয়া হবেন। কংগ্রেসের এই চিরায়ত গোষ্ঠীগত দ্বন্দ্বে হাওয়া দিতে কয়েক দিন ধরে বিজেপি চেষ্টা চালাচ্ছে। খোদ প্রধানমন্ত্রীই প্রতিটি জনসভায় বলেছেন, শচিনের প্রয়াত পিতা রাজেশ পাইলটের সঙ্গে গান্ধী পরিবার সুবিচার করেনি। বাবার ‘দোষের’ সাজা তারা এখন ছেলেকে দিচ্ছে। শচিন পাইলটকে তাঁর প্রাপ্য গুরুত্ব গান্ধীরা দিচ্ছেন না।
রাজস্থানের ভোটে বরাবর দেখা গেছে, স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সরকার গঠনের ক্ষেত্রে নির্ণায়ক ভূমিকা নিচ্ছেন।
গতবারও কংগ্রেসকে শক্তি জুগিয়ে ক্ষমতায় আনতে মায়াবতীর বিএসপির ছয়জন ও অন্য স্বতন্ত্র প্রার্থীরা সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলেন। এই রাজ্যে ২০০ আসনের মধ্যে (একটিতে ভোট হচ্ছে না কংগ্রেস প্রার্থীর মুত্যুর কারণে) বরাবর কমবেশি ২০টি আসন স্বতন্ত্র অথবা ছোট দলের জিম্মায় থাকে। এবার সেই আসনগুলোর বড় দাবিদার হতে চলেছে আদিবাসী সমাজ। এ সমাজে এত দিন কংগ্রেসের প্রভাব ছিল বেশি। গত ভোটেও ২৫টি তফসিল উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত আসনে কংগ্রেস পেয়েছিল ১২টি, বিজেপি ৯টি। এবার আদিবাসীদের নিজস্ব দল ‘ভারতীয় ট্রাইবাল পার্টি’র ধারণা, তারা অন্তত ১০টি আসনে জিতবে। তেমন হলে সরকার গঠনে তারা বড় ভূমিকা নেবে।
রাজ্যে ২০০ আসনের মধ্যে ৫৪টিতে কংগ্রেস ২০০৮ সাল থেকে জিততে পারেনি। বিজেপি পারেনি ১৯টি আসনে কখনো জিততে। এটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তেমনই গুরুত্বপূর্ণ হলো কংগ্রেস সব সময় ক্ষমতায় এসেছে বিজেপির চেয়ে সামান্য কিছু বেশি আসন পেয়ে। তুলনায় বিজেপির আসন ব্যবধান থেকেছে সব সময় বেশি। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য, গোটা রাজ্যে প্রায় ৫০টি এমন আসন রয়েছে, যেখানে গতবার জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়েছে সামান্য ব্যবধানে।
প্রাক্-নির্বাচনী সমীক্ষা বা জরিপে বিজেপির এগিয়ে থাকার কারণ যেমন পালাবদলের ঐতিহাসিক প্রথা ও প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আকর্ষণ, তেমনই গেহলটের জনপ্রিয়তার কারণ তাঁর বিভিন্ন জনমুখী প্রকল্প।
তাঁর প্রচলিত স্বাস্থ্যবিমা, সরকারি কর্মীদের পুরোনো পেনশন প্রথা চালু, নারী ও বেকারদের মাসিক ভাতা এবং সস্তায় রান্নার গ্যাস দেওয়ার সিদ্ধান্ত জনমনে বিপুল সাড়া ফেলেছে।
জনতা বুঝে গেছে, কংগ্রেস জিতলে গেহলটই হবেন মুখ্যমন্ত্রী। অতএব প্রকল্প রূপায়ণ সহজ হবে। হারলে সত্তোরর্ধ অশোক গেহলটের রাজনৈতিক ইনিংস শেষ। অন্যদিকে বিজেপি জিতলে সবচেয়ে জনপ্রিয় নেত্রী বসুন্ধরা যে মুখ্যমন্ত্রী হবেন না, তা–ও মোটামুটি স্পষ্ট। তেমন হলে রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়েও মোদি-শাহ অনুগতদের রাজত্ব শুরু হবে। শেষ হবে বিজেপিতে বাজপেয়ী-আদবানির অনুগামীদের দিন।