পশ্চিমবঙ্গের উপনির্বাচনে কেন অবিশ্বাস্য ভোট পেল তৃণমূল কংগ্রেস

তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ছবি: এএনআই

ভারতের পশ্চিমবঙ্গের ২ শতাংশ আসনে উপনির্বাচনে ফল ঘোষণার দুই দিন পর নির্দিষ্টভাবে শতাংশের হার পাওয়া গেছে। এই হার বিরোধীদের ব্যাপক হতাশ করেছে, তবে উৎসাহিত করেছে ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসকে। তবে সেই উৎসাহ নিয়ে প্রশ্নও রয়েছে।

ফলাফল থেকে কয়েকটি চিত্র উঠে আসছে। প্রথমত, আরজিকর মেডিকেল কলেজে নারী চিকিৎসককে ধর্ষণের পর হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রধানত বিভিন্ন ধারার বামপন্থীদের যে আন্দোলন কলকাতাকে উত্তাল করেছিল, তা গ্রামাঞ্চলে প্রভাব ফেলেনি। ফল থেকেই সেটা বোঝা যাচ্ছে। ছয়টি আসনে নির্বাচন হয়েছিল। সব কটিতেই মোটামুটি বিরোধী বাম ফ্রন্ট এবং কংগ্রেসের ভোট আরও কমেছে। একমাত্র মেদিনীপুরে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার (সিপিআই) ভোট সামান্য বেড়েছে। কিন্তু সব আসনেই বাম ফ্রন্ট ও কংগ্রেসের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছে। জামানত ধরে রাখতে গেলে ১৬ দশমিক ৬৬ শতাংশ ভোট প্রয়োজন, যা কোনো আসনেই বিরোধী বাম ফ্রন্ট বা কংগ্রেস পায়নি।

অন্যদিকে সব আসনেই প্রধান বিরোধী দল বিজেপির ভোটও বেশ ভালোই কমেছে। বিভিন্ন আসনে ৩ শতাংশ থেকে প্রায় ৩০ শতাংশ ভোট কমেছে বিজেপির। উপনির্বাচনে সাধারণত বিরোধীদের ভোট কমে এবং ক্ষমতাসীন দলের ভোট বৃদ্ধি হয়। কারণ, উপনির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন করা যায় না। ক্ষমতাসীন দলের বিরুদ্ধে কেউই যেতে চান না, ফলে উপনির্বাচনে ক্ষমতাশীন দল ভালো ফল করে।

কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন তৃণমূল অস্বাভাবিক ভালো ফল করে বসেছে। বাম ফ্রন্ট ও বিজেপির যে ভোট কমেছে, এককথায় বলা যায় যে সেই ভোট পেয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। কোনো কোনো আসনে তাদের ভোটের হার অবিশ্বাস্য বেশি। যেমন কোচবিহারের সিতাইতে তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে ৭৬ শতাংশ ভোট। যেখানে ২০২১ সালের নির্বাচনে তারা পেয়েছিল ৪৯ শতাংশ ভোট। উত্তর ২৪ পরগনার হাড়োয়াতেও তৃণমূল কংগ্রেস পেয়েছে ৭৬ শতাংশ ভোট, যেখানে ২০২১ সালে পেয়েছিল ৫৭ শতাংশ ভোট। উত্তরবঙ্গের মাদারীহাট আসনটি ধারাবাহিকভাবে পেয়ে আসছিল বিজেপি, সেটিও ৫৪ শতাংশ ভোট পেয়ে জিতেছে তৃণমূল।

এই ফলাফলের কারণ কী

এই ফলাফলের নানা ব্যাখ্যা দিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, গবেষক ও লেখক অধ্যাপক সৌমেন চক্রবর্তী। একসময় সিপিআইএম দলের সদস্য অধ্যাপক চক্রবর্তী বাম ফ্রন্ট সম্পর্কে বললেন, তারা অল্পবয়স্ক কিছু নেতা-নেত্রীকে সামনে আনতে পেরেছে ঠিকই। কিন্তু সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার যাদের রয়েছে, তারা সব পুরোনো মুখ।

অধ্যাপক চক্রবর্তী প্রথম আলোকে বলেন, বলা যেতে পারে, সিপিআইএম ট্রেনের বগিগুলোকে পাল্টেছে কিন্তু ইঞ্জিন একই রয়েছে। যা সাধারণ মানুষকে এখনো বাম ফ্রন্টবিমুখ করে রেখেছে।

এই অধ্যাপক আরও বলেন, যাঁদের বয়স ৩৫ থেকে ৫৫-এর মধ্যে, তাঁদের স্মৃতিতে বাম ফ্রন্টের নেতিবাচক ভাবমূর্তি এখনো অক্ষুণ্ন। ফলে তাঁরাও ভোট দিচ্ছেন না। পশ্চিমবঙ্গে যে ২৮ থেকে ৩০ শতাংশ মুসলমান ভোট রয়েছে, সেই ভোটও এখনো পাচ্ছে না বাম ফ্রন্ট। সব মিলিয়ে তাদের ভোট বাড়ছে না, বরং ধারাবাহিকভাবে কমছে।
অধ্যাপক সৌমেন বলেন, নাগরিক আন্দোলনে অবশ্যই কিছুটা সাড়া পড়েছিল এবং এর পেছনে নানা গোত্রের বামদের একটা ভূমিকা ছিল। কিন্তু দেখা গেল, উপনির্বাচনে সেটা খুব একটা কাজে এল না। এটা একটা শহরকেন্দ্রিক আন্দোলন হিসেবেই শেষ পর্যন্ত রয়ে গেল।

