প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্কে বাধা ‘মোদির রাজনীতি’
ভারতের নরেন্দ্র মোদি সরকার শুধু নিজেদের নিরাপত্তার কথা বলে শেখ হাসিনার সব কাজে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে গেছে। এমনকি বিরোধী রাজনৈতিক দল ছাড়াই অনুষ্ঠিত বিতর্কিত নির্বাচনের পরও তাঁর ওপর চাপ না দিতে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে তদবির করেছে নয়াদিল্লি। শুধু বাংলাদেশ নয়, মোদির সরকারের হিন্দুত্ববাদী নীতির কারণে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে নয়াদিল্লির সম্পর্কে টানাপোড়েন রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাময়িকী ফরেন পলিসিতে লিখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল ইউনিভার্সিটির প্রভাষক ও ভারতীয় সাময়িকী দ্য ক্যারাভানের উপদেষ্টা সম্পাদক সুশান্ত সিং।
নরেন্দ্র মোদি ১০ বছর আগে যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন, তখন তাঁর শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিটি দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানেরা উপস্থিত ছিলেন। এতে মোদির ‘সবার আগে প্রতিবেশী’ পররাষ্ট্রনীতির প্রতিফলন ঘটেছিল। ভারতের প্রতিবেশী ছোট ছোট দেশের সঙ্গে আন্তরিকতার সম্পর্ক ও অর্থনৈতিক সমন্বয় করার কেন্দ্র ছিল এই নীতি। সীমান্ত বিরোধ ও দ্বিপক্ষীয় বিষয়ে মতানৈক্য, ভারতের অর্থায়নে পরিচালিত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীরগতি এবং দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবে এই নীতি হোঁচট খেয়েছে।
অবশ্য মোদির এই নীতির অন্যতম ‘সাফল্য’ হিসেবে ধরা হচ্ছিল বাংলাদেশকে। টানা দেড় দশক ক্ষমতায় থাকার পর সম্প্রতি ছাত্র–জনতার আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঘনিষ্ঠভাবে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে কাজ করে গেছেন। তাঁদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক দেখে মনে হতো, উভয় পক্ষই এর সমান সুফলভোগী। কিন্তু শুরুতে গণতন্ত্রপন্থী থাকলেও শেখ হাসিনা ধীরে ধীরে বাংলাদেশে একটি কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। এতে দেশটির মানুষের মনে ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হচ্ছিল।
সম্প্রতি সরকারি চাকরিতে কোটাব্যবস্থার সংস্কার দাবিতে শুরু হওয়া শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে এই জনরোষের বিস্ফোরণের ঘটল। আন্দোলন শুরুর কিছুদিন পরই শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থার অবসান দাবি হয়ে উঠল আন্দোলনের প্রধান দাবি। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ল গোটা দেশে। প্রবল আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিলেন। এখনো ভারতেই আছেন তিনি।
অজনপ্রিয় হওয়া সত্ত্বেও শেখ হাসিনার পদত্যাগ ভারতের রাজনৈতিক ও সামরিক মহলের কাছে ছিল অপ্রত্যাশিত। হাসিনা যত দিন ক্ষমতায় ছিলেন, তত দিন তাঁকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে গেছে ভারত। অনেক ক্ষেত্রে অন্য অংশীজনদের উদ্বেগ ও বাংলাদেশের জনগণকে উপেক্ষা করে ভারত শেখ হাসিনাকে সমর্থন দিয়ে গেছে। মোদির নেতৃত্বে ভারত সরকার শুধু বাংলাদেশ নয়, বেশির ভাগ প্রতিবেশী দেশের ক্ষেত্রে এমন অবস্থানে চলেছে। আর এ কারণ অনেক সময় দুর্ভাগ্যজনক পরিণতি ডেকে এনেছে।
প্রতিবেশী দেশগুলো নিয়ে ভারতের নীতি যে শুধু বাইরের নানা চাপের কারণে ব্যর্থ হয়নি, তা বেশ স্পষ্ট। এর সঙ্গে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির যোগ রয়েছে। কূটনীতিকে শুধু সুবিধা আদায়ের হাতিয়ার বানানো থেকে শুরু করে মোদির পরাক্রমশালী চরিত্র নির্মাণ—সব ক্ষেত্রেই দক্ষিণ এশিয়ার মানুষের কাছে ভারতের উদারনৈতিক অবস্থানকে ক্ষুণ্ন করেছে নয়াদিল্লি। মোদির আশীর্বাদপুষ্ট করপোরেট প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষায় শেখ হাসিনার সরকারের মতো সরকারকে নানা অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা দিয়ে আসার বিষয়টি নয়াদিল্লির উদ্দেশ্য নিয়ে আরও সন্দেহের জন্ম দিয়েছে।
নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপির হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শ ভারতের আঞ্চলিক স্বার্থ ক্ষুণ্ন করার ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে, বিশেষ করে বাংলাদেশে। ২০১৯ সালে মোদি সরকার সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন (সিএএ) নামে একটি আইন প্রণয়ন করে। ভারতে বসবাসরত প্রতিবেশী দেশগুলোর সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীকে যত দ্রুত সম্ভব নাগরিকত্ব দিতে প্রণয়ন করা হয় আইনটি। কিন্ত এই আইনে বাদ দেওয়া হয় শুধু মুসলিমদের। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয় বাংলাদেশে।
বিজেপির সরকারের হাতে ভারতীয় মুসলিমদের বঞ্চনার ঘটনা বিভিন্ন দেশে মোদির সমালোচনায় নতুন মাত্রা যোগ করে। ২০২১ সালে মোদি যখন বাংলাদেশ সফর করেন, তখন এর প্রতিবাদে অনেক মানুষ রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করেছিলেন। এতে সহিংসতার ঘটনাও ঘটেছিল।
শেখ হাসিনার ক্ষমতাচ্যুতি ভারত সরকারকে এক মুহূর্তের জন্য হলেও আত্মদর্শনের সুযোগ করে দিয়েছে। অবশ্য ভারত এখন পর্যন্ত তার নীতিগত ভুল শোধরানোর মতো কাজে যুক্ত হতে পারেনি বলেই মনে হচ্ছে। তবে বাংলাদেশে ভারতের যে কলঙ্কিত ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশে মোদি সরকারের এটাই প্রথম বড় ব্যর্থতা নয়, হয়তো শেষ ব্যর্থতাও হবে না।
নরেন্দ্র মোদি সরকারের তথাকথিত ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ কায়েমের অভিলাষ শুধু ভারতেরই ক্ষতি করছে না, একই সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ায় এর সর্বনাশা প্রভাব পড়বে।
শেখ হাসিনার সঙ্গে ভারতের মিত্রতার সম্পর্কের শিকড় অনেক গভীরে। ১৯৭৫ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে নিহত হন শেখ হাসিনার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পরে ভারতে আশ্রয় নেন শেখ হাসিনা ও তাঁর বোন শেখ রেহানা। বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ফেরানোর লক্ষ্যে ভারত থেকে দেশে ফেরেন শেখ হাসিনা।
১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত হাসিনা ছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। এরপর ২০০৯ সালে আবার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের পর রাজনৈতিক বিরোধী, সাংবাদিক ও অধিকারকর্মীদের ধরপাকড় ও কণ্ঠরোধের মধ্য দিয়ে তিনি একজন কর্তৃত্ববাদী শাসক হয়ে উঠতে শুরু করেন।
চরমপন্থী ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোকে লক্ষ্যবস্তু করেছিল ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে পরিচিত শেখ হাসিনার দল আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনা ভারতবিরোধী জঙ্গি গোষ্ঠীগুলোকে দেশে ঘাঁটি গাড়তে দেননি। ভারতও এমনভাবে শেখ হাসিনাকে সমর্থন দিয়েছে, যার নজির পাওয়া দুষ্কর। শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখতে ভারত পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে তদবির পর্যন্ত চালায়। ভারতীয় কর্মকর্তারা এমনও বলেন, ‘যদি শেখ হাসিনা ক্ষমতায় না থাকেন, তাহলে বাংলাদেশ হয়ে উঠবে জঙ্গিবাদের চারণভূমি, যা ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য এক বড় হুমকি। ’
চলতি বছরের জানুয়ারিতে বড় বড় রাজনৈতিক দলের বর্জনের পরও অনুষ্ঠিত বিতর্কিত নির্বাচনে টানা চতুর্থবারের মতো শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার সময় যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ভারত তদবির করেছিল, বাংলাদেশে গণতন্ত্র অবনমনের জন্য যেন হাসিনাকে চাপ দেওয়া না হয়।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের বেশ ভালো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছিল। সামরিক থেকে শুরু করে সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানই ছিল তাঁর কবজায়। এটা দেখে ভারত ভেবেছিল, যতই বিক্ষোভ–প্রতিবাদ হোক না কেন, হাসিনাই ক্ষমতায় থাকছেন। কিন্তু ভারতীয় গোয়েন্দা ও কূটনৈতিক ব্যর্থতায় নয়াদিল্লি হতবাক হয়ে যায়, যখন সেনাবাহিনী ৫ আগস্ট শেখ হাসিনাকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে বলে।