বিজেপি সম্পর্কে সৌমেনের বক্তব্য, বারবার তৃণমূল কংগ্রেস থেকে ‘ভাড়াটে সৈন্য’ এনে লড়াই করার যে প্রবণতা বিজেপির মধ্যে তৈরি হয়েছে, তা তাদের বিশ্বাসযোগ্যতাকে যথেষ্টই ধাক্কা দিয়েছে।

এই রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বলেন, মানুষ আর বিজেপিকে ঠিক বিশ্বাস করতে পারছে না। কারণ, তারা সেই পুরোনো মুখকেই নতুন দলে দেখছে। তৃণমূলের বিরুদ্ধে যে ক্ষোভ, সেই ক্ষোভ প্রশমন করতে নতুন মুখ দরকার। এটা বিজেপি বুঝতে পারছে না। তারা তৃণমূলের নেতাদেরই বারবার সামনে আনছে এবং বিপদে পড়ছে। তবে শুভেন্দু অধিকারী নিজের একটা ভাবমূর্তি তৈরি করতে পেরেছেন।

অধ্যাপক সৌমেন, ‘বিজেপির রাজ্য সভাপতি হিসেবে দিলীপ ঘোষের বিদায়ের পর দলের মধ্যে একটা অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল, যেটা খানিকটা বিজেপি কাটিয়ে উঠেছে। উপনির্বাচনের ফল দেখে হয়তো এটা বোঝা যাচ্ছে না, কিন্তু বিধানসভায় বিরোধীদলীয় নেতা শুভেন্দু অধিকারী মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছেন। ফলে বিজেপি তাঁর ওপর খুশি এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) তার ওপরই আস্থা রাখছে। এটা ভবিষ্যতে কাজে দেবে বলে আমার ধারণা।’

তৃণমূলের সুবিধা-অসুবিধা

অধ্যাপক সৌমেনের মতে, তৃণমূল কংগ্রেসের অনেক সুবিধার মধ্যে কিছু অসুবিধাও আছে। প্রথমত, এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেওয়া বিভিন্ন সমাজকল্যাণমূলক অনুদানের প্রভাব গত ১০ বছরে কমে গেছে বলে যেটা শহরের মানুষ মনে করেন, সেটা গ্রামাঞ্চলে ঠিক নয়। একেকটি পরিবারের সবাই যদি অনুদান পান, তাঁরা সে ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত খাদ্যসামগ্রী এবং অর্থনৈতিক অনুদান রাজ্য সরকারের কাছ থেকে পান।

রাজ্য ঘুরে ও বিভিন্ন জায়গায় ব্লক ডেভেলপমেন্ট অফিসারের সঙ্গেও কথা বলে এই অধ্যাপকের মনে হয়েছে, জনকল্যাণমূলক অনুদানের এখনো বিস্তীর্ণ প্রভাব রয়েছে। কলকাতায় যখন আন্দোলন হলো, তখন গ্রামে বোঝানো হলো যে অনুদান বন্ধ করানোর জন্য শহরের মানুষ এই আন্দোলন করছে। এসবের বিরাট প্রভাব রয়েছে, যেটা শহরে বোঝা যায় না। তাই মনে হচ্ছে, তৃণমূলের জনপ্রিয়তা কমছে। তাদের জনপ্রিয়তা হয়তো কমছে, কিন্তু ততটা কমছে না।

তৃণমূল কংগ্রেসকে সিপিআইএমের ‘ক্লোন’ বা অবিকল ভাবমূর্তির দল বলে মনে করেন অধ্যাপক সৌমেন। তিনি বলেন, সিপিআইএমের মতোই তারা গ্রামবাংলায় ভোট করাতে শিখেছে। তৃণমূল নানা কৌশল নেয়, যার মধ্যে এক দিকে যেমন ভুয়া ভোটিং রয়েছে, তেমনি আবার রয়েছে ভয় দেখানো বা প্রশাসনের সাহায্যে ভোট করানো। মানুষ রাষ্ট্রশক্তিকে ভয় পায়। বিরোধীরা বিষয়টি জানলেও বিশেষ কিছু করে উঠতে পারে না। এর সঙ্গে তৃণমূলের অনুদানের রাজনীতি যুক্ত হয়ে তাদের একটা ভয়ংকর শক্তিশালী দল হিসেবে পশ্চিমবঙ্গে গড়ে তুলেছে।

পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিপদ আসছে অন্য দিক থেকে। পশ্চিমবঙ্গে ভেতরে–ভেতরে একটা বিরাট সাম্প্রদায়িক রাজনীতি মাথা তুলছে। এটা বিরাট আকার ধারণ করছে। এর অন্যতম প্রধান কারণ, সংখ্যালঘু ভোটের কথা মাথায় রেখে তৃণমূল গ্রামাঞ্চলে সুকৌশলে জমি বণ্টন করছে এবং জেলা পরিষদে আসন বণ্টন করছে। এটাকে ঠিক গরিবদের জন্য কাজ করা বলা যাচ্ছে না। কারণ, আদিবাসী বা তফসিলি জাতিভুক্ত মানুষের জন্য একইভাবে কাজ করা হচ্ছে না। নির্দিষ্টভাবে ভোটব্যাংকের রাজনীতির কথা মাথায় রেখে এই জমি বা পদ বণ্টন করা হচ্ছে। এটা একাধিক জায়গায় দেখা গেছে। এতে গ্রামাঞ্চলে কিন্তু একটা সাম্প্রদায়িক সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, যেটা শেষ পর্যন্ত বিজেপিকেই সাহায্য করবে।

অধ্যাপক সৌমেন বলেন, এর জেরে আর বছরখানেক পর পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস হেরে যেতে পারে, এখনই অবশ্য এমনটা মনে হচ্ছে না।