পশ্চিমা কোনো দেশ রাজনৈতিক আশ্রয়ের ব্যাপারে সাড়া না দেওয়ায় নয়াদিল্লিতে আটকা পড়ে আছেন শেখ হাসিনা। তিনি যখন ভারতে পৌঁছান, তখন সেখানে তাঁকে স্বাগত জানান ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল।
শেখ হাসিনাকে শর্তহীনভাবে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছে মোদির সরকার। এর মাধ্যমে প্রতিবেশীর সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ককে ব্যবহার করে নয়াদিল্লি যে বাড়তি ফায়দা তোলার নীতি গ্রহণ করেছে, তারই প্রতিফলন ঘটেছে। তবে দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ভারতের যে ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক, নৃতাত্ত্বিক, ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক মিত্রতার সম্পর্ক, এই নীতি তার বিরোধী।
এ ছাড়া বলতে হয়, নয়াদিল্লি তার প্রতিবেশী দেশগুলোর আস্থা অর্জনের সুযোগ তো কাজে লাগাতে পারেইনি, বরং এসব দেশে অস্থিতিশীলতার জন্ম দিয়েছে। এ অঞ্চলের মানুষের মনোভাব বুঝতে পারেনি মোদির নেতৃত্বাধীন ভারতের বর্তমান সরকার।
২০২১ সালে এক রক্তপাতহীন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এর প্রতিবাদে গণতন্ত্রের দাবিতে দেশটিতে বিক্ষোভ শুরু হয়। এমন পরিস্থিতিতে জান্তা সরকারের পক্ষ নিয়ে গণতন্ত্রপন্থী বিক্ষোভ দমনে ভূমিকা রেখেছে ভারত। আফগানিস্তানে তালেবান আবার ক্ষমতায় ফেরার পর গোষ্ঠীটির সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেছে। এ ক্ষেত্রে ভারতের কাছে উপেক্ষিত থেকেছে দেশটির সাধারণ জনগণ।
নরেন্দ্র মোদিকে পরাক্রমশালী একজন নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার রাজনীতি থেকেই ভারতের আঞ্চলিক কূটনীতিকে ব্যবহার করা হয়েছে। বিতর্কিত ভারত–চীন সীমান্তে বেইজিংয়ের আগ্রাসন নিয়ে নরেন্দ্র মোদি সব সময় নীরব থেকেছেন। মোদির এই প্রতিচ্ছবি তৈরির খেসারত দিতে হয়েছে প্রতিবেশী ছোট দেশগুলোকে।
ভারতীয় চরমপন্থীদের ঘাঁটি আছে—এমন অভিযোগ তুলে ২০১৫ সালে মিয়ানমারের ভূখণ্ডে ঢুকে সামরিক অভিযান চালায় ভারত। একই বছর নেপাল নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ঘোষণার পর কাঠমান্ডুর ওপর বাণিজ্য অবরোধ আরোপ করে নয়াদিল্লি।
গত বছর মোদির সমর্থকেরা দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপে ভারতীয় পর্যটক যাওয়া বন্ধের দাবিতে প্রচার শুরু করেন। মালদ্বীপের কয়েকজন মন্ত্রী প্রকাশ্যে নরেন্দ্র মোদির সমালোচনায় নামলে শুরু হয় কূটনৈতিক টানাপোড়েন। এরপরই এ প্রচারণায় নামেন মোদির সমর্থকেরা।
অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন সমস্যা, ট্রানজিটসহ ভারতকে অন্যান্য বাণিজ্যসংক্রান্ত বাড়তি সুবিধা দেওয়া নিয়ে এমনিতেই বাংলাদেশের মানুষের মনোভাব ভারতবিরোধী। এ ছাড়া বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) বেপরোয়া অবস্থান নিয়ে ক্ষুব্ধ সে দেশের জনগণ।
এসব সুবিধা দেওয়ার বিনিময়ে শেখ হাসিনা নিজের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে ভারতের কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা নেওয়ায় নয়াদিল্লির প্রতি জনরোষ আরও বাড়ে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে শেখ হাসিনাকে বাড়তি সুবিধা দিয়ে ভারত বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করে যাচ্ছিল।
বাংলাদেশে ভারত এখন যে সমস্যার মুখে পড়েছে, তাতে ভূমিকা রেখেছে জনতুষ্টিবাদ, কর্তৃত্ববাদ ও স্বজনতোষণ। কিন্ত এ সবকিছুর চেয়েও বেশি ক্ষতি করেছে মোদি সরকারের হিন্দু জাতীয়তাবাদ।
মোদি সরকারের হাতে এখন উপায়ও আছে কম। শেখ হাসিনার পদত্যাগের জন্য ইসলামী চরমপন্থী, পাকিস্তান বা চীনকে দোষারোপ না করে ভারতের এখন এটা স্বীকার করা উচিত হবে যে প্রতিবেশী দেশগুলোর মানুষ কর্তৃত্ববাদী সরকারকে উৎখাত করতে পারে।
ভারত যতই নিজেদের উদীয়মান এক পরাশক্তি হিসেবে প্রচার চালাক, আদতে প্রতিবেশীদের কাছেও তারা অনেক দুর্বল বলে প্রতীয়মান। ভৌগোলিক অবস্থানের দোহাই দিয়ে যতই বলা হোক যে ছোট প্রতিবেশী দেশগুলোর অবশ্যই ভারতের সঙ্গে কাজ করা উচিত। কিন্তু এখন নয়াদিল্লিকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সম্পর্ক গড়তে নজর দিতে হবে।